1850 থেকে প্রায় 1950 সাল, এই সময়কে তাই আর্সেনিকের সুবর্ণযুগ (!) বলা যায়। তার ফলে এমন দূষণ-বিষণ ঘটে গেছে, যার ধাক্কা উন্নত দেশগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আজও সারিয়ে উঠতে পারে নি। কবে, কীভাবে পারবে তাও বোঝা যায় না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, শিল্পায়ন, কৃষি উত্পাদন ও বর্ধিত পশুপালনে আর্সেনিকের প্রয়োগের জন্য এর উত্পাদন ও ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে উত্তরের উন্নত দেশগুলিতে 1850 থেকে প্রায় 1950 সাল পর্যন্ত। এই সময়কে তাই আর্সেনিকের সুবর্ণযুগ (!) বলা যায়। তার ফলে এমন দূষণ-বিষণ ঘটে গেছে, যার ধাক্কা উন্নত দেশগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আজও সারিয়ে উঠতে পারে নি। কবে, কীভাবে পারবে তাও বোঝা যায় না। আর্সেনিকের সমধিক ব্যবহার হয়েছে ক্ষেতে খামারে, ফল বাগিচায় কীট ও আগাছানাশকে।আর্সেনিকের ব্যবহার
কাঠ সংরক্ষণে ক্রোমটেড কপার আর্সেনেট (CCA) (45-50% CuO, 30-38% As2o5) বহুল ব্যবহৃত। আগাছানাশক হিসাবে নানারকম আর্সেনিক জৈব যৌগ, আর রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতিতে যথেষ্ট আর্সেনিক ব্যবহৃত হয়েছে। অতি সম্প্রতি সেমিকণ্ডাকটর শিল্পে আর্সেনিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আর্সেনিক ধাতুকে অতি বিশুদ্ধ (99.999%) হতে হয়, যা আজও উত্পাদন করে জাপান, জার্মানি ও কানাডা। এটা একটা আশ্চর্য ধাঁধাঁ যে দীর্ঘ বিষাক্ত ইতিহাস জানা সত্ত্বেও জ্ঞাতসারেই আর্সেনিক মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ঢুকে পড়েছিল। ইওরোপের শিল্পীরা আর্সেনিক ঘটিত বহু রঞ্জক দ্রব্য ব্যবহার করতেন, যেমন- কিংস ইয়েলো (As2S3), সিলিস গ্রিন (Scheele’s Green, cuHAsO3), প্যারিস বা এমরেল্ড গ্রিন [Cu(OAc)2] ইত্যাদি।
আর্সেনিক ঘটিত রঞ্জকদ্রব্য ছবি ও দেওয়াল চিত্রে দীর্ঘকাল ধরে ইওরোপে ব্যবহার হয়ে এসেছে। সেসব থেকে অসুখ-বিষুখ ও নানান দুর্ঘটনার ইতিহাস আজ উদঘাটিত।
বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর আর্সেনিক উত্পাদনের (কিছু তথ্য নীচে দেওয়া হল) বৃহত্তম ভোক্তা ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, প্রধানত আগাছানাশক হিসাবে ব্যবহারের জন্য, যা থেকে রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্রও এসেছে ও ভিয়েতনামে. 1960-এর দশকে প্রয়োগ হয়েছে।
বছর | বার্ষিক উত্পাদন (টনে) |
1914 | 10,000 |
1920 | 25,000 |
1931-35 | 53,700 |
1936-40 | 60,940 |
1946-50 | 46,400 |
1956-60 | 48,000 |
1970 | 63,939 |
1980 | 31,000 |
1990 | 47,632 |
চিকিত্সায় আর্সেনিক:
দেড়শো বছরের বেশী সময় ধরে ইওরোপ আমেরিকায় বহুল প্রচলিত টনিক ওষুধ ফাউলারস সলিউশন প্রবর্তন করেন ব্রিটিশ চিকিত্সক টমাস ফাউলার 1786 খ্রিস্টাব্দে। প্রধানত ম্যালেরিয়ার জন্যে হলেও কোনও কোনও চিকিত্সক একে লিউকোমিয়া, সোরাসিস, অ্যাজমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসেও প্রয়োগ করতেন। ফাউলারস সলিউশন ছিল 1% আর্সেনাস অক্সাইড, যে ডোজ খাওয়ানো হত তা ছিল দৈনিক প্রায় 11.4 মিগ্রার সমতুল।
গে’র সলিউশন পরে হল, তাতে থাকত পটাশিয়াম আর্সেনাইট, ডিজিটালিস, পটাশিয়াম আয়োডাইড ও ফেনোবারবিটাল, হাঁপানিতে এর ব্যবহার হত। নানারকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এই দুটি ওষুধেই চোখে পড়ছিল। 1970 এর দশকে এ সবই বন্ধ হয়ে গেল।
1907 সালে পল আর্লিকের সিফিলিসের জন্য স্যালভারসান বা আর্সফেনামিন (Salvarsan or Arsphenamine) চিকিত্সাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর্লিক নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। পরবর্তীকালে আরও ভাল নিও আর্সফেনামিন (Neo arsphenamine) সিফিলিসের জন্য বাজারে এল। তারপর উন্নততর আর্সেনিক্যাল (Trivalent arsenoxide) দিয়ে তারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল। 1930 ও 1940 এর দশকে এল অকসোফেন আর্সাইন (oxophenarsine) ও ডাইক্লোরোফেনার্সাইন (dichlorophenarsine) ।
পেনিসিলিন আসার পর 1940-এর দশক থেকে সিফিলিসে আর্সেনিক ঘটিত ওষুধের বদলে পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধের ব্যবহার শুরু হল।
এর পরেও ট্রিপনোসোমিয়াসিসের জন্য ট্রিপার্সামাইড, অ্যামিবিয়াসিসের জন্য কার্বারসোন কিছুদিন প্রচলিত ছিল (1930-এর দশক থেকে –1960 দশক ) । 1980-এর দশক পর্যন্ত আফ্রিকান ট্রিপানোসোমিয়াসিসের, মেনিজ্ঞোএনকেফালাইটিক জ্বরের জন্য মেলার্সোপ্রোল (melarsoprol) প্রচলিত ছিল।
সম্প্রতিকালে (1997) কঠিন প্রোমাইএলোসাইটিক লিউকেমিয়াতে (acute promyelocytic leukemia) আর্সেনাস অক্সাইড ভাল কাজ করে দেখা যাচ্ছে। শিরায় প্রতিদিন 10 মিগ্রা বা দেহ ওজনের কেজি 0.5 মিগ্রা আর্সেনিক ট্রাই অক্সাইড বেশ কার্যকরি। এ নিয়ে কাজ চলেছে। আর্সেনাস অক্সাইড এখানে ওষুধ কারণ তার ক্ষতি লিউকেমিয়ার ক্ষতির থেকে কম।
ধাতু নিষ্কাষনে নির্গত আর্সেনিক
ঊনিশ শতকে ইংলণ্ডে (প্রধানত কার্নোয়ালে) প্রচুর আর্সেনিক উত্পাদন হত, বাজার সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়। খনিজ উত্তোলন, ধাতু নিষ্কাশন ও শিল্পপ্রযুক্তির সম্প্রসারণে আর্সেনিকের উত্পাদন ও পরিবেশ দূষণ ক্রমাগত বেড়েই গেছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহল ও দায়িত্বশীল মানুষরা উদ্বিগ্ন। আমেরিকার অ্যানাকোণ্ডার তাম্রধাতু নিষ্কাশন ফ্যাক্টরি (Washoe Smelter, Anaconda, Montana) থেকে প্রতিদিন 29,270 পাউণ্ড সাদা আর্সেনিক পরিবেশে ছড়াত। 1902 সাল নাগাদ চাষিরা অভিযোগ করল, বিপুল সংখ্যায় তাদের গোরু, ঘোড়া, ভেড়া অসুস্থ হচ্ছে ও মরছে। রোগ লক্ষণ ডায়রিয়া, অধিক তৃষ্ণা, শীর্ণতা, পঙ্গুত্ব। অ্যানাকোণ্ডার আর্সেনিক দূষণ প্রধানত স্থানীয়। গবেষণা ও অনুসন্ধান অনেক হয়েছে, কিন্তু এখানও পর্যন্ত কোনও সরকারি নীতি গৃহীত হয়নি। পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি নিষেধ কঠিনতর হওয়ায় আমেরিকায় 1985 সাল থেকে আর্সেনিক উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায়, তবু 1990 সালেও আমেরিকা 20,00 টন আর্সেনিক আমদানি করেছিল।
উনিশ শতকের শেষ দিকে পোল্যাণ্ডের এক নদীর জলে স্নান করে বহু মানুষ অসুস্থ হয়। অজ্ঞাত এই রোগ রিকেনস্টাইন ব্যাধি নামে খ্যাত হয়। অনুসন্ধানে জানা যায় সাইলোসিয়ার রিকেনস্টাইনে স্বর্ণখনি থেকে নির্গত আর্সেনিক ঐ ব্যাধির কারণ। অনুরূপ আর একটি আর্সেনিক “হটস্পট” আফ্রিকার ঘানা। এখানকার ওবুয়াসি অঞ্চলের স্বর্ণখনিজাত আর্সেনিক পানীয় জলে আসে (
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Path Alias
/articles/arasaenaika-baisanaera-saubaranayauga
Post By: Hindi