তথ্যসূত্র : পধারো মাহরে দেশ


কোনো এক সময় মরুভূমিতে ঢেউ তোলা হাকড়োর শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা, রাজস্থানের হৃদয় ‘পলক দরিয়াব’ -এর মতোই গ্রহণ করে l ঢেউ তোলা হাকড়োর সময় বা কালের বোধের ব্যাপকতাকে আমাদের স্মৃতির সাহায্যেই বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে l এই কাল দর্শনে আমাদের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনকে এক দিব্য দিন ধরা হয়েছে l তিনশো দিব্য দিনে হয় এক দিব্য বর্ষ l সত্য যুগের সময় সীমা বলা হয়েছে চার হাজার আটশো (4,800) দিব্য বছর, তিন হাজার ছশো (3,600) দিব্য বছরে হল ত্রেতা যুগ, আর দ্বাপর দু হাজার চারশো (2,400) বছরের এবং কলিযুগের সময় সীমা ধার্য করা হয়েছে এক হাজার দুশো (1,200) দিব্য বছর l এই হিসেবকে যদি আমাদের বছরে বদলানো যায় তাহলে সত্য যুগের সময় সীমা দাঁড়াবে সতেরো লক্ষ আঠাশ হাজার (17,28,000) বছর, ত্রেতা যুগ হবে বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই (12,96,000) হাজার বছর, আর দ্বাপর আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার (8,64,000) বছর এবং কলিযুগ দাঁড়াবে চার লক্ষ বত্রিশ হাজারে (4,32,000) l শ্রীকৃষ্ণকে আমরা পাই দ্বাপরে l যখন তিনি হাকড়ো ক্ষেত্রে এসেছিলেন তখনও মরুভূমি ছিল l অর্থাত পলক দরিয়ারের ঘটনা তার থেকেও আগে কখনও ঘটেছিল l একটা গল্প এই ঘটনাকে ত্রেতা যুগ পর্যন্ত নিয়ে যায় – শ্রীরামচন্দ্রের শ্রীলঙ্কা আক্রমণ। মাঝে সমুদ্র রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। রামচন্দ্র তিন দিন উপবাসের পর পুজো করেন l এই প্রার্থনার পরও রাস্তা না পেয়ে রামচন্দ্র ধনুকে বাণ চড়ান, সমুদ্রের জল শুকিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সমুদ্র দেবতা প্রকট হন, ক্ষমা প্রর্থনা করেন; কিন্তু বাণ তো ধনুকে চড়ানো হয়ে গিয়েছিল, তার কী হবে ? কথিত আছে সমুদ্রের পরামর্শেই বাণ সেই দিকে ছোঁড়া হয় যেদিকে হাকড়ো ছিল l এভাবেই ত্রেতা যুগে হাকড়ো শুকিয়ে যায় l

সমুদ্রের ধারের জমিকে ফার্সিতে বলে ‘শীখ’ l বর্তমান মরুভূমির এক অংশ হল শেখাওটি l বলা হয় - কখনও এই পর্যন্ত সমুদ্র ছিল l হকীম য়ুসূফ ঝুঁঝুনওয়জির বই ‘ঝুঁঝুনূঁ কা ইতিহাস’ -এ এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে l জয়সলমেরের পুরোনো নথিতেও হাকড়ো শব্দ স্থান পেয়েছে l দেবীসিংহ মাণ্ডওয়া -র বই ‘শার্দুলসিংহ সেখাওত’, শ্রী পরমেশ্বর সোলাঙ্কির -র বই ‘মরুপ্রদেশকা ইতিবৃত্তাত্মক বিবেচন’ (প্রথম খণ্ড), বই দুটিও এখানে যে সমুদ্র ছিল সে বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়ে থাকে l এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলিও এর আরও একটি প্রমাণ l তাছাড়াও রয়েছে জনসাধারণের মনে ভেসে বেড়ানো নামগুলি এবং তার সঙ্গে যুক্ত লোকগাথাগুলি l

পুরোন ডিঙ্গল ভাষায় সমার্থক শব্দের বিভিন্ন অভিধানে ঢেউয়ের মতই সমুদ্রের নাম পাওয়া যায় l অধ্যায়ে এগারোটি নাম দেওয়া হয়েছে, পাঠক ইচ্ছে করলে সেখানে এগুলিও জুড়ে নিতে পারেন :

সনুন্দ্রা কুমার অঁবধি সরিতাঁপতি ( অখ্যঁ )
পরাওয়ারাঁ পরঠি উদধি ( ফির ) জলনিধি ( দখ্যঁ ) l
সিন্ধু সাগর ( নাঁম ) জাদপতি জলপতি ( জপ্পঁ ),
রতনাকর ( ফির রটহু ) খীরদধি লওয়ন ( সুপপ্পঁ ) l
( জিল ধাঁম নাঁম জজাঁল জে সটমিট জায় সঁসার রা,
তিণ পর পাজাঁ বঁধিয়াঁ ও তিণ নাঁমাঁ তার রা ) l

এই নামগুলি কবি হররাজের রচিত ডিঙ্গল নামমালা থেকে নেওয়া হয়েছেl কবি নাগরাজ পিঙ্গল, তার ‘নাগরাজ ডিঙ্গল’ অভিধানে সমুদ্রের নামগুলি এই ভাবে বর্ণনা করেছেন :

উদধ অঁব অঁথাগ অচ উধারণ অলিয়ল,
মহণ ( মীন ) মহরাঁণ কমল হিলোহল ওয়্যাকুল l
বেলাওল ওহিলোল ওয়ার ব্রহমণ্ড নিধুওয়র,
অকুপার অণথাগ সমন্দ দধ সাগর সায়র l
অতরহ অমোধ চড়তও অলীল বোহত অতেরুডুবওণ,
( কব কবত ওহ পিঙ্গল কহৈবীস নাঁম ) সামন্দ (তণ ) l l

কবি হমীরদান রতনু রচিত ‘হমির নামমালায়’, সমুদ্রের নামের মালায় আরও কয়েকটি নতুন নাম জুড়ে দেন :

মথণ মহণ দধ উদধ মহোদর,
রেণয়র সাগর মহরাঁণ
রতনাগর অরণও লহরীরও,
গৈডীরও দরীআও গম্ভীর l
পারাওয়ার উধধিপত মছপতি,
(অথগ অম্বহর অচল অতীর) l l
পতিজল পদমালয়াপিত l
সরসওয়ান সমান্দ,
মহাসর অকূপার উদভব - অম্রতি l l

এর পরও যে দু’ চারটে নাম এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে যায় কবিরাজ মুরারিদান সেগুলি একত্রিত করেছেন :

সায়র মহরাণ স্রোতপত সাগর দধ রতনাগর মগণ দধী,
সমন্দ পয়োধর বারধ সিন্ধু নদীঈসবর বানরথী l
সর দরিয়াব পয়োনধ সমদয় লখমীতাত জলধ লওয়ণোদ,
হীলোহল জলপতী বারহর পারাওয়ার ওদধ পাথোদ l
সরতঅধীস মগরঘর সরবর অরণও মহাকচ্ছ অকুপার,
কলব্রছপতা পয়ধ মকরাকর ( ভাখাঁ ফির ) সফরীভণ্ডার l l

জলের থেকে বেরিয়ে আসা মরুভূমির হৃদয় এই ভাবে সমুদ্রের এত নাম এখনও স্মরণে রেখেছে এবং সেই সঙ্গে তারা এটাও বিশ্বাস করে যে মরুভূমি আবার এক দিন সমুদ্রে পরিণত হবে :

হক কর বহসে হাকড়ো বন্ধ তুট সে অরোড়
সিন্ধড়ি সুখো জাওসী, নির্ধনিয়ো রে ধন হোওসী
উজড়া খেড়া ফির বসসী, ভাগিয়ে রে ভূত কমাওসী
ইক দিন এয়সা আওসী l

হাকড়ো পরবর্তী সময় সমুদ্র থেকে দরিয়াব, দরিয়াব থেকে দরিয়া অর্থাত নদী হয়ে যায় l এই এলাকারই লুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাচীন নদী সরস্বতীর সঙ্গে তখন হাকড়োকে এক করে দেখা হত l আজ এই এলাকায় মিষ্টি ভূ - জলের ভাণ্ডার যথেষ্ট ভাল বলে স্বীকৃত হয়েছে l আর একে ঐ নদীগুলিরই চুঁইয়ে আসা জল বলে মনে করা হয় l রাজস্থানের সীমানা পার করে পাকিস্তানের সখখর জেলাতে অরোড় নামক স্থানে একটা বাঁধ রয়েছে; একদিন এমন আসবে যেদিন বাঁধটি ভেঙে যাবে l সিন্ধু শুকিয়ে যাবে, ভর-ভরন্ত গ্রামগুলি উজাড় হয়ে যাবে, উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রামগুলি আবার ফিরে বসতি স্থাপন করবে, ধনী নির্ধন হবে, নির্ধন ধনী হবে একদিন এমনই আসবে l

হাকড়োর প্রারম্ভিক তথ্য ও রাজস্থানীতে সমুদ্রের কিছু নাম আমরা পাই শ্রীবদরীপ্রসাদ সাকরিয়া ও শ্রীভূপতিরাম সাকারিয়া সম্পাদিত ‘রাজস্থানী হিন্দি শব্দকোষ’, পঞ্চশীল প্রকাশন জয়পুর থেকে l তবে আমাদের এটি ঠিকঠাক বোধগম্য হয় শ্রী দীনদয়াল ওঝা ( কেলাপাড়া জয়সলমের ) এবং শ্রী জেঠু সিং ভাটি ( সিলাওটপাড়া জয়সলমের ) -র সঙ্গে হওয়া কথা বার্তায় l ‘ইক দিন এয়সা আওসী’ সময়ের অপেক্ষায় গাওয়া এই গাঁথাটিও শ্রী জেঠু সিং -এর কাছেই পাই l ডিঙ্গল ভাষায় সমুদ্রের নামগুলি পাই, নারায়ণ সিং ভাটি সম্পাদিত রাজস্থানী গবেষণা কেন্দ্র চৌপাসনি, যোধপুর থেকে 1957 সালে প্রকাশিত ডিঙ্গল কোষ থেকে l রাজ্যের বর্ষার পরিসংখ্যান রাজস্থানি গ্রন্থাগার যোধপুর থেকে প্রকাশিত শ্রী ইরফান মেহর -এর বই ‘রাজস্থান কা ভূগোল’ থেকে পাই l রাজস্থানের বিভিন্ন জেলায় গড় বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানটি নিম্নরূপ l

 

জেলা

গড় বৃষ্টিপাত (সে.মি)

জেলা

গড় বৃষ্টিপাত (সে.মি)

জয়সলমের

16.40

আলওর

61.13

শ্রীনগর

25.37

টৌঁক

61.36

বিকানের

26.37

উদয়পুর

62.45

বাড়মের

27.75

সিরোহি

63.84

যোধপুর

31.87

ভরতপুর

67.15

চুরু

32.55

ধোলপুর

68.00

নাগৌর

38.86

সওয়াইমাধোপুর

68.92

জালৌর

42.16

ভিলওয়াড়া

60.90

ঝুঁঝনু

44.45

ডুঙ্গরপুর

76.15

সিকর

46.61

বুঁদি

76.41

পালি

49.04

কোটা

88.92

আজমের

52.73

বাঁসওয়াড়া

92.24

জয়পুর

54.82

ঝালওয়াড়া

104.47

চিতোরগড়

58.21

  

নতুন জেলাগুলির পরিসংখ্যন পাওয়া যায় নি l

 

সারা বছরে মাত্র 16.40 সেণ্টিমিটার বৃষ্টি হয় যে জয়সেলমেরে সেই জয়সলমের দীর্ঘ সময় ইরান, আফগানিস্থান থেকে রাশিয়া পর্যন্ত ব্যাবসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল l আর এই ব্যাবসায়িক কারণে জয়সলমেরের ছবি পৃথিবীর মানচিত্রে কত উজ্জ্বল ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় – ‘জয়সলমের খাদি গ্রামোদ্যোগ পরিষদ’ ভাণ্ডারের দেওয়ালে টাঙানো এক মানচিত্রে l তখন কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজের নাম গন্ধও ছিল না l

মরুনায়ক শ্রীকৃষ্ণর মরু যাত্রা ও বরদানের বিষয়টি, আমরা প্রথম দেখি শ্রী নারায়ণ পাল শর্মা -র বইতে l

থর রাজ্যের পুরোনো নামে মরুমেদনী, মরুধন্ব, মরুকান্তার, মরুধর, মরুমণ্ডল এবং মারও-এর মতো নাম অমর কোষ, মহাভারত, প্রবন্ধ চিন্তামণি, হিতোপদেশ, নীতিশতক, বাল্মীকি রামায়ণ প্রভৃতি সংস্কৃত বই গুলিতে পাওয়া যায় এবং এগুলি মরুভূমির অর্থে কম বরং নির্মল এক অঞ্চল হিসেবেই বেশি অর্থে এসেছে l

মাটি, জল ও তাপের তপস্যা


মেঁঢক ও বাদলের প্রসঙ্গ সব জায়গাতেই পাওয়া যায় l তবে এখানে ডেডরিয়া, মেঁঢক মেঘ দেখে শুধু ডর্র ডর্র -ই করে না l সে মনে মনে পালর পানি সংগ্রহ করে রাখার সেই বাসনাই পোষণ করে যে বাসনা আমরা সমস্ত রাজস্থানের হৃদয়েই দেখতে পাই l আর এই যে মেঁঢক, যাকে মনে হয় সাধারণ, যে দেখতেও সাধারণ, সে কত জল ধরে রাখতে চায় ? এতটাই, যেন পুকুরের নেষ্টা অর্থাত অপরা অর্ধেক রাত বয়ে চলে l পুকুর কানায় কানায় ভরে ওঠে l

ডেডরিয়োর তৃতীয় লাইন গাইবার সময়, তলাই শব্দটির বদলে বাচ্চারা নিজেদের পাড়ার বা গ্রামের পুকুরের নাম বসিয়ে নেয় l কোন জায়গায় দ্বিতীয় লাইন গাওয়ার সময়ও, পালর পানি ভঁরু-ভঁরু-র বদলে, মেঁঢক ঠালা ঠিকর ভঁরু-ভঁরু গাওয়া হয় l

ডেডরিয়োর প্রসঙ্গে তথ্যগুলি আমরা জয়সলমেরের শ্রী জেঠু সিং ভাটির কাছে পাই l এতে আরও কিছু সংযোজন করেন জয়সলমেরেরই শ্রীদীনদয়াল ওঝা - মেঘ ঘন হয়ে এলে ছোটরা বেরিয়ে পড়ে ডেডরিয়ো গাইতে l বড়রা তখন মাটির পাত্রে গুগরি চড়ায় l জল ও হাওয়ার উদ্দেশে অর্ঘ্য অর্পণ করে গুগরি চারি দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় l এভাবে বর্ষার অভিমান ভাঙানো হয় l অর্থাত বর্ষা যদি কোনো কারণে রুষ্ট হয়ে থাকে, তাই তাকে প্রসন্ন করার জন্য অর্ঘ্য l খালি মাথায় সারতে হয় এই অনুষ্ঠান l অনুষ্ঠানের সময় পাপড়ি নিসিদ্ধ l জল দেবতাকে বোঝাতে হবে তো যে, তারা দুখী, সন্তপ্ত l শোকাচ্ছন্ন ভক্তদের প্রসন্ন করতে নিজের রাগ অভিমান ভুলে বর্ষাকে নেমে আসতেই হয় l

কোথাও কোথাও ‘আখা তিজ’, অর্থাত অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চারটে ছোট ছোট গোল মাটির পাত্র তৈরি করে ভূমির ওপর রাখা হয় l চারটি পাত্রকে - জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এই চার মাসের প্রতীক মনে করা হয় l এবার পাত্রগুলি জলপূর্ণ করা হয় l কৌতূহলী দৃষ্টি অপেক্ষা করে কোন পাত্রটির মাটি প্রথমে গলছে ( দ্রব্য হওয়া ) যদি জ্যৈষ্ঠরটি প্রথমে গলে তাহলে বর্ষা যেমন হয় তেমনই হবে বলে মনে করা হয়, আষাঢ়েরটা গললে খণ্ডিত বর্ষা, আর শ্রাবণ বা ভাদ্ররটা যদি প্রথমে গলে তাহলে বৃষ্টি হবে প্রচুর l

আধুনিক মানুষদের কাছে চার মাসের এই চারটি পাত্র টোটকা হতে পারে কিন্তু এখানকার পুরোনো লোকেরা আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যত্বাণীকেও টোটকার থেকে বেশি কিছু মনে করে না l

বর্ষা কালে বিদ্যুতের ঝলকানি, মেঘের গর্জনের ধ্বনি ও আলোর গতির সঠিক স্বভাবটি সমাজ পর্যবেক্ষণ করে এসেছে : ‘তিস কেসরি গাজ, শ কেসরি খৈন’ l অর্থাত বজ্রপাতে মেঘের গর্জন তিরিশ ক্রোশ যায় কিন্তু তার বিদ্যুতের চমক একশো ক্রোশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে l শব্দ ও আলোর এই তফাতের নিয়ম আমরা জানতে পারি জেঠু সিং -এর কাছে l

রাজ্যের বিস্তার, ক্ষেত্রফল প্রভৃতি পরিসংখ্যানগুলির জন্য ইরফান মেহরের বই ‘রাজস্থান কে ভূগোল’ -এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে l এতে নতুন জেলাগুলিও অবশ্য যোগ করা হয়েছে l রাজস্থানের ভূগোলের আধুনিক বর্গীকরণ ও মৌসুমীবাযুর বিস্তৃত পরিচয়ও এই বইটি থেকেই নেওয়া হয়েছে l

লবণাক্ত জমির পরিচয় আমরা প্রথম পাই সাম্ভর এলাকায় গিয়ে l সাম্ভর এলাকা পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারি তিলেনিয়া, আজমের স্থিত সোশ্যাল ওয়ার্ক এণ্ড রিসার্চ সেণ্টারের সাথী শ্রী লক্ষী নারায়ণ, শ্রী লক্ষণ সিংহ ও শ্রীমতী রতন দেবীর সৌজন্যে l বিকানেরের লুনকরসর তো নামেই লবণ যুক্ত রয়েছে l এই এলাকাটিকে বুঝে নিতে আমাদের সাহায্য করেছে উরমুল ট্রাস্ট; যারা ওখানে কাজ করছে l

এই অধ্যায়ের তাপের সঙ্গে সম্পর্কিত অংশ পিথ, জলকুণ্ডি, মাছলো ও ভডলি পুরাণ-এর প্রারম্ভিক সূচনা শ্রী বদরিপ্রসাদ সাকরিয়া ও শ্রী ভূপতিরাম সাকরিয়ার ‘রাজস্থানি শব্দকোষ’ থেকে পাওয়া গেছে l বর্ষাসূচক চাঁদের ‘উভো’ অথবা ‘সুতো’ স্থিতি আমাদের বুঝিয়েছেন শ্রী দীনদয়াল ওঝা ও শ্রী জেঠু সিং l ‘ডঙ্ক-ভডলি’ পুরাণে বর্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য কয়েকটি প্রবাদ হল : -

মঙ্গসর তনি অষ্টমি, বাদলি, বিজ হোয় l
সাঁওন বরষে ভডলি, সাখ সওয়াই জোয় l l

যদি মার্গশীর্ষের ( অগ্রহায়ণ মাস ) কৃষ্ণা অষ্টমী -তে মেঘ ও বিদ্যুত দুইই থাকে তাহলে শ্রাবণে বর্ষা হবে এবং ফসল সাধারণ ভাবে যা হয় তার এক চতুর্থাংশ বেশি হবে l

মিগসর বদ ওয়া সুদ মঁহি, অধৈ পোহ উরে l
ধংওয়ারা ধুঁধ সমায়ে দে ( তৌ ) সমিয়ৌ হোয় সিরে l l

যদি অগ্রহায়ণের প্রথম বা দ্বিতীয় পক্ষে অথবা পৌষের প্রথম পক্ষে সকালে কুয়াশা হয় তাহলে বর্ষা ভাল হবে :
পৌষ আধাঁরি দশমি, চমকৈ বাদল বীজ l
তৌর ভর বরষৈ ভাদবৌ, সায়ধন খলৈ তিজ l l

যদি পৌষ কৃষ্ণা দশমীর বৃষ্টিতে বিদ্যুত চমকায়, তাহলে পুরো ভাদ্র ভর বৃষ্টি হবে l এবং স্ত্রীরা তিজ উত্সব ভালভাবেই করতে পারবে :
পোহ সবিভল পোখজৈ, চৈত নিরমল চঁন্দ l
ডঙ্ক কহ হে ভডড, মন হুঁতা অন চন্দ l l

যদি পৌষে ঘন মেঘ দেখা যায় ও চৈত্রের শুক্ল পক্ষে চাঁদ স্বচ্ছ দেখা যায়, অর্থাত আকাশে মেঘ না থাকে তাহলে আনাজ টাকা মন-এর থেকেও সস্তা হবে :
ফাগন ওয়দি সু দুজ দিন, বাদল হোয়ে বিজ l
বরষে শাঁওন ভাদয়ৌ, সাজন খেলৌ তিজ l

lযদি ফাল্গুন কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার দিন বৃষ্টি না হয়, বিদ্যুত না চমকায় তাহলে শ্রাবণ ও ভাদ্রে ভালো বর্ষা হবে l অতএব হে স্বামী, তিজ ভালোভাবে পালন করো l

বৃষ্টি যেখানে সব থেকে কম, সেখানে বৃষ্টির সব থেকে বেশি নাম পাওয়া যায় l এই লম্বা তালিকায় প্রায় চল্লিশটি নামের প্রথম ঝাপটা আমরা ‘রাজস্থানি-হিন্দি শব্দকোষ’ -এর সাহায্যে করতে পেরেছি l বিভিন্ন ডিঙ্গল শব্দকোষ থেকে আরও কিছু নাম এতে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে l কবি নাগরাজের ‘ডিঙ্গলকোষ’ মেঘের নাম গুণে থাকে নিম্ন রূপে :

পাওয়স প্রথবিপাল বসু হব্র বৈকুষ্ঠবাসী,
মহিরঞ্জণ অম্ব মেঘ ইলম গাজিতে – আকাসী l
নৈণে – সঘণ নভরাট ধ্রওয়ন পিঙ্গল ধরাধর,
জগজীবন জীমূত জলঢ় জলমণ্ডল জলহর l
জলওয়হণ অভ্র বরসন সুজল মহত কলায়ন(সুহামনা), পাস্জন্য মুদির
পালগ ভরণ ( তীস নাম ) নীরদ ( তণা ) l l
শ্রী হামিরদান রতনু বিরচিত ‘হামির নামমালা’ -য় মেঘের নামের যে ছটা পাওয়া যায় তা –
পাওয়স মুদর বকাহক পালগ,
ধরাধর ( ওয়ালি ) জলধরন l
মেঘ জলদ, জলবহ জলমণ্ড,
ঘন জগজীবন ঘণাঘণ l l
তড়াতওয়ান তোঈদ তনয়ন্তু,
নীরদ ওয়ারসন ভরন – নিওয়ান l
অভ্র পরজন নভরাট আকাসি,
কাঁমুক জলমুক মহত কিলাঁণ
( কোটি সঘন সোভা তন কাঁন্থড়,
স্যাঁম ত্রেভূঅণ স্যাম সরীব l
লোক মান্থি জম জোর ন লাগৈ,
হাথি জোড়ি হরি সমর হমীর ) l l

শ্রী উদয়রাম বারহঠ বিরচিত ‘অবধান-মালা’ -তে বাকি নামগুলি সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে এই ভাবে :
ধারাধর ঘণ জলধরণ মেঘ জলদ জলমণ্ড,
নীরদ বরসণ ভরণনদ পাওয়স ঘটা ( প্রচণ্ড )l
তড়িতওয়ান তোয়দ তরজ নিরঝর ভরণনিওয়াণ,
মুদর বলাহক পালমহি জলদ ( ঘণা ) ঘণ ( জাঁণ )l
জগজীওয়ন অভ্রয় রজন ( হু ) কাম কহমত কিলাঁণ,
তনুয়তু নভরাট ( তব ) জলমুক গয়ণী ( জা, ণ ) l l
ডিঙ্গল অভিধানের অন্য এক তালিকায়, যেখানে কবির নাম পাওয়া যায় না, সেখানে বৃষ্টির আরও কিছু নাম পাওয়া যায় : -
মেঘ জলদ নীরদঁ জলমণ্ডণ,
ঘণ বরষণ নভরাট ঘণঘণ l
মহত কিলাণঁ আকাসী জলমুক,
ধারাধর পাওস অভ্র জলভুর,
পরজন l তড়িতওয়াঁন তোয়দ ( পর ) সঘণ তনয় ( তু ) স্যমঘটা ( সজি ),
গঁজণরোর নিওয়াঁণভর গজি l

কবিরাজ মুরাদিদানের রচিত তালিকাও ঘন কালো মেধের মতোই ছেয়ে রয়েছে l তবে এখানে এসেও আমরা দাঁড়াতে পারি :
মেঘ ঘনাঘন ঘণ মুদির জীমুত ( র ) জলওয়াহ,
অভ্র বলাহক জলদ ( অখ ) নমধুজ ধূমজ ( নাহ ) l l

ডিঙ্গল অভিধানের এই তথ্য আমরা পাই শ্রী নারায়ণ সিংহ ভাটি সম্পাদিত, রাজস্থানি গবেষণা কেন্দ্র চৌপাসনি, যোধপুর থেকে 1957- তে প্রকাশিত ‘ডিঙ্গল অভিধান’ -এ l বৃষ্টির স্বভাব, রঙ্গ, রূপ, তাকে এক দিক থেকে অন্য দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, কোনো পাহাড়ের ওপর তার একটুখানি বিশ্রাম করে নেওয়া প্রভৃতির প্রারম্ভিক তথ্য রাজস্থানী হিন্দি অভিধান থেকে নেওয়া হয়েছে l

আজকের জমানাতেও আমরা ‘জামানো’ শব্দটির অর্থ ঠিক - ঠাক ভাবে বুঝতে পারি, জনসত্তার সম্পাদক শ্রী ওমথানবি -র কাছে l তাঁর ঠিকানা হল – 186 বি, ইণ্ডাসট্রিয়াল এরিয়া, চণ্ডীগড় l শ্রী থানবি 1987 সালে – ‘সেণ্টার ফর সায়েন্স এণ্ড এনভায়রনমেণ্ট’, নতুন দিল্লি -র একটি ফেলোসিপে রাজস্থানের জল সংগ্রহ বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লেখেন এবং সেই ঐতিহ্যের দৃষ্টান্তগুলি তুলে ধরার জন্য কিছু ছবিও তোলেন l জ্যৈষ্ঠর প্রশংসায় গোয়ালাদের গান, এবং মাসেদের পারস্পরিক কথাবার্তায় জ্যৈষ্ঠের শ্রেষ্ঠতার গল্প, বৃষ্টির ক্রিয়া কলাপ তুঠনো থেকে শুরু করে উবরেলো অর্থাত বর্ষার জল সংগৃহীত করার পুরো প্রক্রিয়াটি আমরা বুঝতে পারি ‘রাজস্থানি-হিন্দি শব্দকোষ’ থেকে l

রাজস্থানের রজতবিন্দু


সত্যি সত্যি কুঁই জিনিসটা যে কী সেটা খানিকটা বুঝতেই আমাদের ‘নেতি নেতি’ -র মতোই সাত, আট বছর লেগে গেছে এবং তা স্বীকার করতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংকোচ হচ্ছে না l প্রথমবার কুঁই দেখি 1988 সালে চুরু জেলার তারানগর এলাকায় l কিন্তু কুঁই কীভাবে তার কাজ করে যায়, নোনতা জলের মাঝে দাঁড়িয়েও কীভাবে মিষ্টি জল দেয় – এর প্রাথমিক পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম প্রৌঢ় শিক্ষণ সমিতির এক গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আসা গ্রামীণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে হওয়া কথাবর্তায় l বাড়মেরে যে পারগুলি তৈরি হয়েছে সেগুলির পরিচয় আমরা পাই সেখানকার নেহেরু যুবক কেন্দ্রের কার্যনির্বাহক শ্রী ভুবনেশ জৈন -এর কাছে l

শ্রী কিশান বর্মা কোনো এক সময় নিজেই গজধর ছিলেন l তিনিই আমাদের বুঝিয়েছেন চেজারো ও চেলওয়াজিদের কাজের সূক্ষ্মতা ও কঠিনতা l কুঁই খোঁড়ার সময় ভেতরে হাওয়ার অভাব দূর করতে জোরে জোরে মুঠোভর্তি বালি ছোঁড়া এবং খিঁপ দড়ি দিয়ে কুঁইকে বাঁধার আশ্চর্যজনক নিয়মও তিনিই আমাদের বলেন l শ্রী বর্মার ঠিকানা, 1, গোল্ডেন পার্ক, রামপুরা, দিল্লি 35 l

জয়সলমেরের শ্রী জেঠু সিং ভাটিয়া সঙ্গে পত্রালাপে এবং পরে জয়সলমেরে তার সঙ্গে আলাপচারিতায় আমরা বুঝতে পারি কুঁই ও রেজানি পানির শাশ্বত সমন্ধের বিষয়টি l ‘বিটটু রো বিল্লিয়ো’ -র কারণ এই রেজানি পানি ঠিক মতো সঞ্চিত থাকে l বিটটু মুলতানি মাটি বা মেট, ছোট ছোট কাঁকর, অর্থাত মুরডিওর সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি এক প্রকার স্তর l এতে জল আর্দ্ররূপে অনেকদিন পর্যন্ত কোথাও কোথাও এক-দু বছর পর্যন্ত টিঁকে থাকে l খড়িয়া পাথরের স্তরও এই একই কাজ করে কিন্তু এতে জল অত দীর্ঘ দিন পর্যন্ত টিঁকে থাকে না l বিটটুর ঠিক বিপরীত হল ‘ধীয়ে রো বিল্লিয়ো’ l এতে জল স্থির হতে পারে না এবং তাই এই এলাকায় রেজানি পানি সংগ্রহ করা যায় না আর তাই এখানে কুঁইও তৈরি করা যায় না l

সাঁপণী ও লরা দিয়ে পার বাঁধাইয়ের তথ্যও আমরা ওনার কাছেই পাই l জয়সলমের থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে ‘খড়েরো কী ঢাণি’ গ্রামে পালিওয়ালদের ছয় বিশী ( একশো কুড়ি ) পারগুলিকে বুঝতে পারি শ্রী জেঠু সিং এবং ঐ গ্রামেরই শ্রী চৈনারামজির সঙ্গে যাবার সময়; কিন্তু পারগুলি আজ বেশিরভাগই বালির তলায় চাপা পড়ে গেছে l আরও একটি গ্রাম হল ছঁতারগড় l এখানে পালিওয়ালদের সময়ের তিনশোরও বেশি কুঁই -এর অবশিষ্টাংশ এখনও পাওয়া যায় l অনেকগুলি পারেই এখনও জল রয়েছে l ‘খড়েরো কী ঢাণি’ -র মতো অনেক গ্রামেই আজ নতুন বসানো টিউবওয়েল পাওয়া যাচ্ছে l ষাট কিলোমিটার দূর থেকে পাইপলাইনে জল আসছে l টিউবওয়েল যেখানে খোঁড়া হয়েছে সেখানে ইলেকট্রিক নেই l ডিজেল ব্যবহার হচ্ছে l আবার ডিজেল আসছে ট্যাংকারে করে দূর কোনো জায়গা থেকে l কখনও ট্যাংকারের ড্রাইভার ছুটি নেয়, কখনও পাম্প যে চালায় সে l কখনও ডিজেল পাওয়া যায় না, আবার পাওয়া গেলে তা চুরিও হয় l কখনো রাস্তায় পাইপ লাইন ফেটে যায় l এই রকম বহু কারনেই এই সমস্ত গ্রামগুলিতে জল পৌঁছায় না l নতুন তৈরি জলের টাঙ্কিগুলি খালি পড়ে থাকে গ্রামের লোক পারগুলি থেকেই জল নেয় l

জল দেওয়ার এইরকম সরকারি পরিষেবা যেসমস্ত গ্রামগুলিতে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলির নিয়মিত খবর রাখা দরকার রাজস্থানের সংস্থাগুলির ও খবর কাগজগুলির l নতুন মাধ্যমে জল আসছে, কী পরিমাণে আসছে, তা প্রচার হওয়া প্রয়োজন l তাহলেই বোঝা যাবে যে, যে পদ্ধতিগুলিকে আধুনিক বলা হচ্ছে সেগুলি মরুভূমিতে কতটা পিছিয়ে পড়া বলে প্রমাণিত হচ্ছে l

ইন্দ্রিরা গান্ধী নহরের আওতায় আনা হয়েছে যে গ্রামগুলিকে সেগুলিরও হাল একইরকম হতে চলেছে l এর আগে এ গ্রামগুলি কুঁই থেকেই তাদের পানীয় জল পেত l চুরু জেলার বুচাওয়াসা গ্রামে প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি কুঁই ছিল l সন্ধেবেলা একসঙ্গে সারা গ্রাম এখানে জমা হত জল নেওয়ার জন্য l যেন মেলা লেগে যেত l এখন নতুন পদ্ধতিতে দূর থেকে পাইপলাইনে বয়ে জল সিমেণ্টের এক বড় গোল ট্যাংকে আসে l তার চারদিকে নল লাগানো l এই নতুন ব্যবস্থায় মেলা নয়, ভীড় লেগে যায় l ঝগড়া হয় l কলসি ভাঙ্গে l ট্যাংকে প্রতিদিন জল আসে না l কখনও কখনও তো সপ্তাহ দু-সপ্তাহে এক, দু-বারই জল আসে l তাই জল নেওয়ার জন্য হুড়ো - হুড়ি লেগে যায় l গ্রামের মাস্টারমশাই-এর বক্তব্য হল যদি প্রতিদিনের গড় নির্ণয় করা যায় তাহলে দেখা যাবে, সম্ভবত ততটাই জল পাওয়া যায়, যতটা বিনা ঝগড়ার কুঁইয়ে পাওয়া যেত l এর মাঝে নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু কুঁই আবার ঠিকঠাক করা হচ্ছে l

কুঁইগুলি সত্যি সত্যি স্বয়ংসিদ্ধ ও সময়সিদ্ধ প্রতিপন্ন হচ্ছে l

থেমে থাকা জল নির্মল


প্রবাহিত জলকে সঞ্চয় করে সারাবছর নির্মল করে রাখতে পারে যে কুণ্ডিগুলি, সেগুলি আমরা আমার প্রথম দেখি 1988 সালে সেণ্টার ফর সায়েন্স এণ্ড এনভায়মনমেণ্টের শ্রীঅনিল আগ্রওয়াল এবং সুশ্রী সুনীতা নারায়ণের সঙ্গে দিল্লী থেকে বিকানের যাওয়ার পথে l কুঁইয়ের মতো এগুলিকেও বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে l

কুণ্ডি শব্দ কুণ্ড থেকে এবং কুণ্ড, যজ্ঞকুণ্ড থেকে এসেছে বলে মনে করা হয় l জয়সলমের জেলাতে অনেক পুরোনো বৈশাখী কুণ্ডও আছে l যেখানে আশপাশের অনেক বড় এলাকা থেকে মানুষ অস্থি বিসর্জন দিতে আসে l বলা হয় বৈশাখী পূর্ণিমায় স্বয়ং গঙ্গা এখানে বিরাজিত হন l এই লোককথাগুলি কুণ্ডের জলের নির্মলতা ও পবিত্রতারই পরিচয় দেয় l

কুণ্ড তৈরির প্রথা কত পুরোনো তা সঠিক বলা যায় না l বিকানের -জয়সলমের এলাকায় দুশো, তিনশো বছরেরও পুরোনো কুণ্ড, টাঁকা পাওয়া যায় l নতুন পদ্ধতির হ্যাণ্ড পাম্পগুলিকেও সচল রেখেছে এমন কুণ্ডও চুরু এলাকায় অনেক আছে l কুণ্ডিগুলির সময়সিদ্ধ - সমাজসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যটি আমাদের বুঝিয়ে ছিলেন জনসত্তা, দিল্লির শ্রী সুধীর জৈন l

বিকানের জেলার সীমানার মধ্যে পাকিস্তানের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জালওয়ালি গ্রামের ফোগের ডাল দিয়ে তৈরি কুণ্ডিগুলি আমরা দেখতে পাই শ্রী ওম থানবি ও রাজস্থান গো সেবা সঙ্ঘের শ্রী ভম্বরলাল কোঠারিজি -র সৌজন্যে l কুণ্ডিগুলিকে সাদা রং করার কারণ এবং রহস্যও আমাদের বোঝান শ্রী ওম থানবি l

খড়িয়া পাথর দিয়ে তৈরি কুণ্ডগুলি বিকানের ও জয়সলমেরের সংযোগকারী রাস্তার ওপর মাঝে মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে l বজ্জু এলাকাতেও আমরা এই ধরনের কুণ্ড দেখি, উরমূল ট্রাস্টের শ্রী অরবিন্দ ওঝার সঙ্গে যাবার সময় l রাজস্থানের গো সেবা সঙ্ঘের শ্রী জগদীশজি -র সঙ্গে যাবার সময় আমরা রামগড় এলাকায় দেখতে পাই শিল্প হয়ে ওঠা বারান্দার মতো কুণ্ডিগুলি l এই কিছুদিন আগে জয়সলমের একটা সম্পূর্ণ নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছে ‘কবীর বস্তি’ l এই গ্রামটিতে প্রতিটি ঘরের সামনে এই রকম কুণ্ডি তৈরি করা হয়েছে l এই তথ্য আমরা পাই জয়সলমের গ্রামোদয় পরিষদের শ্রী রাজু প্রজাপত -এর কাছে l শ্রী ওম থানবির সৌজন্যে, যোধপুরের ফলৌদি শহরে, ছাত ও উঠোনের আগৌর জুড়ে দ্বিগুণ জল সংগৃহীত হওয়া টাঁকাগুলি আমরা দেখতে পাই l চুররোর জল যত্ন সহকারে গ্রহণ করে যে টাঁকাগুলি, সেগুলির পরিচয় আমাদের দেন শ্রী জেঠু সিং ভাটি l জয়সলমেরের নরসিংহ ঢাণির ( আট, দশটা গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট গ্রাম )র কাছাকাছি এই রকম একটি টাঁকা তৈরি করেন শ্রী সন্তোষপুরী নামের এক সাধু l সন্ন্যাস নেওয়ার আগে ইনি পশু চরাতেন l এই এলাকার বৃষ্টির জলকে তিনি বয়ে যেতে দেখেছেন l তাই সাধু হওয়ার পর তিনি মনে করেন এই জল ব্যবহার হওয়া দরকার l তিনি যে কাজ শেষ করে যেতে পারেননি তাঁর শিষ্যরা এখন তা করছে l সংসার ছেড়ে দেওয়া সন্ন্যাসী জলের কাজকে কত আধ্যাত্মিকভাবে নিজের করে নিয়েছেন তার বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যেতে পারে শ্রী জেঠু সিং -এর কাছে l

জয়গড় কেল্লার প্রাথমিক তথ্য আমরা পাই, জয়পুর শহরের সংগ্রহশালায় লাগানো একটা বিজ্ঞাপন থেকে l ঐ বিজ্ঞাপনটিতে এটিকে বিশ্বের সব থেকে বড় টাঁকা বলা হয়েছিল l পরে আমরা ‘চাকুস’ -র সংস্থা এগ্রোএক্সন -এর শ্রী শরদ জোশীর সঙ্গে এখানে যাই l এবং তার কাছেই প্রারম্ভিক তথ্য পাই l সব থেকে বড় এই টাঁকাটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল এই রকম l

জয়গড় পাহাড়ের ওপর চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে টাঁকাটির আগৌর l পাহাড়ের ওপর বর্ধিত সমস্ত জল টুকুই ছোট বড় নালাগুলি দিয়ে বয়ে দুর্গের প্রাচীর পর্যন্ত আসে l নালাগুলির ঢালও এমনভাবে করা হয়েছিল যে জল যেন আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে l এতে জলের সঙ্গে বয়ে আসা মাটি তলায় পড়ে থেকে যায় l নালার রাস্তাতেও কয়েকটা ছোট ছোট কুণ্ড করা রয়েছে l এখানেও মাটি ফেলে জল পরিষ্কার হয়ে প্রধান টাঁকার দিকে এগিয়ে চলে l

জরুরি অবস্থার সময় অর্থাত 1975-76 সালে সরকার এই টাঁকাতে জয়পুর রাজবংশের লুকোনো খাজানার খোঁজে প্রচুর খোঁড়াখুঁড়ি করে l এই খোঁড়াখুঁড়ি কয়েক মাস ধরে চলেছিল l তিনটি টাঁকারই আশপাশে খোঁড়া হয় l টাঁকার সমস্ত জল বড় পাম্প লাগিয়ে তুলে ফেলা হয় l

আয়কর বিভাগ কোন খাজনা পাক বা না পাক চারিদিকে খোঁড়া খুঁড়ির ফলে বর্ষার জল সংগ্রহের এই অদ্ভুত খাজনাটি কিছু ভেঙে-টেঙে যায় l তবুও যে প্রায় চারশো বছরের পুরোনো টাঁকাটি এই বিচিত্র অভিযানের ধাক্কা সামলে উঠে এখনও নিজের কাজ করে চলেছে এতে তার দৃঢ়তাই প্রমাণিত হয় l

এই টাঁকা অভিযান ও খোঁড়াখুঁড়ির বিস্তৃত তথ্য আর এস খঙ্গরোত ও পি.এস নাথাওত-এর লেখা ইংরেজি বই ‘জয়গড় দা ইনবিংসিবল ফোর্ট অফ আমের’-এ পাওয়া যেতে পারে l প্রকাশক আর,বি.এস পরিসাস, এস.এম.এস হাইওয়ে, জয়পুর l

রাজস্থানে রজত বিন্দুর মতো চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা এই টাঁকা, কুণ্ডি, কুঁই, পার ও পুকুরগুলি সমাজের যে সেবা করেছে, পানীয় জলের যে জোগান দিয়েছে, আজ আমরা হিসেব করে সেই মূল্য নির্ধারণ করতে পারব না l

কোন কেন্দ্রিয় পরিকাঠামোর পক্ষে এই কাজ সম্পুর্ণ করা সম্ভব নয়, যদি কিছুটা সম্ভবও হয় তাহলে তাতে খরচা হবে কয়েক কোটি টাকা l রাজস্থান সরকারের জনস্বাস্থ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ মাঝে মধ্যে এখানে ওখানে পানীয় জলের পরিকল্পনা তৈরির জন্য কাগজে টেণ্ডার নোটিস দিয়ে থাকে l 1994 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লি জনসত্তা দৈনিকে প্রকাশিত এইরকম এক টেণ্ডার নোটিসে বাড়মের জেলার শিব, পচপদরা, চৌহটন, বাড়মের এবং সিওয়ানা তহসিল নিয়ে মোট দুশো পঞ্চাশটি গ্রামে জলপ্রকল্প তৈরি করতে আনুমানিক লগ্নি চল্লিশ কোটি টাকা বলা হয়েছে l এই টেণ্ডারে বিকানের জেলার বারোটি তহসিলে প্রায় ছশো গ্রামে কাজের জন্য ছিয়ানব্বই কোটি টাকা লাগবে l

এরই সঙ্গে 1994 -এর ফেব্রুয়ারিতে রাজস্থানের খবরের কাগজে প্রকাশিত টেণ্ডারের খবরটিও লক্ষ করার মত l এটি যোধপুর জেলার ফলৌদি ক্ষেত্রে এই বিভাগের পক্ষ থেকেই পঁচিশ হাজার লিটার থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার লিটার জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ভূতল জলাশয়’ অর্থাত অন্য কোনো জায়গা থেকে জল এনে জমা করার ট্যাংক তৈরি করার পরিকল্পনা l এতে আনুমানিক খরচা পড়ছে তেতাল্লিশ হাজার থেকে ছিয়াশি হাজার টাকা l এতে এক লিটার জল জমা রাখতে খরচা পড়বে প্রায় দু -টাকা l এছাড়াও জল অন্য কোনখান থেকে আনতে হবে, তার খরচা আলাদা l এই কাজ ফলৌদির তেরোটা গ্রামে হবে l মোট খরচ প্রায় নয় লক্ষ টাকা l এবার কল্পনা করুন রাজস্থানের সমাজের সেই অংশটির কথা, যারা বিজ্ঞাপন, টেণ্ডার, খবর, ঠিকাদার ছাড়াই নিজেদের ক্ষমতাবলে প্রায় ত্রিশ হাজার গ্রামে নির্মল জলের জোগান দিতে পারত l

বিন্দুতে সিন্ধু


এই অধ্যায়ের বেশির ভাগটুকুই ‘আজ ভি খরে হ্যায় তালাব’ বইয়ের ‘মরীচিকাকে মিথ্যা করে পুকুর’-এই অধ্যায় থেকে নেওয়া l পুকুর কীভাবে তৈরি হয়, কারা পুকুর তৈরি করে, পুকুরের আকার প্রাকর ও তার বিভিন্ন প্রকার নাম, সেই ঐতিহ্য যা পুকুরগুলিকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রেখেছিল প্রভৃতি অনেক কথাই ‘গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান’ থেকে ছাপা এই বইয়ে বলা হয়েছে l যাদের এই বিষয়ে আগ্রহ আছে তারা ঐ বইটিও উল্টে দেখতে পারেন l বইটির বাংলা অনুবাদও হয়েছে – ‘আজও পুকুর আমাদের’ -এই নামে l প্রকাশক – ‘আশাবরী’, নেতাজি সুভাষ রোড, পুরুলিয়া 732102 l

পুকুরের সব থেকে বড় কুটুমের সব থেকে ছোট ও প্রিয় সদস্য ‘নাডি’ -র প্রারম্ভিক তথ্য আমরা পাই মরুভূমি বিজ্ঞান বিদ্যালয় -এর নির্দেশক শ্রীসুরেন্দ্রমল মোহনত -এর কাছে l ইনি যোধপুর শহরে জল সংগ্রহের উন্নত ঐতিহ্যের ওপর কাজ করেছেন l তার এই অধ্যয়ন থেকে জানতে পারা যায়, শহরেও নাডি তৈরি হোতো l যোধপুরে এখনও কিছু নাডি আছে এবং এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : জোধার নাডি, 1520 সালে তৈরি গোল নাডি, গণেশ নাডি, শ্যামগড় নাডি, নরসিংহ নাডি ও ভূতনাথ নাডি l

সাম্বর ঝিলের আগৌরের চারদিকে নোনতা জমির মাঝে মিষ্টি জলের তলাই আমরা দেখি এবং সেটিকে বুঝতে পারি প্রযত্ন নামক সংস্থার শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ ও ‘সোস্যাল ওয়ার্ক এণ্ড রিসার্চ সেণ্টার’ -এর শ্রীমতী রতনদেবী তথা শ্রী লক্ষ্মণসিংহ -এর সঙ্গের যাত্রায় l এদের ঠিকানা হল : প্রযত্ন, গ্রাম - শোলাওয়াতা, পোঃ - শ্রীরামপুরা, ওয়রাস্তা নরৈনা, জয়পুর এবং স্যোশাল ওয়ার্ক এণ্ড রিসার্চ সেণ্টার, তিলোনিয়া, ওয়রাস্তা মদনগজ্ঞ, আজমের l

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন প্রনয়ণকারী সমাজ সংস্কারক শ্রী হরবিলাস শারদা তার একটি বই ‘আজমের : হিস্টোরিকাল এণ্ড ডেসক্রিপ্টিভ’ -এ আজমের, তারাগড়, অন্নসাগর, বিসলগর, পুষ্কর প্রভৃতির ওপর বিস্তারিত লিখেছেন l 1933 সালের অক্টোবর মাসে আজমেরে, অখিল ভারতীয় স্বদেশী শিল্প প্রদর্শনী হয় l শ্রী হরবিলাস -ই ছিলেন প্রর্দশনী সমিতির অধ্যক্ষ l কিছু মানুষ এটা জেনে আশ্চর্য হতে পারন যে, এই বিষয়ের ওপর প্রদর্শনীতেও আজমেরের অন্নসাগর নামক পুকুরের ওপর বিশদ তথ্য দেওয়া হয়েছিল l

এই এলাকাতেই জল ও গোচারণ ভূমি নিয়ে কাজ করছেন শ্রী লক্ষ্মণসিংহ রাজপুত l এঁর কাছেই আমরা এখানকার প্রায় সব গ্রামে বাঞ্জারাদের তৈরি তলাইগুলির তথ্য পাই এবং তার সঙ্গের যাত্রাতেই এগুলি আমরা দেখতেও পাই l এখানে এগুলিকে দণ্ড-তলাই বলে l এই সব তলাইগুলির কিনারে বাঞ্জারাদের দণ্ড অর্থাত স্তম্ভ লাগানো রয়েছে l এই জন্যই সম্ভবত এগুলিকে এই নামে স্মরণ রাখা হয়েছে l শ্রী লক্ষণসিংহ এই রকম তলাইগুলির ভাঙা ভাঙি সারানোর অভিযান চালাচ্ছেন l ওঁর ঠিকানা হল : গ্রামবিকাশ নবযুবক মণ্ডল, গ্রাম - লাপোডিয়া, বরাস্তা দুদু, জয়পুর l

জয়সলমের, বাড়মের ও বিকানের -এর পরিসংখ্যানগুলি আমরা পাই জেলা গেজেটিয়ার ও 1981 সালের জনগণনার রিপোর্ট থেকে l এতেই আমরা মরুভূমির সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখি যা সমস্ত পরিকল্পনাকারীর মনে ছেয়ে রয়েছে l

শ্রী নারায়ণ শর্মার বই ‘জয়সলমের’ থেকে আমরা জয়সলমেরের পুকুরগুলির প্রারম্ভিক তালিকা পাই l এই বইটির প্রকাশক হল : গোয়েল ব্রাদার্স, সুরজ পোল, উদয়পুর l এর পর প্রতিবারই এই তালিকায় আরও দু-চারটে নাম যোগ হয়েছে l আজও আমরা একথা জোর করে বলতে পারি না যে শহরের পূর্ণ তথ্য বা তালিকা আমরা দিতে পেরেছি l মরুভূমির এই বৃহত ও সুন্দর শহরটিতে প্রতি কাজের জন্যই পুকুর তৈরি হয়েছে l বড় পশুদের জন্য তো ছিলই, বাছুরগুলোর জন্যও আলাদা পুকুর ছিল l বাছুরগুলোকে বড় পশুদের সঙ্গে দূরে চরতে পাঠান হত না l তাই এদের জন্য শহরের কাছাকাছিই পুকুর তৈরি হত l একটা জায়গায় তিনটে তলাই একসঙ্গে ছিল l এই জায়গাটার নামই হয়ে গিয়েছিল তিনতলাই l আজ এগুলিকে বুঝিয়ে দিয়ে তার ওপর ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে রয়েছে l

জয়সলমেরের পুকুরগুলিকে বুঝতে আমরা ভীষণভাবে সাহায্য পেয়েছি শ্রীভ গবানদাস মহেশ্বরী, শ্রী দীনদয়াল ওঝা ও শ্রী ওম থানবি -র কাছে l ওঝাজি ও ভাটিজি সত্যি সত্যি আমাদের আঙুলে ধরে এগুলির সূক্ষ্মতা বুঝিয়েছেন l

ঘড়সিসর, গড়সিসর, গড়িসর – নাম ঘর্ষিত হয়ে চলেছে l ঘর্ষিত হতে হতে ঝক ঝক করছে l এই পুকুর মানুষের মনে সাঁতরে চলেছে l তার অনেক নাম তার অনেক রূপ l এটি জয়সলমেরের গর্বের কারণ আবার অহংকারেরও l কেউ যদি এখানে এমন কোনো বড় কাজ করে ফেলে যা হয়তো তার সামর্থের বাইরে তাহলে সেই কাজের কৃতিত্ব কর্তার বদলে ঘড়সিসরকে অর্পণ করার প্রচলন এখানে দেখা যায়, ঘড়সিসরে মুখ ধুয়ে এসেছো কি? আবার যদি কেউ বড় বড় বুলি দেয় তাহলে তাকে খনিকটা নামিয়ে আনার জন্য কেউ হয়তো বলে বসল, যা, ঘড়সিসরে জলে একবার মুখ ধুয়ে আয় l

মানুষ ঘড়সিসর ও তার প্রস্তুতকারক মহারাওয়ল ঘড়সিকে আজও এতটা সম্মান করে যে, যে কোনো প্রসঙ্গেই অনেক দূর থেকে মানুষ এখানে আসে নারকেল ফাটানোর জন্য l ঘড়সির সমাধি পাড়ে কোথায় আছে তা তাঁর বংশধরেরা ভুলে যেতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের তা জানা আছে l বলা হয় স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত শহরে যথেষ্ট অনুশাসন ছিল ঘড়সিসর ব্যবহারের ক্ষেত্রে l একটি বিশেষ দিন বাদ দিলে এই পুকুরে সাঁতার দেওয়া, স্নান করা বারণ ছিল l কেবল প্রথম বর্ষায় এখানে সকলের স্নানের ছাড় ছিল l বাকি সারা বছর আনন্দের একটা অংশ, স্নান ও সাঁতার -কে আটকে রাখা হত l

আনন্দের এই সরোবরে সমাজ নিজের উচ্চ নীচ ভেদাভেদও ভুলে যায় l দূরে কোথাও মেঘ সাজতে শুরু করেছে, এটা দেখেই মেঘওয়াল পরিবারের মহিলারা নিজেরাই ঘড়সিসরের পাড়ে চলে আসত এবং ইন্দ্রদেবকে খুশি করতে মঙ্গলগীত গাইত l না জানি কাকে কাকে খুশি করতে দেবরাজ ইন্দ্র অপ্সরাদের পাঠিয়েছিলেন এ নিয়ে অনেক গল্পই প্রচলিত আছে l কিন্তু ঘড়সিসরে খুশি করা হত স্বয়ং ইন্দ্রকে l মেঘরাওয়ল পরিবারের স্ত্রীরা এই কাজের জন্য পয়সা নিত না l কেউ তাদের এই কাজের জন্য পারিশ্রমিক বা পুরস্কার দেওয়ার সাহসও করত না l স্বয়ং মহারাওল এই কাজের জন্য তাদের প্রসাদ দিতেন l প্রসাদে থাকত পাঁচ কিলো গম ও গুড় l এগুলিও সবই পাড়েই ভাগ করে দেওয়া হত l

ঘড়সিসরে কোথা কোথা থেকে কত জল আসে তা বুঝে উঠতে পারা এক কঠিন কাজ l বালির প্রতিটি কণা যাতে আটকে যায় এবং জলের প্রতিটি বিন্দু যাতে পুকুরের দিকে বয়ে আসতে পারে, তার জন্য কয়েক মাইল লম্বা আল ( যাতে জল একদিকে বহিত হয়ে আসে ) বানানো হয়েছিল l আর পুকুরের নীচে তৈরি করা হয়েছিল অনেকগুলি কুয়ো l কোন এক সময় এই কুয়োগুলোর পর্যন্ত প্রশংসাতেও রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ও ফার্সি কবিতা l এখন দূর থেকে পাইপে করে জল এনে ঘড়সিসরে ফেলা হয় l পাইপগুলি ভেঙে গিয়েছিল, তবে এই বিবরণ লেখার সময়ই খবর পেলাম যে পাইপগুলি সারানো হয়েছে এবং ঘড়সিসরে আবার নহরের জল আসছে। তবে পাইপ লাইনের কোনো ভরসা নেই, লেখার সময় যে পাইপ ঠিক করানো হল, পড়ার সময় তা আবার ভেঙেও যেতে পারে l

‘বাপ’ -এর পুকুরগুলি দেখতে পাই বিকানের -এর সংস্থা ‘উরমূল ট্রাস্ট’ -এর শ্রী অরবিন্দ ওঝার সাহায্যে এবং গল্পটি পাই ওস্তাদ নিজামুদ্দিনের কাছে l ওনার ঠিকানা হল : বাল ভবন, কোটলা রোড, নতুন দিল্লি l

শ্রী জেঠু সিং ভাটির কাছে আমরা জসেরির যশের কথা শুনি এবং ভাটিজির সৌজন্যেই আমরা সেটা দেখতেও পাই l অন্যান্য জায়গায় দেখা যায় পুকুর শুকিয়ে গেলেও তার আশপাশের কুয়োগুলোতে জল থাকে কিন্তু এখানে আশপাশের কুয়ো শুকিয়ে যায়, কিন্তু জসেরিতে জল থাকে l এখানে কাছেই বন দপ্তরের একটা নার্সারি আছে গরমের দিনে তাদের নিজেদের জলের যে ব্যবস্থা তা যখন জবাব দেয়, তখন জসেরির জলেই তারা এই চারাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে l

জসেরির জন্য মানুষের মনে অদ্ভুত এক ভালোবাসা রয়েছে l শ্রীচৈনারাম, জাতিতে ভিল l তার জীবিকা হল উটের পিঠে বা জিপে চড়িয়ে পর্যটকদের ঘোরানো, কিন্তু জসেরি যাওয়ার সুযোগ পেলে সে যে কোনো কাজ ছাড়তে রাজি l ভাঙাচোরা জসেরিকে কীভাবে ঠিক করা যায় সে ব্যাপারে সে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছে, তবে এই সব পরিকল্পনা কোনো কাগজে নয়, সবই আঁকা রয়েছে তার মনে l গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান হায়দরাবাদও গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান, নতুন দিল্লি জসেরির একটি সুন্দর পোস্টার প্রকাশিত করেছে l

জল ও অন্নের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক


শ্রীকিরণ নাহটা এবং জয়সলমের খাদি গ্রামোদ্যোগ পরিষদের শ্রী রাজু প্রজাপত -এর সঙ্গে, জয়সলমেরে পালিওয়ালদের ছেড়ে দেওয়া গ্রামগুলিতে ঘোরার সময় আমরা খডিন সম্পর্কিত প্রারম্ভিক তথ্য পাই l পরে পানি মার্চ- এর শ্রী অরুণ কুমার ও শ্রী শুভু পটওয়ার এতে আরও কিছু তথ্য যোগ করেন l বয়োজ্যেষ্ঠ গান্ধীবাদী শ্রী ভগবানদাস মহেশ্বরী জয়সলমেরের কিছু প্রসিদ্ধ খডিনের ছবি পাঠান l এরপর বিস্তৃতভাবে এই বিষয়টি বোঝার সুযোগ হয় শ্রী দীনদয়াল ওঝা, শ্রী জেঠু সিং ও জয়সলমের জেলা খাদি গ্রামোদয় পরিষদের শ্রী চৌইথমল -এর সঙ্গে যাবার সময় l

যোধপুরের গ্রামীণ বিজ্ঞান সমিতি -র পক্ষ থেকে নতুন খডিন তৈরির কাজ হয়েছে l ঠিকানা হল : পোঃ - জেলু গগাড়ি l যোধপুর l

জ্ঞানী ও সোজা সরল গোয়ালার সঙ্গে যে কথোপকথন তা আমরা জানতে পারি শ্রী জেঠু সিং -এর কাছে l পূর্ণ সংবাদটি হল :
সুরজ রো তো তপ ভালো, নদী রো তো জল ভলো
ভাঈ রো তো বল ভলো, গায় রো তো দুধ ভলো
চারোঁ বাতোঁ ভলে ভাই, চারোঁ বাতোঁ ভলে ভাই
সূর্যের তাপ ভালো, নদীর জল, ভাইয়ের বল ভালো এবং গাইয়ের দুধ l এই চার ভালই হয় l

গোয়াল উত্তর দেয় :
আখঁ রো তো তপ ভালো, করাখ রো তো জল ভলো
বাহু রো তো বল ভলো, মা রো তো দুধ ভলো
চাঁরো বাতোঁ ভলে ভাই, চারোঁ বাতোঁ ভলে ভাই
তপস্যা হল চোখের, অর্থাত অনুভবই কাজে লাগে l পানি ‘করাখ’ অর্থাত কাঁধের ওপর ঝোলানো কুঁজোর জল l নিজের বাহুবল-ই কাজে আসে এবং দুধ ? মায়ের দুধের কোন তুলনা হয় না রে ভাই l

আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানীরা বলবেন বর্ষার পরিস্থিতি অনুযায়ী গোটা মরুভূমিই গম চাষের উপযুক্ত নয় l যারা খডিন তৈরি করেছিল এটা তাদেরই চমত্কারিত্ব বলতে হবে যে কয়েকশো বছর আগে থেকে তারা কয়েকশো মণ গম কেটে চলেছে l পলিওয়াল ব্রাহ্মণদের জন্যই জয়সলমের রাজ্য আনাজ ও ভুসিতে সমৃদ্ধ হয়েছিল l

দইবাধ বা দেবিবাঁধ-এর পরিচয় আমাদের দেন শ্রী জেঠু সিং ও শ্রী ভগবানদাস মহেশ্বরী l ঐ এলাকায় প্রকৃতি দেবী যতগুলি এইরকম স্থান তৈরি করেছেন তার মধ্যে এমন কোনো জায়গা নেই যেটি সমাজ চোখের তপস্যায় দেখতে পায়নি l এই অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এখানে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে l শিক্ষিত সমাজ যদি পড়তে না পারে, সে কথা আলাদা l

ভুনের বারো মাস


ইন্দ্রের এক মুহূর্তকে নিজেদের জন্য বারমাসে বদলে ফেলে যে সমাজ, সেই সমাজের একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই বিকানেরের ভিনসর গ্রামে গোচরভূমিতে তৈরি রামসাগর নামক সাঠি কুয়োটিতে l এখানে আমরা পৌঁছাই শ্রী শুভু পাটওয়ার সৌজন্যে l

ভুন ও ইন্দ্রের সমন্ধটি আমাদের বোঝান শ্রী জেঠু সিং l দেখতে পাওয়া যায় না যে পানি, অর্থাত ভূ- জল, তাকে দেখতে বা অনুভব করতে পারে যে সিরবি এবং এত গভীর কুয়ো খোঁড়ে যে কিনিয়ারা তাদের পরিচয় আমরা পাই শ্রী দীনদয়াল ওঝার কাছে l ফাঁক খোঁড়ার রহস্য আমাদের বোঝান শ্রী কিসান বর্মা l বারিক পলেস্তরার কথাও তিনিই আমাদের বলেন l

বাউড়ি, পগবাও এবং ঝলরাগুলির বিষয়ে এই অধ্যায়ে আলাদা করে কিছু দেওয়া যায়নি l কিন্তু কুয়োর মতো এগুলিরও এক অতি বৃহত ঐতিহ্য আছে l এমনিতে তো বাউড়ি দিল্লির কনট প্লেসে পর্যন্ত পাওয়া যাবে, কিন্তু দেশের মানচিত্রে এর একটা বিশেষ অঞ্চল রয়েছে l এই অঞ্চলটা পড়ে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে l

রাজস্থানের এই বৈভব আমাদের প্রথম দেখান চাকসুর শরদ জোশি l ওনার সঙ্গেই আমরা টোঁক জেলার টোডা রায়সিংহ বাউড়িটি দেখতে যাই l এই বাউড়িটির সিঁড়িতে চড়েই আমরা অনুভব করতে পারি বিস্মিত হওয়া কাকে বলে l বইয়ের প্রচ্ছদটি করা হয়েছে এই বাউড়িটির ছবি দিয়েই l গান্ধী শান্তি কেন্দ্র হায়দরাবাদ এবং গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠান দিল্লি এই ছবিটি একটি পোষ্টারের মতো করে ছেপেছে l রাজস্থানের অনেক জায়গাতেই তৈরি, যা এখন প্রায় সব জায়গাতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেই বাউড়িগুলির পরিচয় আমাদের দেন শ্রী শরদ জোশি l রাষ্ট্রদূত সাপ্তাহিকের 1998 -এর 18 জুনের সংখ্যায় অশোক আত্রেয় রাজস্থানের বাউড়িগুলির একটি লম্বা সূচি দিয়েছেন l রাষ্ট্রদূত সাপ্তাহিকের ঠিকানা হল : সুধর্মা, এম.আই. রোড জয়পুর l

চড়স, লাব ও বরত সম্পর্কিত অধিকাংশ তথ্যই, আমরা পাই দীনদয়াল ওঝার কাছে l বারিয়োরা যে সমাজের কাছে সম্মান পেত, সেকথা আমাদের বলেন শ্রীনারায়ণসিং পরিহার l তার ঠিকানা হল : পোঃ - ভিনাসর, বিকানের l জয়সলমেরের বড়াবাগে কাজ করেন শ্রী মঘারাম l তিনিই আমাদের ‘শুণ্ডিয়া’ -র পরিচয় দেন l

সারণে জল টেনে তোলে যে বলদ বা উট তাদের ক্লান্তির দিকেও লক্ষ্য রাখা হয় l ভুনের সঙ্গে আরও একটা চরকি লাগানো হয় যেটাতে একটা লম্বা দড়ি বাধাঁ থাকে l বলদের প্রতিটি ক্ষেপে দড়িটি আটকে যায় l পুরো দড়িটি জড়িয়ে গেলেই বোঝা যাবে বলদ জোড়া পাল্টাতে হবে l পশুদেরও পরিশ্রমের এত খেয়াল রাখে যে পদ্ধতি সম্ভবত আজ এর প্রচলন উঠে গেছে l তবুও পুরোনো শব্দকোষে এটি ডোরা নামে পাওয়া যায় l

ফলৌদি শহরের শেঠ শ্রী সাঙ্গিদাসজির কুয়োর প্রাথমিক তথ্য আমাদের দেন জয়পুরের শ্রী রমেশ থানবী l এরপর এর বিস্তৃত তথ্য পাওয়া গেল শ্রী মুরারিলাল থানবীর কাছে l শ্রী সাঙ্গিদাসজির পরিবারের পুরোনো গল্প আমাদের শোনান শ্রী মুরারীজীর বাবা শ্রী শিবরতন থানবী। থানবী পরিবারের ঠিকানা হল : মুচি গলি, ফলৌদি, যোধপুর l উত্কৃষ্ট গজধরেরা দীর্ঘ দিন আগে যে কুয়োটি পাথরে তৈরি করেছিল, সেটি আজ কাগজে আঁকতে ভালো ভালো বাস্তুকারেরও ঘাম ছুটে যাচ্ছে l কুয়োর প্রারম্ভিক নকশা তৈরি করতে আমাদের সাহায্য করেন দিল্লির বাস্তুকার শ্রী অনুকূল মিশ্র l বিকানের -এর বিশাল চৌতিনা কুয়োর পরিচয় আমরা পাই শ্রী শুভ পাটওয়ার ও শ্রী ওম থানবির কাছে l এই রকম উন্নত কুয়ো শহরে আরও রয়েছে l এগুলি সবই বিগত দু-আড়াইশো বছর ধরে মিষ্টি জল দিয়ে চলেছে l প্রায় সবগুলোই এত বড় যে পাড়াগুলোরও নামও হয়েছে ঐ কুয়োটির নামেই l

কুয়োর জলে সেচের কাজ চলত এরকম এলাকাও মরুভূমিতে প্রচুর ছিল l সপ্তদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ নৈণসী মুহণোত যে সমস্ত তথ্য মূলক গ্রন্থ লেখেন তাতে বিভিন্ন জায়গায় তিনি কুয়োর পরিস্থিতি, চাষবাস, সেচের ব্যবস্থা, কুয়ো, পুকুরের গণনা ও জল কোথায় কত গভীর এসব কিছুর ওপর আলোকপাত করেন l তাঁর লেখা ‘পরগনা রী ওয়িগত’ নামক গ্রন্থে 1658-62 সাল পর্ষন্ত যোধপুর রাজ্যের বিভিন্ন পরগনার রির্পোট পাওয়া যায় l আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীভঁবর ভাদানি এই বিষয়ের ওপর অনেক কাজ করেছেন l আরও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে মনোহরসিং রানাওত-এর বই ‘ইতিহাসকার মুহণোত নৈণসি ঔর উনকে ইতিহাস গ্রন্থ’ নামক বইয়ে l বইটির প্রকাশক : রাজস্থান সাহিত্য মন্দির, সোজতি দরওয়াজা, যোধপুর l

কুয়োর চাতালে অনেকসময় কাঠের তৈরী একটি পাত্র রাখা থাকে l এর নামই হল কাঠড়ী l কাঠড়ী তৈরি করে কুয়োর পাড়ে রাখা পুণ্যের কাজ মনে করা হয় এবং কাঠড়ী চুরি করা বা ভেঙে ফেলা খুবই পাপ l পাপ পুণ্যের এই অলিখিত পরিভাষা লিখিত রয়েছে সমাজের মনে l পরিবারের কোনো মাঙ্গলিক মুহূর্তে বা ভালো উপলক্ষে গৃহস্থ কাঠেড়ী তৈরি করে কুয়োর পাড়ে রেখে আসে l এর পর এটি এখানে বছরের পর বছর রাখা থাকে l কাঠের পাত্র অসাবধানতাবশত কখনও কুয়োতে পড়ে গেলেও ডোবে না l আবার উঠিয়ে এটি ব্যবহার করা হয় l কাঠের পাত্রে ছোঁয়াছুঁয়ি ও জাতপাতের বিচারও ভেসে যায় l

শহরে ফ্রিজের ওপর রাখা দু পয়সার যে প্লাসটিকের গেলাসটি লোহার চেন দিয়ে বাঁধা থাকে সেটির সঙ্গে এর তুলনা করুন l

স্বাবলম্বী সমাজ


রাজস্থানের বিশেষভাবে মরুভূমির সমাজ জলের এই কাজকে গর্বের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানায়নি l সত্যি সত্যি বিনম্রতা সহকারে কর্তব্যের মতোই তা সম্পন্ন করেছে l তারই সাকার রূপটি আমরা কুঁই, কুয়ো, টাঁকা, কুণ্ডি, পুকুর প্রভৃতিতে দেখতে পাই l এই কাজের মধ্যে একটি নিরাকার রূপও বিরাজমান, তবে এই নিরাকার রূপটি ইঁট বা পাথরের নয় l এ হল স্নেহ ও ভালোবাসার, জলের মিতব্যয়িতার l এই রূপ সমাজের মানুষের মনের আগৌরে তৈরি করা হয়েছিল l যেখানে মন প্রস্তুত, সেখানে শ্রম এবং পুঁজিও পাওয়া গেল l এর জন্য বিশেষ প্রয়াস করতে হল না, অনায়াসেই হতে লাগল l রাজস্থানের জলের কাজের স্বরূপটিকে বুঝতে আমরা এর সাকার রূপের উপাসকদের এবং নিরাকার রূপের উপাসকদের উভয়ের কাছেই সাহায্য পেয়েছি l

বটসোয়ানা, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া, মালাওয়ি প্রভৃতি জায়গায় পানীয় জলের জোগান দেওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা চলেছে সে খবর আমরা পাই 1980 সালে মালাওয়ি দেশের জোম্বা শহরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের রির্পোট থেকে l রিপোর্টটি অবশ্যই কিছুটা পুরোনো কিন্তু আজও যে সেখানকার পরিস্থিতি কিছু উন্নত হয়েছে সেকথা মনে হয় না l কিছু উন্নতি যদি হয়েও থাকে তা তবে হয়েছে ভুল পথে l মালাওয়ি সরকার কানাডার দুটো সংস্থার সঙ্গে এই সম্মেলন করে l সংস্থাগুলি হল ইণ্টারন্যাশনাল ডেভলপমেণ্ট রিসার্চ সেণ্টার ও কেনেডিয়ান ইণ্টারন্যাশনাল ডেভলপমেণ্ট এজেন্সি l

প্রায় একশোটি দেশে ছড়িয়ে থাকা মরুভূমিতে জল সমস্যার সমাধানে যে প্রয়াস চলছে, তার কিছু তথ্য আমরা পাই আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে অবস্থিত ন্যাশনাল আকাদেমি অফ সায়ান্সেস -এর পক্ষ থেকে 1974 সালে ছাপা বই ‘মোর ওয়াটার ফর এরিড ল্যান্ডস; প্রমিসিং টেকনোলজিস এন্ড রিসার্চ অপরচুনেটিস’ l এতে নেগেওয়ে মরু রাজ্যের ( বর্তমান ইজরায়েলে অবস্থিত ) বর্ষা, হাজার দু’হাজার বছরের পুরোনো বৃহত জলসংগ্রহ পদ্ধতির উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যায় কিন্তু তার বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক খবর পাওয়া যায় না l বর্তমানে তো এখানে কমপিউটারে চাষ ও ড্রিপ পদ্ধতিতে সেচের এতই প্রচার যে আমাদের দেশের রাজস্থানের, গুজরাতের নেতা ও সমাজসেবকরা ইজরায়েল দৌড়াচ্ছে এই পদ্ধতি শিখতে ও এখানে নিয়ে আসতে l

এই ধরনের বইগুলিতে প্লাসটিকের চাদর দিয়ে আগৌর তৈরি করে বর্ষার জল সংগ্রহ করার পদ্ধতি খুবই উত্সাহের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে l কোথাও তো বলা হচ্ছে মাটির ওপর মোম ছড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি প্লাসটিকের থেকে সস্তা এবং ভালোও l

ভালো কোনো পদ্ধতি ওখানে নেই একথা বলতে ভয়ই লাগে l একটা পদ্ধতি অবশ্যই পাওয়া যায়; সোজা কুয়োর বদলে আড়া কুয়ো l এই ধরনের কুয়ো ইরাক, ইরান প্রভৃতি জায়গায় তৈরি হোতো l একে কওয়ণ্টা বলা হয় l এতে পাহাড়ের তেরছা অংশ খুঁড়ে ভূ জলের সঙ্গে পাহাড়ের স্তরের জলও সংগ্রহ করা হয় l

রাজস্থানে এই সব কাজ নিজেদের সম্পত্তি ও সাধনাতেই হয়েছে l এখানকার সকল কাজই সিমেণ্টের বদলে চুন সুরকিতেই হতে থাকে l সিমেণ্ট ও চুন - সুরকির একটু তুলনা করে দেখা যাক – চুন সুরকির কাজ জলে ভেজাতে হয় না l সিমেণ্টে হয় l সিমেণ্টের কাজে, কাজ হয়ে যাওয়ার বারো ঘণ্টা পর থেকে কম পক্ষে তিন চার দিন জলে ভেজাতে হবে l সাতদিন হলে আরও ভালো l ভোজানো না হলে অর্থাত জল না পেলে সিমেণ্টের কাজে ফাটল দেখা দিতে থাকে l

এমনিতে চুন ও সিমেণ্ট একই পাথর থেকে তৈরি হয় কিন্তু করার পদ্ধতি এদের চরিত্র পাল্টে দেয় l সিমেণ্ট তৈরির জন্য পাথরগুলোকে মেসিনে খুবই মিহি করে পিষে নেওয়া হয় l এর পর তাতে এক বিশেষ প্রকারের বালিযুক্ত মাটি মেশানো হয় l চুন করার জন্য চুনাপাথরগুলিকে প্রথমে ভাটিতে পোড়ানো হয় তারপর বালি ও কাঁকর মিশিয়ে চাকতিতে পেষা হয় l

একই পাথরের আলাদা আলাদা ব্যবহার, তার স্বভাব পাল্টে দেয় l

সিমেণ্ট জলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হতে থাকে l একে ইংরাজিতে সেটিং টাইম বলে l বলা হয় এই সময়টা হল আধ থেকে এক ঘণ্টা l এই প্রক্রিয়া দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত চলতে থাকে l এরপর সিমেণ্টের শক্তি কমতে থাকে l শক্ত হওয়া ও জমার সঙ্গে সিমেণ্ট সঙ্কুচিতও হতে থাকে l বই-এ এই সময়টা ত্রিশ দিন বলা হয়েছে কিন্তু ব্যবহারকারী মনে করে তিন দিন l ঠিকভাবে সংকুচিত হয়ে, শক্ত হয়ে সিমেণ্ট বইয়ের হিসেবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত এবং ব্যবহারকারীর হিসেবে খুব বেশি হলে একশো বছর পর্যন্ত টিকে থাকে l

চুনের স্বভাবে কিন্তু প্রচুর ধৈর্য l জলের সঙ্গে মিশে তা জমতে শুরু করে না, গারাতেই তা এক দু-দিন পড়ে থাকে l জমা, শক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া দু-দিন থেকে দশ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে l এই সময় তাতে ফাটল হয় না কেননা জমার সময় এ সংকুচিত হয় না বরং ছড়িয়ে যেতে থাকে l তাই জমার সময় এটিকে সিমেণ্টের মতো ভিজিয়ে রাখতে হয় না l এই সময় এটি ছাড়তে থাকে এবং তাই উইপোকাও লাগে না l সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শক্ত হতে থাকে ও এর ঔজ্বল্যও বাড়তে থাকে l ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হলে এর সময়কাল দু, চার বছর নয়, দুশো থেকে ছশো বছর হয় l ততদিন পর্যন্ত সিমেণ্টের পাঁচ, সাত প্রজন্মের দাহকার্য সম্পন্ন হয়ে যায় l

আরও একটা তফাত রয়েছে দুয়ের মধ্যে l চুনের কাজ জলকে চুঁইয়ে যেতে কোনো অবকাশ দেয় না কিন্তু সিমেণ্ট জল আটকাতে পারে না l প্রতিটি শহরেই খুব ভালো ভালো ঘর, ইমারতের দেওয়াল, ট্যাংক প্রভৃতি সকলেই একথা চিত্কার করে বলছে দেখতে পাওয়া যাবে l

তাই চুনে তৈরি ট্যঙ্কিগুলিতে জল চুঁইয়ে চলে যায় না l এরকম টাঁকা, কুণ্ড, পুকুর দুশো তিনশো বছর পর্যন্ত গর্বের সঙ্গে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাওয়া যাবে l চুন সুরকির কাজের যে শাস্ত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণ সেই শাস্ত্রের জ্ঞাতা কারিগরদের দেহ, মন এবং সম্পত্তির তপস্যায় রত তাপসদের আজও বিশাল ভূমিকা রয়েছে l

Path Alias

/articles/tathayasauutara-padhaarao-maaharae-daesa

Post By: Hindi
×