নয়া সংরক্ষণ নীতি মানুষকে শুধুই ছিন্নমূল করে


1980 -তে ঘোষিত হয় বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি, 83 -তে এদেশে তৈরী হয় ন্যাশন্যাল ওয়াইল্ড লাইফ এ্যাকশন প্ল্যান (N. W. A. P.)। সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে জাতীয় পরিবেশ নীতির আওতায় এনে একে কেন্দ্রীভূত করাই হল এর আসল উদ্দেশ্য। এই আইন বলে সরকার যখন তখন যে কোন জায়গাকে সুরক্ষিত এলাকা বলে চিহ্নিত করতে পারে। বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষের জীবিকার কোন বিকল্প ব্যবস্থা না করেই তাঁদের উচ্ছেদ করতে পারে। আইন মতে সংরক্ষিত এলাকায় যেহেতু প্রবেশ নিষেধ ফলে কোনরকম বনজ সম্পদ সংগ্রহ করার অধিকারই আর বনজীবীদের থাকে না।

সাহারানপুর বিকল্প সোস্যাল অরগানাইজেশন ৯২ -র মার্চ মাসে এই তথ্যপত্রটি তৈরী করে
11 -ই জানুয়ারী সকাল হল মেঘলা আকাশ নিয়েই, বৃষ্টি নামল একটু পরেই। বেলা তখন প্রায় 10 টা, বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে পথ ঘাট। তারই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে শ আষ্টেক (প্রায় ৮০০ শত) লোকের একটা মিছিল। মিছিল চলেছে উত্তর প্রদেশের রাজাজী পার্কের দিকে। বেশি দূর যেতে হল না। পার্কের কাছাকাছি আসতেই প্রথমে তাঁদের ফিরে যেতে বলা হল। কিন্তু তাতেও কাজ হল না দেখে বনরক্ষী এবং সি. আর. পি. গুন্ডাবাহিনী এলোপাথাড়ি লাঠি চালালো মিছিলের উপর; শিশু, বৃদ্ধ, নারী পুরুষের তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু মিছিলের এক কথা, হয় আমাদের ভাবর (দড়ি তৈরীর এক জাতীয় ঘাস) সংগ্রহ করার অধিকার ফিরিয়ে দাও, নয়তো গুলি কর, গ্রেপ্তার কর। বেগতিক দেখে বন দপ্তরের অধিকর্তা জনতার কয়েকজনের সঙ্গ কথা বলতে রাজী হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রায় সকলকেই অপমান করে তাড়িয়ে দেয়া হল।

কেন এই মিছিল -


শিবালিক পাহাড়ের নীচে 65 কি. মি. লম্বা এবং 14 কি. মি. চওড়া ঘাড়ের (GHAD) দুই পাশ ঘিরে আছে নদী। পশ্চিমে যমুনা, পূর্বে গঙ্গা, পশ্চিম অংশটা পড়েছে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলায়, আর পূর্ব অংশটা হরিদ্বার জেলায়। 216 -টা গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা ঘাড়ের বর্তমান জনসংখ্যা 17 লাখ (17,০০,০০০)। জীবনযাত্রা প্রচন্ড কষ্টের। শুধু যে জমিকে চষাই যায় না তা নয়, যখন তখন বুনো শুয়োর এবং হাতির পাল নেমে এসে একটু আধটু শষ্য যাও বা হয় তা তছনছ করে চলে যায়। ফলে শিবালিকের বনজ সম্পদ ভাবরই প্রায় দশ হাজার (10,000) পরিবারকে প্রতিদিনের রুটিরুজি দেয়। এই ঘাস থেকে এরা ব্যান (দড়ি) তৈরী করে, কখনো-সখনো বন বিভাগে ঠিকে মজুরের কাজ করে, আবার কখনও বা শহরে গিয়ে রিক্সা চালায়, ইট বয় ইত্যাদি। দারিদ্র - সীমার নীচে বাস করা হিমালয়ের তেহরী গাড়োয়াল এবং জম্মু - কাশ্মীর থেকে মাইগ্রেট হয়ে আসা এই দলিত সম্প্রদায় দেরাদুনের পাহাড়ে অরণ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকেছে বহুকাল। অনুমোদন পেয়েছে বনের জ্বালানী কাঠকুটো কুড়োবার; বাড়ী তৈরীর কাঠ, পশুখাদ্য (রাভানা) পড়ন্ত ফল এবং ভাবর সংগ্রহের – একটা নির্দিষ্ট মূল্যে।

কিন্তু 1986 সাল থেকে উত্তর প্রদেশ বনদপ্তর এঁদের ভাবর সংগ্রহের অধিকার কেড়ে নিতে চেষ্টা করে এবং 90 থেকে শুরু হয় এঁদের ছিন্নমূল করার প্রয়াস। কারণ বনের পশুপাখী এবং গাছপালা সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে এখানে একটা পার্ক তৈরী হবে। রাজাজী জাতীয় পার্ক। 48 থেকে 77 –র মধ্যে তৈরী করা শিবালিকের তিনটি অভয়ারণ্য রাজাজী, মতিচুর এবং চিল্লাকে মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরী হবে এই পার্ক। 1983-র আগষ্ট মাসেই উত্তর প্রদেশ সরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইন -এর সেকশান 35-র ধারা অনুসারে প্রাথমিকভাবে একটা নোটিফিকেশন জারি করে এই অভয়ারণ্যগুলো অধিগ্রহণ করে।

আটশত একত্রিশ (831) বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে তৈরী হতে যাওয়া রাজাজী জাতীয় পার্কের আশপাশ ঘিরে আছে 55টা গ্রাম পঞ্চায়েত। আর পার্কের ভিতর দিকে আছে 4টি তুঙ্গা গ্রামের 6050 জন গুজর সম্প্রদায়ের মানুষ। বন দপ্তরই এদের বসতি করিয়েছিল, বন তৈরীর জন্য। গাছ লাগিয়ে তাকে বড় করে এঁরা সরকারকে দিয়েছে কোটি কোটি টাকা, বিনিময়ে পেয়েছে একটা প্রাথমিক স্কুল, পানীয় জল কিছুটা চারণভূমি এবং কিছুটা চাষভূমিও। কিন্তু এখন বনের পশুপাখীদের স্বার্থেই এঁদের চলে যেতে বলা হচ্ছে। বিকল্প কোন জীবিকা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই। হরিদ্বারের দিকের দড়ি শিল্পীরা ঘাড ক্ষেত মজদূর সংঘর্ষ সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে 91 -র জুলাই মাস থেকে। তাঁদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। হাজার পাঁচেক লোকের সই করা একটা মেমোরান্ডামও বনদপ্তরের অধিকর্তার ঘরে জমা পড়েছে। শুধু মিটিং মিছিলই নয়, সম্প্রতি তুল গ্রামের অধিবাসীরা সুপ্রীম কোর্ট থেকে একটা স্টে অর্ডার আনিয়েছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়। সুপ্রীম কোর্টকে কাঁচ কলা দেখিয়ে পার্কের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে একটা যোগসূত্র গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে BHEL এবং IDPL (ইন্ডিয়ান ড্রাগ এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড) জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে এবং সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এখানে একটা সেনা ছাউনী তৈরীরও অনুমোদন দিয়েছে।

একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক


1972 -র স্টকহোম ঘোষণাপত্রে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সংরক্ষিত এলাকা তৈরীর কথা বলা হয়। এবং 1980 -তে ঘোষিত হয় বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি, 83 -তে এদেশে তৈরী হয় ন্যাশন্যাল ওয়াইল্ড লাইফ এ্যাকশন প্ল্যান (N. W. A. P.)। সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে জাতীয় পরিবেশ নীতির আওতায় এনে একে কেন্দ্রীভূত করাই হল এর আসল উদ্দেশ্য। এই আইন বলে সরকার যখন তখন যে কোন জায়গাকে সুরক্ষিত এলাকা বলে চিহ্নিত করতে পারে। বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষের জীবিকার কোন বিকল্প ব্যবস্থা না করেই তাঁদের উচ্ছেদ করতে পারে। আইন মতে সংরক্ষিত এলাকায় যেহেতু প্রবেশ নিষেধ ফলে কোনরকম বনজ সম্পদ সংগ্রহ করার অধিকারই আর বনজীবীদের থাকে না। ঘাড়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গ্রামবাসীদের ঠিকাদারদের কাছ থেকে কুইণ্টাল প্রতি 300 টাকা দরে ভাবর ঘাস কিনতে বলা হচ্ছে। অর্থাত যে সম্পদটা ছিল একান্ত তাঁদেরই নিজস্ব, আজকে তারই জন্য ঠিকাদারের হাতের পুতুল হওয়া ছাড়া দড়ি শিল্পীদের আর কোন উপায় থাকছে না। উপরন্তু মূল গ্রাম থেকে 15-30 কি. মি. দূরত্বে সাহারানপূর অঞ্চল থেকে এঁদের ভাবর সংগ্রহ করার কথা বলা হচ্ছে। এটা একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ শুধু যে যানবাহনের অসুবিধা আছে তাই নয়, নিয়মিতভাবে এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘাস পাওয়াও যায় না। এছাড়া এখনও পর্যন্ত পশুখাদ্য এবং জ্বালানীর কাঠ কুটো তাঁরা কোথা থেকে সংগ্রহ করবে তাঁরও কোন স্পষ্ট নির্দেশ নেই। সরকারী খাতায় কলমে ক্ষতিপূরণ, পূর্নবাসন, বিকল্প জীবিকার কথা স্বীকৃত হলেও রাজাজী জাতীয় পার্কের ক্ষেত্রে প্রাথমিক নোটিফিকেশন জারির 9 বছর পরেও এসবের কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। আসলে এগুলো যে এক একটা বিরাট ভাঁওতা সেটা এদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দেখলেই বোঝা যায়।

(বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক দ্বিমাসিক পত্রিকা, মার্চ - জুন ১৯৯২, P 252 লেক টাউন, ব্লক A, কলিকাতা – 700 089)

Path Alias

/articles/nayaa-samrakasana-naitai-maanausakae-saudhaui-chainanamauula-karae

Post By: Hindi
×