অবশেষে 2004 সালে নেপোলিয়ানের মৃত্যু রহস্য পরিষ্কার হল। 1816 সালে সেণ্ট হেলেনা যাবার আগে 1814 ও 1815 সালে রক্ষিত সম্রাটের চুলে আর্সেনিকের পরিমাপ করলেন জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিলেই লিন ও সহকর্মীবৃন্দ।
ওয়াটারলু যুদ্ধের (1815) পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে ব্রিটিশরা বন্দি করে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার সেণ্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করে (1816), সেখানে 1821 সালে মাত্র 52 বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ভীষণ তেজী কষ্টসহিষ্ণু নেপোলিয়নের রহস্যজনক অকালমৃত্যু ঘিরে দীর্ঘকাল সন্দেহ বিতর্ক চলেছে, যার সম্পূর্ণ নিরসন আজও হয়নি। ব্রিটিশরা নেপোলিয়নের ময়না তদন্ত করেছিল, তিনি পাকস্থলির ক্যানসারে মারা যান বলে রায় দেওয়া হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও গুপ্তহত্যার অনেক তত্ত্বও চালু হয়। ব্রিটিশরা কি তাদের কুকর্ম ঢাকবার জন্যই ময়না তদন্তের ছল করেছিল, নাকি নেপোলিয়ন বিরোধী কোনও ফরাসি পক্ষ তাঁকে গুপ্তহত্যা করিয়েছে? বিশ বছর পর নেপোলিয়নের সমাধিস্থ দেহ প্যারিসে স্থানান্তরিত করা হয়। সন্দেহ ও বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় রক্ষিত নেপোলিয়নের এক গোছা চুলে আর্সেনিকের অতিরিক্ত উপস্থিতি। ফরাসিরা 1840 সালে সেণ্ট হেলেনায় শায়িত সম্রাটের কবর খুঁড়ে মৃতদেহটি মাত্র দুই মিনিটের জন্য খুলে আবার বন্ধ করে দেয়। মৃতদেহ থেকে কোনও ট্যিস্যু বা অন্য কিছু নেওয়া হয়নি। মৃতদেহটি সযত্নে রক্ষিত। প্রথমে মৃতদেহটি টিনের কফিন ঝালাই করে বন্ধ করা ছিল। সেটা আবার মেহগনি কাঠের কফিনে ভরে লেডের আর একটি কফিনে ঝালাই করে বন্ধ করা হয়। সেটা আবার আর একটি মেহগনি কাঠের কফিনে ভরে রূপোর স্ক্রু দিয়ে আটকানো। এমনি করেই শায়িত মহিমান্বিত সম্রাট নেপোলিয়ন। অবাক করার বিষয় নেপোলিয়নের মৃতদেহটি পচেনি, অথচ তা রাসায়নিক কোন পদার্থ দিয়ে সংরক্ষিতও নয়। মুখাবয়বের সুন্দর ব্রোঞ্জ রঙের চামড়া তখনও অম্লান। নিউট্রন অ্যাকটিভেশন অ্যানালিসি করে চুলের আর্সেনিক পরিমাণ করা হয়। 1961 সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরেন্সিক ডিপার্টমেণ্টে মৃত্যুর আগে স্মৃতি হিসাবে রক্ষিত একগুচ্ছ চুল থেকে কিছু নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা গেল তাতে আর্সেনিকের মাত্রার আধিক্য। গুপ্তহত্যা তত্ত্ব ব্যাপকতা পেল। 1982 সালে বেন ভাইডার ও ডেভিড হ্যাপগুডের বই ‘দি মর্ডার অফ নেপোলিয়ন’ সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিল। তা হলে ব্রিটিশরা নেপোলিয়নকে আর্সেনিক খাইয়ে মেরে ফেলেছিলেন?নেপোলিয়নের চুলে বর্ধিত আর্সেনিকের উপস্থিতির ভিন্নতর ব্যাখাও এসেছে। তাতে দেখানো হয়েছে যে আর্সেনিকে যদি নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তা উদ্দেশ্য মূলক ছিল না, একান্তই অনভিপ্রেত, বন্দি কক্ষের পরিবেশ-দূষণ জনিত দুর্ঘটনা। সম্রাটের কারাকক্ষের দেওয়ালে কপার আর্সেনাইট (প্যারিস গ্রিন) যুক্ত রঞ্জক ছিল। সেণ্ট হেলেনার আর্দ্র উষ্ণ আবহাওয়ায় ছত্রাক জন্মে, যা প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ায় উদ্বায়ী মিথাইল আর্সাইন উত্পন্ন করে, বায়ুবাহিত হয়ে তা সম্রাটের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
অবশেষে 2004 সালে নেপোলিয়ানের মৃত্যু রহস্য পরিষ্কার হল। 1816 সালে সেণ্ট হেলেনা যাবার আগে 1814 ও 1815 সালে রক্ষিত সম্রাটের চুলে আর্সেনিকের পরিমাপ করলেন জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিলেই লিন ও সহকর্মীবৃন্দ। তাতে সর্বাধিক আর্সেনিক পাওয়া গেল। বিশ্বের বিষবিজ্ঞানীরা সবাই একমত হলেন, আর্সেনিকে মৃত্যু হলে 1821 সালের অনেক আগেই নেপোলিয়ানের মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল। একান্ত সন্দেহ বাতিক বা রহস্যপ্রেমী ছাড়া আর সকলেই কাছেই নেপোলিয়নের মৃত্যু রহস্য আজ পরিষ্কার। তাহলে কি গোপনে প্রদত্ত বিষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য বা স্টাইরিয়ার মানুষের মতো কষ্ট সহিষ্ণুতা ( ‘স্ট্যামিনা’ ) বাড়ানোর জন্য নেপোলিয়ন অনেকদিন থেকেই নিয়মিত আর্সেনিক খেতেন? স্টমাক ক্যানসার তো তাতে হতেই পারে।
গোষিওর গবেষণা
দেওয়াল চিত্রের আর্সেনিকঘটিত রঙ থেকে ছত্রাক বিক্রিয়ায় বিষাক্ত আর্সাইন গ্যাস সমূহের উত্পত্তির সম্ভাবনার কথা ইতালীর বিজ্ঞানী গোসিওর গবেষণা থেকে জানা যায়। ঊনিশ শতকের শেষদিকে বেশ কিছু রহস্যজনক অসুস্থতা ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর উত্স সন্ধান করতে গিয়ে গোসিও দেখলেন আর্সেনিক-যুক্ত রঞ্জক দ্রব্যাদির উপর ছত্রাকের বিপাকীয় প্রাণরাসায়নিক ক্রিয়ায় রসুনের গন্ধযুক্ত একটি গ্যাস নির্গত হয়, যাকে গোসিও Et2AsH বলে সনাক্ত করেন। পরে 1945 সালে চ্যালেঞ্জার তা Me3As বলে সঠিক ভাবে সনাক্ত করেন।
অতীত গোয়েন্দা অনুসন্ধানের আর একটি কাহিনী হল ইতালিতে নিযুক্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস ক্লেয়ার বুথ লুসির 1945 সালে অস্বাভাবিক অসুস্থতা। 1975 সালে অতীত গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেল, মিসেস লুসি দূতাবাসের সতেরো শতকের পুরানো যে ঘরে থাকতেন তার ছাদ ও দেওয়াল থেকে লেড আর্সেনেট ঘটিত আস্তরণ ভেঙে ভেঙে পড়ত। মনে করা হচ্ছে আস্তরণের উপরকার আর্সেনিকের উপর ছত্রাকের প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়াজাত আর্সাইনই লুসির অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ।
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder
सम्पर्क
মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Path Alias
/articles/naepaolaiyanaera-martayau-rahasaya-o-gaosaiora-gabaesanaa
Post By: Hindi