সমাজ বিজ্ঞান তার চর্চা শুরু করে সামাজিক উপাদান থেকে। অর্থাত একটি অভিজ্ঞতাবাদী বিজ্ঞান বা Empirical Science স্বামীজী সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ দর্শনের ভিত্তিকে যুক্ত করেছিলেন। এই ভিত্তিটি ছিল তাঁর ধর্ম ভিত্তিক। বিবেকানন্দের পরিবেশ ভাবনা তারই একটি উল্লেখযোগ্য দিক। স্বামীজী তাই বলেছেন – ‘মহান সত্য সরলই হয়, কারণ সেগুলি সর্বজনীন এবং বিশ্বের সর্বত্রই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রকৃতি আমাদের মা। নদী সেই প্রকৃতি মা-এর শরীরের শিরা ও ধমনী।
সার সংক্ষেপঃ
স্বামী বিবেকানন্দের পরিবেশ ভাবনার দর্শন যথেষ্ট স্পষ্ট ও বর্তমান সময়োপযোগী। নদী বিষয়ক ভাবনার জগত-এ বিবেকানন্দ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক ছাপ রেখে গেছেন। বর্তমানে তার প্রত্যেকটি কথাই ধ্রুবসত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দের ভাবধারা আমাদের নতুন পথ দেখাতে পারবে বলেই আমার মনে হয়।
প্রাক কথনঃ
১৯ শতকের শেষ পর্বে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ এক দ্বৈত চরিত্র ও জীবন যাপন করছিল। একপাশে ছিল পাশ্চাত্য ধাঁচের জীবন ও মনন আর অন্য দিকে ছিল সাবেকি গ্রামীন সংস্কৃতিপুষ্ট জীবন ধারা। এক দিকে বিজ্ঞান শিক্ষার স্কুল, বই, ছাপাখানা, কল, রেলপথ আর অন্যদিকে টোল, মাদ্রাসা, বেদ, গীতা, কোরান, বাইবেল, মন্দির, মসজিদ, চার্চ সামন্ত কৃষি অর্থনীতি, গরুরগাড়ী ইত্যাদি। বৃটিশ পীড়িত ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ও রাজনীতি জন্ম দিয়েছিল এই দ্বিবিভাজনের। উনিশ শতকে বাঙালী সমাজের এই যে দ্বিবিভাজন এর একদিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। আর অন্যদিকে রাধাকান্ত দেব, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শশধর তর্কচূড়ামনি, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অবশ্যই শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের মতো মানুষেরা। প্রথম পক্ষ যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মানবতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন সেখানে দ্বিতীয়পক্ষ সুপ্রাচীন হিন্দু ধর্মকে পুনঃজাগরিত করতে চেয়েছেন। ঠিক এই রকম এক পরিকাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দের চিন্তাজগতের আর্বিভাব। বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণাকে সকলের সামনে উপস্থিত করলেন।
সমাজ বিজ্ঞানের দর্শন ও ভাবনাঃ
সমাজ বিজ্ঞান ও সমাজ দর্শন পরস্পর অবশ্যই পৃথক। তবে একে অন্যের পরিপূরক। সমাজ বিজ্ঞান তার চর্চা শুরু করে সামাজিক উপাদান থেকে। অর্থাত একটি অভিজ্ঞতাবাদী বিজ্ঞান বা Emperical Science স্বামীজী সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ দর্শনের ভিত্তিকে যুক্ত করেছিলেন। এই ভিত্তিটি ছিল তাঁর ধর্ম ভিত্তিক। বিবেকানন্দের পরিবেশ ভাবনা তারই একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
স্বামী বিবেকানন্দ গঙ্গা পথে পরিভ্রমন করেছিলেন অনেকবার। এই রকমই কোন এক ভ্রমনের সময় পতিতপাবনী গঙ্গাকে দেখে বলেছেনঃ
“হু, বলি এই বেলা এই গঙ্গা-মার শোভা যা দেখবার দেখে নাও, আর বড় একটা কিছু থাকছে না। দৈত্য দানবের হাতে পড়ে এসব যাবে। এই ঘাসের জায়গায় উঠবেন ইঁটের পাঁজা, আর নামবেন ইঁট খোলার গর্তকুল। যেখানে গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলি ঘাসের সঙ্গে খেলা করছে, সেখানে দাঁড়াবে পাঠ বোঝাই ফ্ল্যাট, আর সেই গাধা-বোট, আর ঐ তাল তমাল আর নিলের রঙ, ঐ নীল আকাশ মেঘের ব্যবহার ওসব কি আর দেখতে পাবে? দেখবে পাথুরে কয়লার ধোঁয়া আর তার মাঝে মাঝে ভূতের মতো অস্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে কলের চিমনি।”
স্বামীজীর এই ভাবনা অর্থাত সমাজ দর্শনটি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একেবারে সত্য। আমরা দেখতে পাই কল্যাণী থেকে ডায়মণ্ড হারবারের মধ্যে ভাগীরথী নদীর দুপাড়ে ৩২৪টি ছোট বড় নালা শহর ও গ্রামের নোংরা জল বয়ে নিয়ে এনে ভাগীরথী নদীতে মিশিয়ে দিচ্ছে। ফারাক্কা থেকে সাগর পর্যন্ত গঙ্গার দু-ধারে গড়ে উঠেছে প্রায় ৭০০টি ইঁট ভাটা।
একথা অনুধাবন করতে হবে যে, বিবেকানন্দ নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক কালের ভারতবর্ষে মূল তাত্পর্য সন্ধান করেছেন। সমান্তরালভাবে ঐ চিন্তাধারাকে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তির আলোকে বুঝে নেওয়া এবং মনুষ্যত্বের সমন্বয় সূত্রে ধারণ করা। সেখানে পরিবেশ তথা নদী ভাবনাটিও যথেষ্ট গুরুত্বের অধিকারী হয়েছে।
স্বামীজী প্রাচীন ভারতের অতীতযুগ সম্বন্ধে বলেছেন – “জম্বু দ্বীপের তামাম সভ্যতা সমতল ক্ষেত্রে, বড় বড় নদীর উপর অতি উর্বর ভূমিতে উত্পন্ন – ইঁয়ং-চি-কিয়ং, গঙ্গা, সিন্ধু ইউরোপীয় তীর। এ সকল সভ্যতারই আদি ভিত্তি হল চাষবাস। এ সকল সভ্যতাই দেবতা প্রধান (সভ্য লোকের প্রাধান্য)। আর ইউরোপের সকল সভ্যতাই প্রায় পাহাড়ে, না হয় সমুদ্রময় দেশে জন্মেছে – ডাকাত আর বোম্বেটে এ সভ্যতার ভিত্তি এতে অসুরভাব অধিক”। অর্থাত দেখতে পাচ্ছি, নদী কেন্দ্রিক সভ্যতার উপর বিবেকানন্দের একটি প্রখর সমাজ বিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
উপসংহারঃ
এ কথা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না বিবেকানন্দ সকল সময়, সকল যুগে প্রাসঙ্গিক। তাঁর নদী ও পরিবেশ ভাবনা তাত্পর্যপূর্ণ। সব থেকে মহান সত্যগুলো বর্তমান কালে বিস্মৃত রয়েছে। স্বামীজী তাই বলেছেন – ‘মহান সত্য সরলই হয়, কারণ সেগুলি সর্বজনীন এবং বিশ্বের সর্বত্রই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রকৃতি আমাদের মা। নদী সেই প্রকৃতি মা-এর শরীরের শিরা ও ধমনী। তাই বিবেকানন্দের ভাবধারায় আমরা আমাদের নতুন পথের আলো দেখতে সক্ষম হব- এ বিশ্বাস আমরা রাখি।’
Source:
From Proceedings of a National Seminar on “Swami Vivekananda: Role Model of Modern India” held on 27th & 28th Nov. 2013. Organized by Teachers’ council, (Philosophy) Raghunathpur College, RAghunathpur Purulia in collaboration with Panchakot Mahavidyalaya, Sarbari, Purulia.
Path Alias
/articles/baibaekaananadaera-nadai-bhaabanaah-eka-samaaja-baijanaanaera-paraekasaapata
Post By: Hindi