আর্সেনিক আন্দোলনের গোড়ার কথা


1995 সালের প্রথম দিকে স্কুল অফ এনভায়রমেণ্টাল স্টাডিজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক আর্সেনিক সম্মেলন এর ব্যবস্থা করেন। এই সম্মেলনে দেশ বিদেশের বহু আর্সেনিক বিজ্ঞানীর সমাগম হয়। এখানে আর্সেনিক অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্য তিনদিনের ক্ষেত্র ভ্রমণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। 20টি দেশের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গুরুত্ব পায়। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকারও বিষয়টিকে স্বীকার করেন এবং গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন।

পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক বিষণ নিয়ে সংবাদপত্রসমূহ বিপুল আন্দোলন সৃষ্টি করে। 1995 সালের প্রথম দিকে স্কুল অফ এনভায়রমেণ্টাল স্টাডিজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক আর্সেনিক সম্মেলন এর ব্যবস্থা করেন। এই সম্মেলনে দেশ বিদেশের বহু আর্সেনিক বিজ্ঞানীর সমাগম হয়। এখানে আর্সেনিক অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্য তিনদিনের ক্ষেত্র ভ্রমণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। 20টি দেশের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যা এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গুরুত্ব পায়। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকারও বিষয়টিকে স্বীকার করেন এবং গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন। এরপর একাদিক্রমে আরও বিশ্বসম্মেলন হয় ঢাকায়, সানদিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়ায়।

1995-96 সালেও কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কলকাতার পানীয় জলে আর্সেনিকের আধিক্য স্বীকার করেনি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার গুরুতর আর্সেনিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য ভারত সরকারের কাছে 750 কোটি টাকা (প্রায় 200 মিলিয়ন) দাবি করলেন। তাঁরা বললেন:

“আমরা মনে করি 40 লক্ষ মানুষ তিনটি জেলাতে গুরুতর ভাবে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন”।

1996 সালে কলকাতার কিছু অঞ্চলে আর্সেনিক বিষণের ঘটনাও খবরে প্রকাশিত হল। 1997 সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা সরকারের উদ্যোগহীনতা ও ঢিলেমির সমালোচনা করলেন।

বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে আর্সেনিক রোগ প্রথম ধরা পড়ল কলকাতায়, 1993 সালে। পশ্চিমবাংলার সীমান্তের কাছে চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে চিকিত্সার জন্যে একজন আর্সেনিক রোগীকে আনা হয়েছিল কলকাতার পি জি হাসপাতালে। তারপর বাংলাদেশে আর্সেনিকের অনুসন্ধান যতই বেড়েছে, ততই সমস্যার ভয়াবহ ব্যাপকতায় বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়েছে। 1985 থেকে 1995 সালের মধ্যে অন্তত আশি লক্ষ থেকে এক কোটি (বা আরো বেশি) নলকূপ বসানো হয়েছে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভের (BGS) তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশের চাঁদপুর, পাবনার চর রুপ্পুর, চাপাই নবাবগঞ্জের ভূগর্ভজলে আর্সেনিক পৃথিবীর রেকর্ড। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রতি 15 মিনিটে একজন করে আর্সেনিকে মারা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে অবিরাম অনিবার্য গতিতে আর্সেনিকের সংক্রমণ ঘটে চলেছে। আর্সেনিকের নামে দেশ বিদেশ থেকে অনেক অর্থ সাহায্য আসছে। বহু বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে সেই টাকার অনেকটাই গিয়ে পড়ছে। যথারীতি তার সদ্ব্যয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক সংশয়, অনেক বিতর্ক। গ্রামাঞ্চলের আক্রান্ত মানুষজন অসহায় ভাবে মরছেই।

2001 সালে বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর আর্সেনিক দূষণের জন্য BGS - কে কিছুটা দায়ী করে লণ্ডনের হাইকোর্টে কিছু বাংলাদেশী মামলা দায়ের করেছিল। অভিযোগ BGS – এর তদারকিতে 1980 -এর দশকে স্থাপিত নলকূপের জলে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়নি। সেই পানের অযোগ্য জল ব্যবহার না করার প্রয়োজনীয় সতর্কতার কথাও কোন রকম উল্লেখ করেননি। সুতরাং বাদী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের গণবিষণের জন্য BGS - কে দায়ী করে ক্ষতিপূরণের মামলা চালাচ্ছিলেন। তবে ঘটনা হল যে 2004 - এর ফেব্রুয়ারিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের রায়ে BGS রেহাই পেয়ে গেল। রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশে নলকূপ খননে BGS - এর ঐ অঞ্চলের মানুষদের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা (“duty of care”) ছিল না ( GII ) ।

ব্রিটেনে নলকূপ বসানোর সময় (1989) কিন্তু BGS জলে আর্সেনিকের মাত্রা ঐ সময়েই পরীক্ষা করে বসিয়েছিলেন। BGS অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 1995 সালের আগে পলিমাটি অঞ্চলের ভূগর্ভজলে আর্সেনিক থাকার সম্ভাবনার কথা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাহিত্যে ছিল না। তাঁদের এই বক্তব্য যে ধোপে টেকে না তা দীপঙ্কর চক্রবর্তী দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, 1992 সালের আগে 1978 সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক আর্সেনিক বিজ্ঞান সাহিত্যে অন্ততঃ পাঁচটি পেপারের অস্তিত্ব আছে। নেচার পত্রিকায় মৃদুভাবে বলা হয়েছে যে, BGS- এর কিছুটা দায়িত্ব মানা উচিত। এতে দুই বাংলার দুই সরকারের দায়িত্ববোধ কিছুটা হয়তো জাগ্রত হবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড উইলসন তাঁর বিখ্যাত আর্সেনিক ওয়েবসাইটে BGS- কে “দুর্বিনীত” আখ্যা দিয়েছেন।

1996 সালে ভিয়েতনামের হ্যানয় অঞ্চলে কাজ করার সময় BGS আবারও জলে আর্সেনিক পরীক্ষা করলেন না। ফলে ভিয়েতনামের লোহিত নদী অববাহিকায় কয়েক লক্ষ মানুষ পানীয় জল বাহিত আর্সেনিক আক্রান্ত হলেন। 1997 - 98 সালে BGS বাংলাদেশের ভূগর্ভ জল সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধান করে চমত্কার প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের ২০০৪ সালের মানব উন্নয়ন রির্পোটে ( Development and planning Dept., Govt. of W B) লেখা হয়েছে : 1982 সালে পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক বিষণ আবিষ্কারের পর 8টি জেলায় 75টি ব্লকে আর্সেনিক রোগ ধরা পড়েছে যাতে আক্রান্ত 1 কোটি 35 লক্ষ মানুষ (13.5 মিলিয়ন)। ভূগর্ভ জলের এই আর্সেনিকের উত্স ভূতাত্ত্বিক। শুধু জল থেকে আর্সেনিক দূরীকরণ বা জলের ভিন্নতর উত্স-এ যাওয়াই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয় না, কারণ আর্সেনিক যে এখন খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। গবাদি পশুদের ভিতর আর্সেনিক সংক্রমণ অত্যন্ত গুরুতর এবং তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

মণীন্দ্র নারায়ণ মজুমদার
প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder.

Path Alias

/articles/arasaenaika-anadaolanaera-gaodaara-kathaa

Post By: Hindi
×