আমাদের যাদের লেখাপড়া জানা বলে মনে করা হয় অর্থাত তথা কথিত শিক্ষিত মানুষ সহজে রেজানী পানী দেখতে পাবে না। হয়তো আমরা যারা শিক্ষিত তারা বিষয়টি ঠিকমতো অনুভবও করতে পারবো না। তবে রাজস্থানের সমাজ যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছে তারা খুব সহজেই রেজওয়ানী পানির দর্শন পেয়ে যায়, সেটি তাদের বুনিয়াদি শিক্ষা। এই শিক্ষা তাদের শুধু রোজওয়ানী পানীর দর্শনই করায় নি, মরুভূমির মত কঠিন এলাকায়, চারিদিকে নোনতা জল ঘেরা এলাকাতে জলকে অমৃতের মত মিষ্টি পান যোগ্য করে নেওয়ার জটিল টেকনিকটিও শিখিয়েছে।
গান্ধী বিচার কি, তার বারসম্যায় কি কি থাকতে পারে তা আমি না তখন জানতাম না এখন এমন কিছু জানতে পেরেছি যা সকলকে বলতে বা জানাতে পারি। তবে রাজস্থান কয়েক বার যাতায়াতের সুবাদে আমি রাজস্থানের সমাজের বারমস্যার সঙ্গে মনে হয় কিছুটা পরিচিত হতে পারেছি। প্রায় 30 বছর ধরে এই বারমাস্যার পাঠ নিচ্ছি আর প্রতিদিনই এই পাঠে নতুন কিছু না কিছু যোগ হয়েই চলেছে। সমাজের বর্ণমালায় সত্যি সত্যিই অসংখ্য, অগুনতি বর্ণ, রঙ রয়েছে। আমাদের আধুনিক শিক্ষার এমনই ধারা যে আমরা শুধু সমাজের উদাস রঙের দিকেই তাকিয়ে থাকি। কালো রঙকে, তার দোষগুলোকে আমরা গালি-গালাজ করি কিন্তু তার উজ্বল চমকালো রঙটা দেখতে পাই না।সমাজ কি ভাবে চলে, সে তার সদস্যদের কিভাবে সংগঠিত করে, কিভাবে তাদের শিক্ষন - প্রশিক্ষন দেয়, কোন কুশলতায় তা প্রয়োগ করে এ সবই আমর দেখার ও বোঝার সুযোগ হয়েছে তাদেরই একজন সদস্যের মতোই। তারা তাদের কাজের কত দীর্ঘ পরিকল্পনা তৈরী করে তাও দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম বংশ পরম্পরায় জুড়ে, একে অপরের সাধ মেটায়, বিগড়ানোর বদলে আগলে রাখে, সামলায়। এই সব কিছুর বিরাট দর্শন আমি ছড়িয়ে থাকা বিশাল মরুস্থলে, মরুপ্রদেশে পাই আর আজও পেয়ে চলেছি।
আজ আপনাদের সামনে এই বিশাল মরুভূমিতে ছড়িয়ে থাকা বালির বিশাল সাম্রাজ্যের এক চিমটি বালিই হয়ত আমি তুলে ধরতে পারবো। তবে আমি আশা রাখি যে এই একটু খানি বলির প্রতিটি কনায় নিজ সমাজের শিক্ষা, তার শিক্ষণ - প্রশিক্ষনের পরম্পরা, তার জন্য তৈরী করা সুন্দর, অলিখিত পাঠ্যক্রম, তা ধার্য্য করেছিল যে বিশাল সংগঠন, তাদের কখনও অসফল না হওয়ার পরিনামের (রেজাল্ট) আভাষ, ঔজ্জ্বল্য ও উত্তাপ আপনি পাবেন।
আজ যেখানে বালির বিস্তারিত সাম্রাজ্য, কয়েক লাক্ষ বছর আগে সেখানে সমুদ্র ছিল। ছিল নোনতা জলের বিশাল জলরাশি। আছড়ে পড়ত ঢেউয়ের পর ঢেউ। সেই সময় ধরিত্রীর এক বিত্তা মাটির টুকড়াও এখানে ছিল না। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই বিশাল সমুদ্র কিভাবে শুকতে শুরু হয়, তারপর হাজার হাজার বছর ধরে শুকিয়েই চলে আর তার পর কিভাবে সুন্দর, এই সুন্দর সোনালী মরুপ্রদেশ হয়ে যায় – ‘ধরতী ধোরা রী’ – হয়ে যায় - এটি পড়তে, বুঝতে আপনাকে ভূগোলের বই, প্রাগৈতিহাসিক বইয়ের স্তূপে হাজার হাজার পাতা ওলটাতে হতে পারে। অথচ এই জটিল ভৌগলিক ঘটনাটি খুবই সহজেই বুঝতে পারবেন এখানের সমাজের মনের থেকে । যারা এখানে থাকে সেই সমস্ত সমস্ত মানুষের মনের মনিকোঠা থেকে। তারা সমস্ত আড়ম্বর, সমস্ত প্রসঙ্গকে কেবলমাত্র দুটি শব্দে স্মরনে রাখে – ‘পলক দরিয়াব’ অর্থাত পলক ফেলতেই যে দরিয়া, সমুদ্র গায়েব হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ বছরের গুন - ভাগ, ভজনফল, অগুনতি শূন্য দেওয়া সংখ্যা সব কিছু সে একজন সিদ্ধ শিক্ষকের মত ব্যাল্কর্বোড থেকে ডাস্টার দিয়ে মুছে চকের গুড়ো ঝেড়ে ফেলে আর সংক্ষিপ্ত একটি কথায় বলে – ‘পলক দরিয়াব’।
যে সমাজ এতটা পিছনে এত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ফিরে দেখতে পারে, সে ততটাই সামনে নিজের ভবিষ্যতও দেখতে সক্ষম। তারা ততটাই সহজ ভাবে, সরল ভাবে বলে ফেলে – পলক দরিয়ার। মানে পলক পড়তেই এখানে কোন দিন সমুদ্র ফিরে আসতে পারে। পৃথিবী গরম হয়ে ওঠার, সমুদ্রের জল স্তর বেড়ে ওঠার যে চিন্তা আমরা আজ বিশ্বজুড়ে দেখতে পাচ্ছি, তারই একটা ছোট্ট ঝলক এই সমাজের পথ নাটিকায়, নাটকে কোথাও কোন জায়গায় আজ থেকে কয়েক - শ বছর আগেও আপনি পেয়ে যেতে পারেন। এখানের ভাষায়, আধুনিক শিক্ষা শাস্ত্রে সম্ভবত একে ভাষা না বলে চলিত ভাষা বলা হয়, তো এই চলিত ভাষায় সমুদ্র, দারিয়াবের জন্য একটি শব্দ আছে - হাকড়ো। হাকড়োর আরও একটি অর্থ হল আত্মা। নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত যে সমাজ এই এলাকাকে জলের অভাবের এলাকা বলে থাকে, মনে করে থাকে। অথচ এই এলাকার আত্মা হল হাকড়ো মানে জল।
সময়ের অনাদি অনন্ত ধারাকে পল - প্রতিপাল দেখা ও সৃষ্টির বিরাট বিস্তারকে অনুতে পরখ করে নেয় যে পল, সেই দৃষ্টি হাকড়োকে, সমুদ্রকে অবশ্যই হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু সে নিজের আত্মাতে, স্মরণে হাকড়োর বিশাল জলরাশিকে কনায় কনায় বিন্দুতে বিন্দুতে দেখে নিয়েছে। তারা অনন্ত সমুদ্রকে খন্ড খন্ড করে নিজেদের গ্রামে গ্রামে, গঞ্জে গঞ্জে ছড়িয়ে নিয়েছে। প্রাইমারী স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে দেশের পরিকল্পনা কারীদের কাগজে পর্যন্ত রাজস্থানের, বিশেষ করে মরুপ্রদেশের ছবি – একটি শুকনো, উজাড় হয়ে যাওয়া, পিছিয়ে পড়া এলাকার ছবি। থর মরুভূমির বর্ণনাতো এমনভাবে দেওয়া হয় যে ভয়ে কলজে ঠাঙা হয়ে যাবার জোগাড়। দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে ক্ষেত্রফলের হিসেবে এটিই সবচেয়ে বড় রাজ্য, তবে বর্ষার বার্ষিক গড়ে এই রাজ্য সব থেকে শেষেই রয়েছে।
বর্ষাকে পুরোনো ইঞ্চিতে মাপা হোক বা নতুন মিলিমিটার সেণ্টিমিটারে, বৃষ্টি এখানে সব থেকে কমই পড়ে। দেশে গড় বর্ষা ১১০ সেণ্টিমিটার মাপা হয়। সেই হিসেবে রাজস্থানের গড় প্রায় অর্ধেকই হয় – ৬০ সেণ্টিমিটার। গড় বলা হয় ঠিকই তবে সেই পরিসংখ্যান এখানের সঠিক চিত্র দিতে পারে না। রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রাপ্ত পর্যন্ত এই ১০০ সেণ্টিমিটার থেকে ১৫ সেণ্টিমিটার পর্যন্ত আর কোথাও তো তার থেকেও কম।
ভূগোলের বইগুলো প্রাকৃতিকে, বর্ষাকে এই মরুস্থলে একজন অত্যন্ত কন্জুস মহাজন রূপে চিত্রিত করেছে। এই এলাকা সেই মহাজনের শোষনের শিকার বলেই মনে করা হয়। রাজ্যের পূর্ব ভাগ থেকে পশ্চিম ভাগে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বর্ষা কম থেকে আরও কম হয়ে পড়ে। নিপাট পশ্চিমে মানে বাড়মের, জয়-সলমের পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে তো বর্ষা সূর্যের মতো অস্তাচলের পথে পাড়ি দেয়। জয়সলমেরে বর্ষার বাত্সরিক গড় ১৫ সেণ্টিমিটার। তবে জয়সলমের আমাদের দেশের সবথেকে বড় জেলা। এতে আবার পূর্ব ও পশ্চিম রয়েছে। জয়সলমেরের পশ্চিমী ভাগ, পাকিস্তানের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে যে অংশটি, সেখান পর্যন্ত আসতে আসতে মনসুন তো ক্লান্তই হয়ে পড়ে, আর কখনো মাত্র ৩-৪ সেণ্টিমিটার তো কখনও ৭ সেণ্টিমিটার হালকা জলের ছাট দিয়ে বিশাল নীল আকাশে এক মুঠো তুলোর মতো গায়েব হয়ে যায়। এর তুলনা গোয়ার সাথে, কোঙ্কনের সঙ্গে বা পাঠ্যপুস্তকে যে নামটি পাই চেরাপুঞ্জি তার সঙ্গে করা যায় তো পরিসংখ্যান ১০০০ সেন্টিমিটারও পার করে যায়।
মরুভূমিতে বৃষ্টি নয় সূর্যের বর্ষণ হয়। গড় তাপমাত্রা থাকে ৫০ ডিগ্রী। জল, বর্ষা খুবই কম আর সূর্যের তাপ খুব বেশি – এই দুটি বিষয় যদি কোন জায়গায় একসাথে থাকে তো আধুনিক শিক্ষা এই কথাই বলে যে - জীবন অসহনীয়। এতে আরও একটি তৃতীয় জিনিস জুড়ে নেওয়া যাক। এখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই ভূ-জল নোনতা। পানের অযোগ্য।
জীবনকে ভীষণই কঠিন করে তোলা এই তিনটি বিন্দু দিয়ে ঘেরা এই এলাকা অন্য মরু এলাকার তুলনায় ভীষনই অন্যরকম। এখানে ঐ সব জায়গার তুলনায় অনেক বেশি বসতি। আর সেই বসতির জীবনে রয়েছে সুগন্ধ।
এই সুগন্ধের রহস্য কি? রহস্য রয়েছে এখানের সমাজে। মরুপ্রদেশের সমাজ প্রকৃতির দেওয়া এই কম বর্ষার, কম জলের কান্না কখনও কাঁদেনি। তারা এই সব কিছুকে একটা চ্যালেঞ্জের মতো করে নিয়েছে আর নিজেদেরকে ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত দৃড় ভাবে সংগঠিত করেছে কিছুটা এইভাবে যে জলের স্বভাব পুরো সমাজের স্বভাবে খুবই সরল ও তরল ভাবে প্রবাহিত হতে পেরেছে। ‘সাঁই ইতনা দিজিত্র, ওয়ামে কুটুম্ব সমায়’ - এর বদলে হয়ত তারা বলেছেন – ‘সাঁই জিতনা দিজিত্র, ওয়ামে কুটুম্ব সমায়’। এত কম জলে তারা এত ঠিক - ঠাক ব্যবস্থা করে দেখিয়েছেন যে তারাও যেন পিপাসার্ত না থাকে, আর সাধু তো বটেই অসাধুও যেন জল পায়।
জলের কাজ এখানে ভাগ্যের আবার কর্তব্যেরও, ওটা সত্যি সত্যি ভাগ্যই তো ছিল কি মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হবার পর শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র (হরিয়ানা) থেকে অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে দ্বারকায় ফিরছিলেন এই মরুপ্রদেশের এপর দিয়ে । এই বিচিত্র গল্পে বলা হয়ে থাকে – তাঁর অপূর্ব রথ জয়সলমেরের মধ্য দিয়ে চলেছিল। জয়সলমেরের কাছে ত্রিকুট পর্বতে তারা দেখেন উত্তুঙ্গ ঋষী তপস্যায় রত। শ্রীকৃষ্ণ তাকে প্রনাম করেন ও তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিতে চাইলেন। উত্তুঙ্গ মানে হল উঁচু। ঋষি সত্যি সত্যিই উঁচু ছিলেন। তিনি নিজের জন্য কিছু চাইলেন না। উত্তুঙ্গ ঋষি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন - প্রভু যদি আমি কিছু মাত্র পূন্য অর্জন করে থাকি, তাহলে আমাকে বর দিন - যেন এই মরুভূমিতে কখনও জলের অভাব না হয়।
ভগবান বর দিয়ে ছিলেন – ‘তথাস্তু’। অন্য কোন সমাজ হলে এই বরদানের পর হাতে হাত দিয়ে বসে থাকত। এটাই ভাবত যে - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের বর দান করেছেন, যে আমাদের কখনও জলের অভাব হবে না তাহলে আমাদের আর কি চিন্তা, আমরা কি জন্য আর কিছু করতে যাব। এখন তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সব কিছু করবেন।
মরুভূমির ভাগ্যবান সমাজ কিন্তু মরু নায়কের (শ্রীকৃষ্ণকে মরু নায়ক বলা হয়) কাছে বরদান পেয়ে হাতে হাত রেখে বসে পড়েনি, জলের বিষয়ে নিজেদেরকে বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করেছে। গ্রামে গ্রামে, গঞ্জে গঞ্জে বর্ষার জলকে সামলে রাখার জন্য, আটকে রাখার জন্য তারা এক সে এক সুন্দর রীতি খুঁজে বার করেছে, প্রয়োগ করেছে।
রীতির জন্য এখানে একটি পুরানো শব্দ রয়েছে - ঔয়জ। ঔয়জ মানে - রচনা, মুক্তি আর উপায়ও। এই ঔয়জে অর্থে বিস্তারও এসে পড়ে। আমরা দেখতে পাই পুরোনো প্রয়োগে ঔয়জ ব্যবস্থা, সামর্থ, বিবেক আবার বিনম্রতার অর্থেও ব্যবহার হোত। বর্ষার বিন্দুগুলিকে সামলে রাখার ঔয়জ অর্থাত, বিবেকও থাকবে আবার তা সম্পূর্ণ বিনম্রতার সঙ্গে।
তাই এখানের সমাজ বর্ষাকে ইঞ্চি বা সেণ্টিমিটারে পরিমাপ করে নি। তারা হয়তো মেপেছে বিন্দুতে বিন্দুতে। বৃষ্টি কম পড়ে? আজ্ঞে না। বৃষ্টি তো কোটি কোটি বিন্দুতে ঝরে পড়ে। তার ওপর আবার এই বিন্দুগুলি কোনের সাধারণ কিছু নয়। তারা এগুলিকে ‘রজত বিন্দু’ বলেছেন। আর সেই দৃষ্টিতেই দেখেছেন ও বুঝেছেনও। নিজেদের এই অদ্ভুত বোধ থেকে, ঔয়জ থেকে তারা এই রজত বিন্দুগুলিকে সামলে রাখার একটি এমন ভব্য পরম্পরা তৈরী করেছেন যার ধবল ধারা ইতিহাস থেকে বেরিয়ে বর্তমানে তো বয়ে চলেছেই, ভবিষ্যতেও বহমান থাকবে।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান, পরিবেশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রগতির যে নতুন শব্দাবলী তাতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের খেয়াল রাখাটা, আদর্শের মতো দেখা হয়। ধরিত্রীর ধন-সম্পদের ব্যবহার বর্তমান প্রজন্ম কোন সমতায় করবে যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্ত বাতাস, জল, মাটি, খেত, খনিজ ও সম্ভবত পেট্রোলও ঐ একই রকম ভাবেই পাওয়া যায় - যেমন আজ পাওয়া যাচ্ছে ; এমন কথা যিনি বলেন চর্চা করেন তাঁকে বড় পরিবেশবিদ, বলা হয়। এমন কথা তো রাজস্থানের সমাজের গ্রামে গ্রামে না জানি কখন থেকে শুধু বলাই হয়নি, এখানের মানুষ এমন কথায় বংশ পরম্পরায় বিশ্বাস করে এসেছে। মাটিতে এই আদর্শের প্রতি বিশ্বাসের কথা পরে বলা যাবে। এখন একটু ওপরে উঠে আকাশ ছুঁয়ে দেখা যাক। মেঘ এখানে সব থেকে কম আসে। অথচ মেঘের নাম এখানে সব থেকে বেশি পাওয়া যায়। সাধুভাষা ও সংস্কৃততে তো ঝরে পড়া মেঘের নাম রয়েছেই, তাছাড়াও এখানের চলিত ভাষাতেও নামের ঘন ঘটা দেখা যায়, বর্ষণ দেখা যায়। আপনি ৪০ প্রকার মেঘের নাম পেয়ে যাবেন, প্রতিশব্দ নয়, পাক্কা ৪০টি নামের সূচী তৈরী হয়ে যাবে। একটু অপেক্ষা করুন - এত সাবধানতার সঙ্গে এই যে সূচী তৈরী করা হল, এই সূচীতে যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় কোন বাগাল ছেলে বা গোয়ালা বা আরও কেউ আরও দু - চারটা নাম জুড়ে দিল, এটা হতেই পারে।ভাষা ও তার সাথে সাথে এই সমাজের বর্ষা সমন্ধীয় অনুভব সম্পন্নতা শুধুমাত্র এই চল্লিশটি নামে কিছুই ধরা পড়ে না। তারা এই মেঘের প্রকার, আকার চাল - চলন, স্বভাব ইমানদারী, বেইমানি – সব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বর্গিকরণ করেই চলে। এদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মেঘের ঝাঁক থেকে একলা পড়ে যাওয়া ছোট্ট এক টুকরো মেঘেও উপেক্ষার পাত্র নয়। এরও একটা আলাদা নাম আপনি পেয়ে যাবেন – চূখো। সব থেকে দুর্লভ আর কঠিন কাজ, মরুভূমিতে বর্ষণ সেরে মেঘের দল, অর্থাত নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করে কোন ছোট পাহাড় বা বালির স্তূপে একটু খানি থেমে বিশ্রাম করে নিচ্ছে যে মেঘ, পূর্ণ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সমাজ তারও একটি নাম রেখেছে রিন্ছী ।
আমাদের হিন্দী, বাংলা আর সম্ভবত ইংরেজীর সংসারও বৃষ্টির জলের দুটি রূপ দেখতে পায় – একটি হল উপরিতলের জল (সারফেস ওয়াটার)। অন্যটি হল ভূ - জল (গ্রাউন্ড ওয়াটার)। নদী, নালা, খাল, বিল, ঝিল প্রভৃতির জল মাটির ওপরে রয়েছে আবার এখান থেকে চুঁইয়ে মাটির নীচে নামা জল হল ভূঞ্জল। তবে মরুভূমির সমাজ নিজেদের আশপাশ থেকে, পরিবেশ থেকে, ভূগোল থেকে যে বুনিয়াদী শিক্ষা পেয়েছিল, তাতে সেই প্রেক্ষিতে জলের আরও এক প্রকার জলের অনুসন্ধান পাওয়া যায়। তার নাম হল – রেজানী বা রেজওয়ানী পানী।
আমাদের যাদের লেখাপড়া জানা বলে মনে করা হয় অর্থাত তথা কথিত শিক্ষিত মানুষ সহজে রেজানী পানী দেখতে পাবে না। হয়তো আমরা যারা শিক্ষিত তারা বিষয়টি ঠিকমতো অনুভবও করতে পারবো না। তবে রাজস্থানের সমাজ যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছে তারা খুব সহজেই রেজওয়ানী পানির দর্শন পেয়ে যায়, সেটি তাদের বুনিয়াদি শিক্ষা। এই শিক্ষা তাদের শুধু রোজওয়ানী পানীর দর্শনই করায় নি, মরুভূমির মত কঠিন এলাকায়, চারিদিকে নোনতা জল ঘেরা এলাকাতে জলকে অমৃতের মত মিষ্টি পান যোগ্য করে নেওয়ার জটিল টেকনিকটিও শিখিয়েছে।
তবে জটিল টেকনিক, জটিল জ্ঞান কোন কাজের। সমাজ সেটিকে অতি সরল সহজ করে গাঁয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। এর চর্চা আবার পরে করা যাবে। এখন প্রথমে আমরা এটা দেখে নি যে নোনতা জলে ঘেরা, অন্প একটু বর্ষার মাঝে হাজার গ্রাম, গঞ্জ, শহরে জলের কাজ কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল।
এরকম কাজ যদি আমরা করতে চাই, তাহলে আমরা কি করি? একটা বড় সংস্থা তৈরী করি। তার হেড অফিসের খোঁজ করি। তারপর তার কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, কয়েকটি শাখা তৈরী করি। সম্পাদক নির্বাচন করি। পরিচালন সমিতি তৈরি করে, একজনকে কার্য নির্বাহী বলে উল্লেখ করা হয়। এক কথায় হাজার কর্মকর্তা থাকে। তার পর এই বিশাল সংস্থাকে চালানোর জন্য বড় - সড় বাজেট জোগাড় করি। কিছুটা সরকারী সাহায্যে চলে তো কিছু ক্ষেত্রে আবার সরকারী সাহায্যকে অচ্ছুত মনে করে দেশীয় সাহায্য জোগাড় করা হয়, বিদেশী অনুদানও ছেড়ে দেওয়া হয় না। এতসব কিছুর পরও যদি কাজ হয়ে যায়, যে উদ্দেশ্যে সংস্থা তৈরী করা হয়েছে, সংগঠন খাড়া করা করেছে তা যদি হয়ে যায় তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু অনেক সময় সেটা হয় না। বাকি সবকিছু হতে থাকে, হরতাল এখনকি তালাবদ্ধ পর্যন্ত হতে থাকে। শুধু তাই নয় কখনও কখনও আমাদের এই সুন্দর সংগঠন ভালো লোকেদেরই পরস্পরের ছোট ছোট মত ভেদের কারণে ভেঙ্গে যায়, নষ্ট হয়ে যায়।
তবে মরুভূমির সমাজ এইরকম বিপদের ঝুঁকি নিতেই পারে না। তাদের তো সবথেকে কম জলের এলাকায় সব থেকে চুস্ত, দুরস্ত সংগঠন তৈরী করলেই হতো না, সেই সংগঠনের সকলকে নিয়ে অনেক অনেক কাজ করানোর দরকার ছিল। তাই তারা খুব বড় সংগঠন তৈরী করল, আর তার আকার বড় হতে এত বড় বল যে তা নিরাকার হয়ে গেল। বাস্তব দুনিয়ায় নিরাকারের যে সাধারণ অর্থ চালু আছে সেই অর্থেও, আবার ঠিক আধ্যাত্মিক অর্থেও।
এই রকম অদ্ভুত নিরাকার সংগঠনটি তারা না রাজ অর্থাত সরকার বা না কোন সর্বজনিক ক্ষেত্র বা না কোনো ব্যক্তিগত হাতে সমর্পন করল। পুরোনো ভাষায় যাকে বলে নিজের হাতে, সেই নিজের হাতে তারা কুবেরের ধনের মতো আদরে আর ভালবাসায় রাখে এই সংগঠন। তারপর সেই কাঠামোটিকে ঘরে - ঘরে, গ্রামে - গ্রামে সকলে মিলে বোঝার মত নয়, সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মাথায় করে তারা নিরাকারকে সাকার করে দেয়। সমগ্র সমাজ নিজেদের বর্ণ, জাতি, বর্গ, প্রতিষ্ঠা, পরিবার সব কিছু ভুলে, সব কিছু ছেড়ে, সব কিছু অর্পণ করে জলের এই কাজে লেগে পড়ে। জলের কাজের এই বিচিত্র বুনিয়াদি শিক্ষার যে সুন্দর ইমারত তৈরি হল, যে কাঠামো তৈরী হল তা নিরাকার। তাই আমাদের নব্য সমাজ তাদের নির্গুন, বা স্পষ্ট করে বললে বিনা সওয়াল, আর আরও স্পষ্ট করে বললে অনেক দোষ রয়েছে বলে নিজেদের সংসার থেকে বাদই দিয়ে দিয়েছে।
তবে এই কাঠামো, এই আকার, নিরাকার হওয়া সত্ত্বেও অনেক গুণযুক্ত সগুন। এটি জপ করার মতো। এটি লোকশিক্ষার অদ্ভুত এক পাঠশালা। লোক বুদ্ধির পূর্ণ উচ্চতা এখানে দেখা যাবে, আর লোক সংগ্রহের নিরন্তন বয়ে চলা গাথাও।
একটা লম্বা সময় নিয়ে আমরা লোক শক্তির অনেক অনেক কথা বলেছি। সাম্যবাদ থেকে শুরু করে সর্বোদয় পর্যন্ত লোক শক্তির প্রচুর উপাসনা হয়েছে। তবে আমরা এই পর্যায়ের এই সময়ের, লোক বুদ্ধিকে চিনতে পারিনি। গান্ধীজীর এক এক নিষ্ঠ সাথী দাদা ধর্মাধিকারী উপাধিহীন মানুষ প্রতিষ্ঠায় খুব জোর দিতেন। সেই উপাধিহীন মানুষের প্রতিষ্ঠা আপনি এখানে জলের কাজে দেখতে পাবেন। এই লোকবুদ্ধিকে যদি আমরা দেখতে, বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে হয়ত আর আমাদের আলাদা করে রাজস্থান বা মরুপ্রদেশের কথা বলার প্রয়োজন পড়বে না। আমরা যেখানে আছি সেখানেই তার দর্শন হয়ে যাবে। তখন হয়ত আপনি, আমরা এটাও জানতে পারবো যে এই দেশের বর্তমান, বর্তমান টেকনিক্যাল শিক্ষার ভীতেও আনপড় বলা হয় থাকে যে সমাজকে, তাদেরই মুখ্য যোগদান রয়েছে। তাই আমাদের দেশের প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খোলা হয়েছিল একটি ছোট্ট শহরে (কোন বড় শহরে নয়)। আর সেখানে ভর্তী হওয়ার জন্য স্কুল শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না। ইংরেজী জানারও প্রয়োজন ছিল না। আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি শুধুমাত্র আমাদের দেশেরই নয়, এশিয়ার মধ্যে প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এই সম্পূর্ণ গল্পটি আমাদের অনেক নতুন কথা বলে। তবে সে এক লম্বা প্রসঙ্গ। তাই সে প্রসঙ্গকে এখম এখানেই রেখে আগে এগোনো থাক।
বিগত সময়ে আমরা লোক বুদ্ধিকে বুঝতে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে সহজ রাস্তা ফেলে এসেছি, আজ গান্ধীর স্মৃতিতে একত্র হয়ে আমরা যদি সেই রাস্তায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে । সেই কথা, সেই উপায়, সেই সংগঠন গুলিকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি যেগুলি লোকবুদ্ধির রাস্তায় হাঁটে না। হামেসাই আমাদের অনেক কাজ – কর্ম, ক্রিয়া - কলাপ শুভ মানসিকতা থেকে করা চিন্তা, তৈরী করা প্রকল্প বেশিরভাগ ক্ষেত্রই সমাজের একটি বড় অংশকে হিতগ্রাহী মনে করে, হিতগ্রাহী চিহ্নিত করে এগিয়ে চলে। আমরা তাদের উদ্ধার করতে এসেছি, উপকার করতে এসেছি - এর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অনেক সময় আমরা এই লোক, জন, জনতা – এই ধরণের দশাবলীতে এখনভাবে ফেঁসে যাই যে, তারপর আমরা বিজ্ঞানেও জন বিজ্ঞান, লোক বিজ্ঞানের কথা বলে থাকি কিন্তু প্রায়ই লোক বিমুখ খরচ সাপেক্ষ বিজ্ঞানের কোন রাস্তা, সংস্করণই সেই নাম থেকে খুঁজে নিয়ে আসি, তবে সেটিও সমাজে সেভাবে খাপ খায় না যেমনভাবে আমরা চাই। তখন আমরা নিরাস হয়ে যাই। নিজেদের অসফলতার জন্য সেই সমাজকেই দোষ দিই যেটিকে আমরা বদলাতে, সুধরাতে চেয়েছিলাম। সমাজ আমাদের কথা শুনল না, আমাদের এইরকম মনে হতে থাকে।
‘জসঢোল’ এখানে একটি সুন্দর শব্দ। জস অর্থাত, যশে র ঢোল। মরুপ্রদেশে জলের কাজকে প্রবাহিত করার জন্য না জানি কত হাজার বছর ধরে জোরে – জোরে যশঢোল বাজিয়েছিল, কিন্তু আমরা আমাদের নতুন সমাজ, তার বোল, তার সঙ্গীত শুনিই নি। আজ তার বোল, লয়, সুব লহরীর কিছু অংশ আপনাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।
শিক্ষন, প্রশিক্ষন প্রভৃতি সব প্রসঙ্গেই অক্ষরের মাহাত্ম্য স্বীকার করতেই হয়। মরু প্রদেশে জলের যে বিশাল কাজ বিস্তার করা হয়েছে, সেখানে অক্ষর জ্ঞানকে এক্কেবারে পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কোন অপগুনের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়নি, জীবন শিক্ষার জীবনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অনিবার্যতা স্বীকার করা হয়নি। অক্ষর জ্ঞানকে এখানে অন্য এক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে - নষ্ট হয় না এমন জ্ঞান।
তাঁদের এই পরিভাষায় দুটো উদাহরণ দেখা যাক। এদের মধ্যে একটির প্রসঙ্গ আগেই এসেছে তবে আংশিক। নোনতা জলের মাঝে অমৃতের মত মিষ্টি জল পাওয়ার পদ্ধতির দিকে কিছু ইঙ্গিত করেছিলাম। মরুভূমিতে কিছু খাস অংশে প্রকৃতি বিশাল বালুকা রাশির নীচে একটি আড়ে - তেরছা পট্টিও দিয়ে রেখেছেন। এটা পাথর দিয়ে তৈরী, এই এলাকায় প্রায় ২০০-৩০০ ফুট নীচে প্রচুর জল রয়েছে। তবে পূর্ণরূপে নোনতা। এই জল কাজের জল নয়। তবে এই পাথরের পট্টির জন্য মাটির ওপর অল্প একটু বৃষ্টির জল, ধীরে ধীরে চুঁইয়ে এই পট্টিতে ধাক্কা খেয়ে আটকে যায় আর একটা বড় জায়াগা জুড়ে মাটির ওপর থেকে নীচে এই পাথরের স্তর পর্যন্ত খাম আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
নিরক্ষর, আনপড় বলা হয়েছে যে সমাজকে, মরু প্রদেশের সেই সমাজ আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে বালির টিলা, বালির সমুদ্রের মধ্যে প্রায় দশ (১০) ফুট থেকে এক শত (১০০) ফুট নীচে বয়ে যাওয়া পাথরের এই পট্টিকে চিহ্নিত করেছে। শুধু যে চিহ্নিতই করেছে তাই নয়, তার অপূর্ব প্রয়োগ ও উপযোগীতাও বের করেছে। এই পাথরের পট্টির কারণেই জন্যই তারা বালির মধ্যে লুকিয়ে থাকা আর্দ্রতাকে আক্ষরিক অর্থেই নিংড়ে মিষ্টি জল বার করে নেওয়ার একটি খুবই পেঁচালো, জটিল ব্যবস্থা নিয়েছিলো। এই সমস্ত এলাকায় যে সব সরকার এসেছে বা গেছে, সব সরকারই হ্যান্ড পাম্প, টিউব ওয়েল প্রভৃতি লাগিয়ে এই গ্রামগুলিকে জল দেবার কাজ অবশ্যই করেছে, তবে সে সবই নোনতা জল।
উচ্চ শিক্ষিত, বিকশিত জার্মানি থেকে প্রচুর ব্যায়বহুল একটি নতুন ট্যাকনিক নিয়ে এসে নোনতা জলকে মিষ্টি জলে রূপান্তরের চেষ্টা করা হয়। এই কায়দা কানুনের প্রভাবে ও বিভিন্ন প্রকার অপপ্রচারে পাঁচ সাত বছরে গ্রামের লোক নিজেদের পদ্ধতিও ছেড়ে দেয়। কিন্তু যখন জলের নোনতা ভাব শেষ তো করা সম্ভবই হল না, উপরন্তু এতটাই বেড়ে গেল যে গরু - ছাগল পর্যন্ত খাওয়া ছেড়ে দিল তখন এই সব এলাকার নামুষকে আবার ফিরে কুঁই তৈরীর কাজ শুরু করতে হল। ছেড়ে দেওয়া ভাঙ্গা - চোরা কুঁইগুলিকে ঠিক করা শুরু হল। আবার নিজেদের হিম্মতে ফিরে মিষ্টি জল পাওয়ার ব্যবস্থায় ফেরা শুরু হল। মুশকিল হল গরু, ছাগল, ভেড়া যে জল খেতে চায়নি সেই জল দেওয়াকেই বিকাশের, প্রগতির বা আধুনিকতার প্রতীক বলে মনে করে সরকার। এর পর তিন - চার সরকার এর মাঝে রাজ্যে এলো রাজত্ব করল আবার ফিরেও গেল। শিক্ষা আন্দোলন এখানে বেসরকারী স্তরেও হয়েছে, আবার অনেক সমাজসেবী সংস্থাও জল চেতনার স্লোগান তুলেছে। তবে কুঁই - এর ফিরে আসা গ্রামের লোকেদের হিম্মতেই হয়েছে। আরও একবার সেই অক্ষর জ্ঞান, নষ্ট হয় না যে জ্ঞান সেই জ্ঞান, সেই শিক্ষণ, সেই নিরাকার সংগঠন নোনতা জলের মাঝে মিষ্টি জল জোগাড় করে।
দ্বিতীয়টির এক্কেবারে সঠিক উদাহরণ জয়সলমের ক্ষেত্রতে এক বিশেষ ধরনের চাষের সঙ্গে যুক্ত। এটাও সেই পাথরের পট্টির সঙ্গে জুড়ে থাকা এক অদ্ভুদ বিজ্ঞান। কোথাও কোথাও এই পট্টিটি মাটির উপর দিকে কম গভীরেই উঠে আসে। তখন এতে বালির লুকিয়ে থাকা আদ্রতা এতটা হয় না, যে তা যথেষ্ট মাত্রায় মিষ্টি শক্ত জল দিতে পারে। তাহলে কি সমাজ একে এমনিই ছেড়ে দেবে? না। আনপড় আখ্যা দেওয়া হয়েছে যে সমাজকে, সেই সমাজ আজ থেকে প্রায় ছয় শত (৬০০) বছর আগে এই ধরনের ভূখন্ডে একটি পরীক্ষা করে ও মাত্র তিন (৩) ইঞ্চি বৃষ্টিতে গম, ছোলার মতো রবি শষ্য তুলে নেবার চমত্কার উপায় বার করে। যে কোন আধুনিক কৃষি পন্ডিত বা কৃষি বিশেজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করা যেত পারে যে ছয় (৬) ইঞ্চি বৃষ্টিতে গম চাষ হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার বদলে, প্রশ্ন কর্তাকেই পাগল বলা হবে।
এই রকম বিশেষ ভূখন্ডে একটি বিশেষ সীমারেখা রেখে সমাজ এই অল্প একটু বৃষ্টির জলকে পাথরের পট্টিতে আটকে খডীন নামের মূল্যবান খেতের আবিষ্কার করে। তারা এই থেকে কৃষির অবিস্মরনীয় কাজ তো করেইছে এছাড়াও এতে তারা সমাজ শাস্ত্রের, পরস্পরের সদভাবের, সমভাবের, শোষনমুক্ত সমাজের, প্রভুত্ব বিসর্জনের, অর্থাত মিলন মিলাপের অপূর্ব শিক্ষা নিজেরাও শিখে ও শেখায়। হাজার হাজার মানুষ মারা যাবার পরও যে সর্বজনীক খেতের প্রয়োগ দুনিয়াতে সফল নি, সেই কাজ এখানের বিনম্র, মৌন, শান্ত সমাজ নিজেদের খডীনে করে দেখিয়েছে, কোন প্রকার স্লোগান, আন্দোলন ছাড়াই।
হামেসাই খরার কবলে পড়া এই গ্রামগুলিতে বর্ষা ঠিকঠাক হলে একটা ফসল তো ওঠে, তবে বর্ষা ঠিকঠাক না হলে সেটাও হয় না। খডীনে কিন্তু দুটো ফসল তোলা যায়। খারীপ ও রবী, দুটোই। আমাদের শিক্ষিত সমাজের লোকেদের মনে হতে পারে যে এই রকম বিশিষ্ট খেত তো ঐ এলাকার গ্রামের উচ্চ বর্ণের ঠাকুর প্রভৃতি, বা বলবান ব্যক্তি, অথবা সামাজিক শক্তিমানদেরই থাকতে পারে।ব্যপারটা সেরকম নয়। বিষয়টি একটি খুবই সংবেদনশীল ও জটিল সামাজিক কাঠামোর ওপর দাড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতির কৃপায় যদি গ্রামে খডীনের মতো খেত থাকে তাহলে সেটি সেই গ্রামের সব ঘরেরই খেত। সকলেই তার মালিক। অথবা এটা বলা যায় যে তার কোন মালিক থাকে না। ‘লাস’ নামের এক উন্নত সামাজিক প্রথায় খেতের সব কাজ হয়। লাস সম্ভবত সংস্কৃত উল্লাস থেকে এসেছে। এতে সকলে মিলে কাজ করে। এটা শ্রমদান প্রথা থেকেও একটা উন্নত প্রথা। এতে সমস্ত কাজকে উল্লাসের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। লাসের নিজস্ব গান রয়েছে, যা বর্তমান টি.ভি, কেসেট, এফ.এম, মোবাইলের যুগেও হারিয়ে যায়নি।
এই প্রথায় গ্রামের সকল ঘর মিলে এক সঙ্গে কাজ করে। জাতিভেদ প্রথা অর্থাত জাত - পাতের ভেদাভেদের এখানে কোন স্থান নেই। খেত প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে রোপোন, নিড়ান, সফল কাটা পর্যন্ত সকলেই একসঙ্গে কাজ করে। যখন ফসল কাটা হয় তখন সকলে সমান ভাগ পায়, আর তা সকলের ঘর পৌছে যায়। কেউ অসুস্থ, অসমর্থ, বৃদ্ধ মহিলা বা পুরুষ থাকলে তাকে কাজ থেকে ছুটি দেওয়া হয়। তবে এই সদস্যরাও প্রায়সই খডীনের ধারে বাবলা গাছ বা অন্য কোন গাছের নীচে এসে বসে থাকে। কখনও বা গান গায়, আবার কথনো বা বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। যদি কেউ বিকলাঙ্গ বা নেত্রহীনও থাকে তবে তারাও লাস খেলার জন্য এই মনোহর উত্সবটি থেকে দূরে থাকতে চান না। সকলের পরিশ্রম, সকলের ভাগ। স্ববর্ণ, উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ – এই বর্ণ বিদ্বেশের কোন পাঠ এখানে পড়ানো হয় না। এখানে সবাই মালিক,সবাই মজদুর, সবাই উত্পাদক, সবাই উপভোক্তা সবাই শিক্ষক, সবাই শিষ্যও - এই পাঠই খড়ীনে পড়ানো হয়ে থাকে।
জীবনের শিক্ষার, সমাজের শিক্ষার, জীবন শৈলীর এমন সুন্দর পাঠ আমরা লেখা - পড়া জানা লোকেরা ঠিক মত জানি না। মরুভূমিতে অনেক সামাজিক আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এই সুন্দর খডীনের পাঠশালায় বিনা বাধায় পার হয়ে গেছে।
জলের বয়ে নিয়ে যাওয়ার যে শিক্ষন সত্যি সত্যি তার এক অবস্মরনীয় প্রয়োগ এই সমাজ করে দেখিয়েছে। দু পাঁচ বছর টিকবে এমন প্রয়োগ এটা নয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতও নয়। পাঁচশো বছরের লম্বা আয়ুর কথা ভেবে তৈরী করা হয়েছে এই পরিকল্পনা। আধুনিকতার ঝঞ্ঝা বা সমাজ থেকে বিছিন্ন শিক্ষাও জীবন শিক্ষার এই প্রয়োগগুলিকে পুরোপুরি রূপে নষ্ট করতে পারেনি।
ইংলেন্ড থেকে শ্রী ক্রিস্টোফর বিঞ্চ গত বছর এই আলোচনা সভায় আসেন। তিনি তার ভাষণের শেষে বলেন – “যদি আজ গান্ধীজী থাকতেন তাহলে দেশের এই তিব্র গতিতে আর্থিক বিকাশের কয়েকটি দিক বিষয়ে খুশি হতে পারতেন না। তিনি তো নাগরিকদের উত্পাদকের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রাখতে চেয়েছিলেন। এটি হল সেই ভূমিকা, যা তার মানবতা আর সত্যি বলতে কি তার আধ্যাত্মিকতার মহত্বপূর্ন দিকটি উদ্ভাসিত করে।”
আনপড় বা অশিক্ষিত বলে চিহ্নিত করা হল যে সমাজকে, আমাদের সেই সমাজ গান্ধীজীর এই কথাটি আদর্শের মতো নিয়েছিল, আর তাই নাগরিকদের উপভোক্তার হবার আগেই আদর্শ উত্পাদক তৈরী করার পাঠশালা খুলেছিল।
Path Alias
/articles/raaja-samaaja-o-jala
Post By: Hindi