কারা ছিলেন এই খ্যাতিহীন লোকেরা ?
এ ছাড়াও বাংলায় মুণ্ডা, খেড়িয়ারাও পুকুরের কাজ করতেন l তবে বাংলায় পুকুর তৈরীতে সব থেকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন মুদী l এখনো মুদী ছাড়া পুকুর প্রতিষ্ঠা হয় না l
শত শত হাজার হাজার পুকুর তো শূন্য থেকে প্রকট হয় নি l এ ক্ষেত্রে পুকুর যাঁরা তৈরী করতেন তাঁরা যদি ‘এক’ হন তো যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়ে পুকুর তৈরী করতেন তাঁরা হলেন ‘দশ’l আর এই একক, দশক মিলেই তো হয় শতক, হাজার l কিন্তু গত দুশো বছরের নতুন শিক্ষা কাঠামোয় তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এই একক, দশক, শতক, হাজারকে শূন্যেই পরিণত করে ফেলেছে l এই নতুন সমাজের মনে এতটুকু কৌতুহল পর্যন্ত নেই যে তাদের আগে এত পুকুর কারা তৈরী করতেন! নতুন শিক্ষা কাঠামো আই.আই.টি-তে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি যে সমস্ত কোর্স চালু হয়েছে, সেই সমস্ত কোর্সের পরিচালকরা বা শিক্ষর্থীরাও কোনদিন তাদের নিজেদের মাপকাঠি দিয়ে, মগজ দিয়ে তাদের আগের এই কাজগুলিকে মেপে দেখার কোন চেষ্টাই করেনি lতারা নিজেদের গজ দিয়েও যদি মাপতো তাহলেও তাদের মনে এই প্রশ্নটা তো অন্তত আসতো যে কোথায় ছিল সেই সময়ের আই.আই.টি, সেগুলির শিক্ষকই বা কারা ছিলেন, কত ছিলো সেগুলোর বাজেট, কতজন ইঞ্জিনিয়ার বেরোতো ? তাদের কাছে পুরোনো দিনের এই কাজগুলি পুরোনো হয়ে যায় এবং তারা জলের প্রশ্নের মীমাংসা আধুনিক পদ্ধতিতে করার প্রতিশ্রুতি দেয় l শুধু প্রতিশ্রুতিই নয়, এই মীমাংশা যে তারা করতে পারবে এমন দাবীও জানায় l গ্রাম বা ছোট শহরের কথা আর কেই বা বলে l এই দাবী ও প্রতিশ্রুতির পরিহাসময় উদাহরণ হলো বড় শহরগুলির পাইপে সবসময়ে বয়ে আসা নৈঃশব্দl বর্তমান সময়ের দাবীগুলিকে যদি বর্তমান সময়ের গজ দিয়ে মাপা হয় তাহলে দেখা যাবে কখনও দাবী ছোট লাগছে, তো কখনও গজই ছোট পড়ছে l
গোণ্ড সমাজেরও গভীর সম্পর্ক ছিলো পুকুরের সঙ্গে l মহাকৌশলে গোণ্ডদের এই গুণ জায়গায় জায়গায় পুকুর রূপে ছড়িয়ে রয়েছে l জব্বলপুরের কাছে কুড়ন যে পুকুর তৈরী করেছিলেন আজ প্রায় এক হাজার বছর পরও তা পরিষেবা দিয়ে চলেছে l এই সমাজেরই রানী দুর্গাবতী, নিজের ছোট্ট জীবনকালের একটা বড় অংশ পুকুরে ভরিয়ে নিয়েছিলেন l
এই গজকে এখন এখানে রেখে খানিকটা পিছনে ফেরা যাক l আজ যাঁরা পরিচয়হীন হয়ে গেছেন একদিন তাঁদের খুবই নাম ডাক ছিলো l সারা দেশজুড়ে পুকুর তৈরী হতো, আর যাঁরা তৈরী করতেন তাঁরাও ছড়িয়ে ছিলেন সারা দেশজুড়ে l কোথাও কোথাও এই শিক্ষা ছিল জাতিগত আর কোথাও তা জাত থেকে কিছুটা সরে গিয়ে বিশেষ এক শ্রেণী (পাঁত) তৈরী করতো l পুকুর যাঁরা তৈরী করতেন তাঁরা স্থায়ীভাবেও বসবাস করতেন আবার কোথাও কোথাও কাজ করতেন ঘুরে ঘুরে lযাঁরা পুকুর তৈরী করতেন তাঁদের সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করার জন্য একটি সুন্দর শব্দ হলো ‘গজধর’ l রাজস্থানের কিছু জায়গায় এই শব্দটি আজও বেঁচে রয়েছে l গজধর অর্থাত যিনি গজ ধারণ করেছেন l আর গজ তো সেটাই যেটা মাপার কাজে ব্যবহার হয় l তবে সমাজ এঁদের তিন ফুট লোহার রড নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মিস্ত্রী মনে করতো না l গজধর তো প্রকৃতপক্ষে সমাজের গভীরতা মেপে ফেলেন, তাই সম্মানের সেই স্থানই তাঁকে দেওয়া হয়েছে l
গজধর ছিলেন বাস্তুকার l গ্রাম-সমাজ হোক বা নগর-সমাজ, তা নব নির্মানের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন গজধর l নগর নিয়োজন থেকে শুরু করে ছোট ছোট নির্মানের কাজও গজধরের কাঁধে ন্যস্ত ছিলো l তিনি পরিকল্পনা তৈরী করতেন, বাজেট নির্ধারণ করতেন, কাজের প্রয়োজনীয় সমস্ত বস্তুসামগ্রী জোগাড় করতেন কিন্তু এ-সমস্ত কিছুর পরিবর্তে যজমানের কাছে এমন কিছু তিনি চেয়ে বসতেন না, যা সে দিতে পারবে না l মানুষজনও ছিলো সেরকম, তাঁদের দ্বারা যা কিছু সম্ভব হতো তা গজধরকে উপহার দিতে তাঁদের এতটুকুও কুণ্ঠা ছিলো না l কাজ শেষ হলে পারিশ্রমিক ছাড়াও গজধর পেতেন সম্মান l শিরস্ত্রাণ উপহার দেওয়ার রীতি বর্তমানে সম্ভবত শুধুমাত্র শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যেই রয়ে গেছে l কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্তও রাজস্থানের গৃহস্থদের তরফ থেকে গজধরকে খুব সম্মনের সঙ্গে শিরস্ত্রাণ উপহার দেওয়া হতো l তাঁর নামে জায়গা লিখে দোওয়ার রেওয়াজও ছিলো l গজধরের সঙ্গে কাজ করতেন যে সমস্ত লোক, পাগড়ি পরার পর গজধর তাদের মধ্যে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করতেন l তাঁদেরও পারিশ্রমিক ছাড়াও কিছু না কিছু উপহার দেওয়া হতো l কৃতজ্ঞতার এই ভাব সব থেকে বেশি দেখতে পাওয়া যেত পুকুর তৈরীর পর যে ভোজ হতো তাতে l
গজধর হিন্দু ছিলেন, পরবর্তীকালে মুসলমানও l ‘সিলাওট’ বা ‘সিলাওটা’ নামে এক জাতি স্থাপত্য শিল্পে খুব নিপুন ছিলেন l শিলাওটা শব্দ, শিলা অর্থাত পাথর থেকে এসেছে l সিলাওটারাও গজধরদের মতো দুই ধর্মেরই হতেন l এঁদের নিজেদের পাড়া ছিলো l এখনও রাজস্থানের পুরনো শহরে সিলাওটা পাড়া পাওয়া যায় l সিন্ধুপ্রদেশ, করাচীতেও সিলাওটাদের জনবহুল পাড়া রয়েছে l সিলাওটা ও গজধর একই কাজ করতেন দুই নামে l কোথাও কোথাও আবার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে l জয়সলমের ও সিন্ধে সিলাওটাদের নায়ককেই গজধর বলা হতো l করাচীতেও এঁদের যথেষ্ট সম্মন ছিলো l দেশ ভাগের পর পাকিস্তান মন্ত্রীমণ্ডলেও এক সিলাওটা- ‘হাকিম মহম্মদ’ গজধরের নিযুক্তি হয়েছিলো l
এঁদেরই একটা শাখা ছিলো তামোর বংশের বংশধর l সমাজ নির্মাণের উচ্চপদে এঁরা বার বার অধিষ্ঠিত হয়েছেন l অনঙ্গপাল তওঁরকে কোন এক সময় দিল্লীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সম্মন প্রদান করা হয়েছিলো l
অভ্যস্থ চোখের সুন্দর উদাহরণ হলেন গজধর l গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুসারে কাজ শেখানো হতো l পুরনো হাত নতুন হাতকে এমনই শিক্ষা দিতেন, এমনভাবে তুলে ধরতেন যে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন হাত ‘জোড়িয়া’ হয়ে যেতেন l জোডিয়া অর্থাত গজধরের বিশ্বস্ত সাথী l একজন গজধরের সঙ্গে কয়েকজন জোড়িয়া থাকতেন l কিছু ভালো জোড়িয়া সঙ্গে পেলে গজধর ক্রমে এত দক্ষ হয়ে উঠতেন যে তারপর তাঁর নামই শুধু গজধর থেকে যেতো, গজ আর তাঁর লাগত না l ভালো গজধরের পরিভাষাই ছিলো তিনি হাতিয়ারে হাত লাগাবেন না l শুধু জায়গা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় কি করতে হবে l তিনি এক জায়গায় বসে থাকেতন এবং তাঁর মৌখিক নির্দেশেই কাজ হতো l
হাতিয়ার বা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে করতে দক্ষ হয়ে ওঠা, এমনই দক্ষ যে হাতিয়ারের আর প্রয়োজনই থাকে না – এটা এক কথা আর স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতা, এটা অন্য কথা l এরকম দক্ষতা যাঁরা অর্জন করেন তাঁদের হলা হতো ‘শিরভাব’ l শিরভাব কোন হাতিয়ার ছাড়াই জলের ঠিক জায়গা বলে দিতেন l বলা হয় তাঁর ভাব আসতো, অর্থাত তিনি বুঝতে পারতেন l শিরভাব কোন বিশেষ জাতির হতেন না l কেউ কেউ এই সিদ্ধি অর্জন করতেন l ‘জলসুঁঘা’ অর্থাত ভূ-জল সুঁঘে(ঘ্রাণ নিয়ে) যাঁরা বলে দিতে পারতেন l এঁরাও ছিলেন শিরভাবের মতোই, তবে এঁরা আম বা জাম কাঠের সাহার্যে ভূ-জলের তরঙ্গ সঙ্কেত বুঝে নিয়ে জলের ঠিকানা বলে দিতেন l এই প্রক্রিয়াটির এখনও দেখতে পাওয়া যায় l টিউবওয়েল খোঁড়ে যে কোম্পানিগুলো তারা প্রথমে যন্ত্র দিয়ে জায়গা বেছে নেয়, তারপর এঁদের ডেকে এনে নিশ্চিতভাবে জেনে নেয় জল পাওয়া যাবে কি না! সরকারী ক্ষেত্রেও কাগজে কলমে না দেখিয়ে এঁদের পরিষেবা নেওয়া হয় l
সিলাওটা শব্দ মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত পোঁছাতে পোঁছাতে একমাত্রা হারিয়ে সিলাওট হয়ে গেছে l অবশ্য গুণ সেই একই l দেশের মধ্যভাগে শিলকরও ছিল কোথাও কোথাও l গুজরাতে এই শিলকররা প্রচুর সংখ্যায় রয়েছেনl সেখানে এঁদের সলাট বলা হয় l এঁদের মধ্যে ‘হীরা-সলাট’ পাথরের কাজে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন l
কচ্ছতে গজধর হয়ে গেছেন – গইধর l তাঁদের বংশের ধারা শুরু হয় ইন্দ্র-পুত্র জয়ন্ত থেকে l গজধরদের আরও এক নাম সূত্রধর l এই সূত্রধরই পরে গুজরাতে ধার এবং দেশের আরও কিছু জায়গায় সুথার হয়ে যান l
গজধরের আরও এক শাস্ত্রীয় নাম ‘স্থপতি’ l যা থবিত রূপে আজও প্রচলিত রয়েছে l
পাথরোট ও কৌরি জাতি পাথরের সমস্ত ধরণের কাজ খুব ভালো মতো জানতেন l এঁরা পুকুর তৈরীর কাজও করতেন l মধ্যপ্রদেশের ‘পথরোটা’ নামে গ্রাম ও পাড়া আজও এঁদের স্মরণ করায় l কৌরিরা ছড়িয়েছিলেন দূর দক্ষিণ পর্যন্ত l এঁদের পাড়াকে বলা হতো টকের বাড়ি l
‘এই জগত মাটির তৈরী’, আর এই মাটির জগতকে চিনতেন জানতেন এমন লোকেরও অভাব ছিল না l এঁদের বলা হতো মটকুট l আবার কোথাও বা মটকুড়া l যে গ্রামে তাঁরা বসবাস করতেন সেই গ্রামকে বলা হতো মটকুলি l সোনকর ও সুনকর শব্দ ছিলো তাঁদের জন্য যাঁরা সোনার কাজ করতেন l তবে এই সোনা, সোনা নয়, মাটিই l সোনকর বা সুনকরদের রাজলহরিয়াও বলা হয়েছে l তাঁরা রঘু বংশের সম্রাট সগরের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দিতেন l অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি হয়ে গেলে সগর পুত্ররা তা খুঁজতে গিয়ে সারা পৃথিবী খুঁড়ে ফেলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা কপিল মুনির ক্রোধের পাত্র হয়ে পড়েন l সেই অভিশাপের কারণে সোনকর মাটি কাটার কাজ করতেন l কাজ করে অবশ্য অভিশাপ নয়, পূন্যই অর্জন করেছেন l এই সোনকররা ইঁট তৈরীর কাজেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন l খঁতিদেরও পুকুরের মাটি কাটার কাজে ডাকা হতো l যেখানে এঁরা থাকতেন না সেখানে পুকুরের মাটি বিষয়ে পরামর্শ করা হতো কুমহারদের সঙ্গে l
পুকুরের জায়গা নির্বাচনের সময় ‘বুলাই’ না ডাকলেও আসতেন l বুলাই অর্থাত যাঁর কাছে গ্রামের সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যেত l কোন জায়গার মাটি কেমন, জায়গা কার, কোন জায়গায় পুকুর বাউড়ি আগেই হয়ে গেছে, কোথায় কোথায় হতে পারে – এই রকম সমস্ত তত্থ্য বুলাইয়ের কণ্ঠস্থ থাকতো l এছাড়াও তাঁর কাছে এ সবের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম লিখিত হিসেবও পাওয়া যেতো l
মালওয়া এলাকার দলিলে এই সমস্ত তথ্য বুলাই-এর সাহায্যেই নথিভুক্ত করা হতো l এই দলিল প্রতিটি জমিদারীতে নথিভুক্ত থাকতো l
বুলাইকে কোথাও কাথাও ‘ঢেরও’ বলা হয়েছে l মির্ধারাও এই ধরণেরই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন l এঁরা জমির মাপ-জোক, হিসেবপত্র এমনকি জমি সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি পর্যন্ত করতেন l
চুনকর করতেন ইঁট ও চুনের গারার কাজ l অবসর সময় এঁরা নুনের ব্যবসাও করতেন l বর্তমান মধ্যপ্রদেশে ১৯১১সালে চুনকরদের সংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজারেরও বেশি l ওদিকে উড়িষ্যায় ছিল নুলিয়া, মুরহা ও সাঁসিয়া l ইংরেজ সরকার সাসিয়াদের অপরাধপ্রবণ জাতি হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের সম্পূর্ণভাবে বরবাদ করে দেয় l নতুন সমাজ যেমন পুকুর থেকে সরে আসতে লাগল, তেমন তেমনই ভুলতে লাগলো, পুকুর যাঁরা তৈরী করতেন তাঁদেরও l এই ভুলে যাওয়ার তালিকায় স্থান পেলেন- দুসাধ, নৌনিয়া, গোণ্ড, প্রধান, কোল, ঢিমর ও ভোই l একটা সময় ছিলো যখন এদের পুকুর বিশেষজ্ঞরূপে পরিচিতি ছিল l আজ আমরা তাঁদের সেই ভূমিকাকে বুঝে ওঠা প্রয়োজনীয় বিবরণটুকুও হারিয়ে ফেলেছি l
কোরি বা কোলি জাতিও প্রচুর পরিমানে পুকুরের কাজ করেছেন l শত, শত পুকুর তৈরী করেছিলেন এই কোরি জাতি কিন্তু এদের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারে এমন একটা পংক্তিও আজ আর পাওয়া যায় না l অথচ একটা সময় ছিল যখন অনেকেই তাঁদের এলাকাতে এই কোলি জাতির লোকেদের নিয়ে গিয়ে বসাতে চাইতেন এবং তাদের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হোত l মহারাষ্ঠ্রে অনেক গ্রামেই তাঁদের যে জমি দেওয়া হয়েছিলো তার খাজনা লাগত না l এই জমিগুলিকে বলা হত ‘বার’ বা ‘ওয়ারে’ l
সত্য সত্যই লৌহ পুরুষ থিলেন আগরিয়া l এদের পরিচিতি ছিলো লোহার কাদের জন্য l কিন্তু কোথাও কোথাও এঁরা পুকুরও তৈরী করতেন l পুকুর তৈরীর হাতিহায় গাঁইতি, টামনা, শাবল, কোদাল, পরাত, বড় লোহার কড়াই তৈরী করতেন যে মানুষগুলো তাঁরা সেগুলো ব্যবহারেও কারো থেকে পিছিয়ে ছিলেন না l
পরিহার ও মালী সম্প্রদায়ও যুক্ত ছিলেন এই কাজের সঙ্গে l পুকুর হয়ে গেলে তাঁরা তাতে সালুক, পদ্ম প্রভৃতি লাগাতেন l কোন কোন জায়গায় পুকুরের ধারের কিছু জমি মালি পরিবারের জন্যই রাখা থাকত l পুকুর থেকেই জীবিকা চলত তাই জীবনভর তারা পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন l
ভীল, ভীলানে, লহরিয়া, কোল সব কিছু হারিয়ে আজ তপশিলী উপজাতি তালিকাভূক্ত হয়েছেন l কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন এঁদের নিজেদের ছোট-বড় রাজত্ব ছিলো l এই রাজত্বে পুকুরের, জলের সব ব্যবস্থা তাঁরা নিজেরাই করতেন l বেগবতী নদীর জলকে কোথায় আটকাতে হবে, কেমনভাবে সেখানে বাঁধ দিতে হবে, সে জলকে সেচের জন্য কতদূর নিয়ে যেতে হবে- এ সব কৌশল ভীল-দের কাছে ছিলো খুবই সাধারণ l যেন তাঁর নিজের কাঁধে রাখা তীর ধনুক l নদীর উপর দেওয়া বাঁধ ও পুকুরের জলের চাপও তাঁরা খুব ভালো বুঝতেন l জলে কতটা চাপ রয়েছে, এই চাপে জল কতদূর পর্যন্ত গিয়ে পুকুরগুলোকে ভরাতে পারবে তীর দিয়ে গণ্ডি কেটে ভীল তা বলে দিতে পারতেন l
রাজস্থানে এই কাজটাই করত মীনা l আলোয়ার জেলার একটি সংস্থা ‘তরুন ভারত সংঙ্ঘ’ বিগত কুড়ি বছরে সাত হাজারের বেশী পুকুর তৈরী করিয়েছে l প্রতিটি গ্রামে গিয়েই তাঁদের মনে হয়েছে পুরো গ্রামই পুকুর তৈরী করতে জানে l তাই পুকুর তৈরী সংক্রান্ত কোন সমস্যাতেই সংস্থাকে বাইরের কারো কাছে পরামর্শের জন্য ছুটতে হয়নি l কেননা গ্রামের ভেতর যে মীনা সম্প্রদায়ের পাড়া ছিলো, যারা পুকুর তৈরী করে এসেছেন পুরুষানুক্রমে l
ভীলেদের মধ্যে কিছু প্রকারভেদ রয়েছে l নায়ক, নায়কা, চৌলিওয়ালা নায়ক, কাপড়িয়া নায়ক, বড় নায়ক, ছোট নায়ক এছাড়াও তলারিয়া, গরাসিয়া- সকলেই পুকুরের কাজে নায়ক l
মহারাষ্ট্রের নায়ক বা কোঙ্কনের নাইক উপাধি বাঞ্জারাদের মধ্যে পাওয়া যেতো l বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন বনচর, বিনচর- এরপর ধীরে ধীরে তাঁরা বাঞ্জারা হয়ে গেলেন l এখন এঁদের দয়ার পাত্র করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু একটা সময় ছিল যখন এঁরা কয়েকশো পশুর পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে এক শহর থেকে আর এক শহরে বানিজ্যে বেরিয়ে পড়তেন l আখের এলাকা থেকে গুড় নিয়ে যেতেন ধানের এলাকায়, ধানের এলাকা থেকে অন্য কোন এলাকায় l
শাহজাহানের উজির আসফজহান যখন ১৬৩০সালে দক্ষিণে আসেন তখন তাঁর জিনিসপত্র বয়ে আনার জন্য ভঙ্গী-জঙ্গী মানক এক নায়ক বাঞ্জারার পশুর পাল-ই ব্যবহার করা হয়েছিল l পশুর সংখ্যাটা বড় একটা কম ছিলো না l এক লাখ চল্লিশ হাজার l ভঙ্গী-জঙ্গী ছাড়া শাহি সৈন্যবাহিনী নড়তেও পারতো নাl নায়কের প্রশংসায় আসফজাহান তাঁকে সোনায় লেখা এক তাম্রপাত্র উপহার দেন l
বর্ণনাতে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু বাঞ্জারাদের পালে এত পশু থাকতো যে গোণা কঠিন l তাই এটাই প্রচলিত ছিল যে ‘এক লাখ পশুর পাল’ l আর এই টোলার নায়ককে বলা হতো লাখা বাঞ্জারা l হাজার হাজার পশুর পাল নিয়ে কয়েকশো মানুষ বেরিয়ে পড়তেন l এঁদের একদিনের বিশ্রামে কতটা জলের প্রয়োজন হয় আন্দাজ করা যায় l যেখানে এঁরা পৌঁছাতেন সেখানে যদি পুকুর না থাকতো তো সেখানে পুকুর খোঁড়াটা তাঁরা তাঁদের কর্তব্য বলে মনে করতেন l মধ্য প্রদেশের সুন্দর সুন্দর বড় পুকুরগুলি এরকমই কোন লাখা বাঞ্জারার তৈরী l ছত্রিশগড়ের অনেক গ্রামের লোকই নিজেদের পুকুরগুলির সঙ্গে কোন না কোন লাখা বাঞ্জারাকে স্মরণ করেন l এই অজ্ঞাত লাখা বাঞ্জারাদের হাতে তৈরী জ্ঞাত পুকুরগুলির তালিকাতে কয়েকটি প্রদেশের নামই ঢুকে পড়বে l
গোণ্ড সমাজেরও গভীর সম্পর্ক ছিলো পুকুরের সঙ্গে l মহাকৌশলে গোণ্ডদের এই গুণ জায়গায় জায়গায় পুকুর রূপে ছড়িয়ে রয়েছে l জব্বলপুরের কাছে কুড়ন যে পুকুর তৈরী করেছিলেন আজ প্রায় এক হাজার বছর পরও তা পরিষেবা দিয়ে চলেছে l এই সমাজেরই রানী দুর্গাবতী, নিজের ছোট্ট জীবনকালের একটা বড় অংশ পুকুরে ভরিয়ে নিয়েছিলেন l
গোণ্ডরা যে শুধু নিজেরা পুকুর করতেন তাই নয়, অন্য যাঁরা পুকুর করতেন তাঁরা তাঁদের যথেষ্ট সম্মানও দিতেন l গোণ্ড রাজারা খুব উত্সাহের সঙ্গে কোহলী সমাজের লোকেদের এনে ভাণ্ডারা জেলাতে বসিয়েছিলেন l এজন্য ভাণ্ডরাতেও খুব ভালো পুকুর পাওয়া যায় l
বড় পুকুরের গুণতিতে সব থেকে প্রথমে আসে যে প্রসিদ্ধ ‘ভুপাল তাল’ তা তৈরী করিয়েছিলেন রাজা ভোজ, কিন্তু কালিয়া নামক কোন এক গোণ্ড সর্দারের সাহায্যেই তার রূপরেখা সম্পূর্ণ হতে পেরেছিলো l ভূপাল ও হোসঙ্গাবাদের মাঝের ঘাঁটিতে বয়ে যাওয়া কালিয়াসোত নদী এই গোণ্ড সর্দারের নামেই স্মরণ করা হয় l
ওঢ়িয়া, ওঢ়হি, ওড় ঔড় – জায়গা অনুসারে নাম পাল্টেছে l কাজ সেই একই রাত্রি-দিন পুকুর তৈরী করা l এত যে গোণা সম্ভব ছিল না l তাই প্রবাদে পরিণত হয়েছিলো ওড় প্রতিদিন নতুন কুয়োর জল পান করে l যাঁরা তৈরী করতেন ও যা তৈরী হতো এই দুইয়ে একাকার হয়ে যাওয়ার এর থেকে বড় উদাহরণ সম্ভবত আর হয় না l কুয়োর আর এক নাম যে ওড় l ওড়রা পশ্চিমে গুজরাত থেকে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ বিশেষভাবে বুন্দেলশহর ও তার আশপাশের এলাকা- মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিলো l এঁদের সংখ্যাও সম্ভবত ভলোই ছিলো l উড়িষ্যায় কখনও কোন সমস্যা হওয়ায়, নয় লক্ষ ওঢ়িয়া ধার নগরীতে উঠেছিলেন বলে গল্প প্রচলিত রয়েছে l এঁরা গাধা পালতেন l কোথাও গাধা দিয়ে মাটি বয়ে নিয়ে গিয়ে পাড় তৈরী করতেন, তো কোথাও মাটি খুঁড়তেন l সাধারণত স্ত্রী-পুরুষ একই সঙ্গে কাজ করতেন l ওঢ়িয়া খুব ভালো মাটি চিনতেন l রং ও মাটির গন্ধে তাঁরা মাটির স্বভাব পড়ে ফেলতে পারতেন l মাটির উপরিতল ও চাপও তাঁরা খুব ভালো বুঝতেন l রাজস্থানে প্রবাদ রয়েছে – ওড়িয়া কখনো মাটি চাপা পড়ে মরে না l
প্রসিদ্ধ লোকনায়িকা জসমা ওঢ়ন ধার নগরীর এই রকমই কোন একটা পুকুরে কাজ করছিলেন l রাজা ভোজ তাঁকে দেখে এমনই মুগ্ধ হন যে রাজ্য-পাট পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন l রাজার চোখে জসমা ছিলেন অপ্সরা, সোনায় তৈরী অপ্সরা বললে বোধহয় ভলো হয় l কিন্তু নিজেকে নিজের শরীরকে এমন কি এই সংসারকেও মাটি মনে করে যে পরম্পরা, জসমা ছিলেন সেই পরম্পরাই অংশ বা ধারা l গল্প বলে – রাজা জসমাকে পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন l নিজের কর্তব্য ছেড়ে যা করার নয় তাই করছিলেন l জসমা এই রকম রাজার রাণী হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করার সিদ্ধান্ত নেন l রাজার নাম মুছে গেছে কিন্তু জসমা ওঢ়নের যশ আজও উড়িষ্যা থেকে শুরু করে ছত্রিশগড়, মহাকৌশল মালওয়া, রাজস্থান ও গুজরাতে ছড়িয়ে রয়েছে l কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেছে তবুও এই এলাকায় ফসল কাটার পর এখনও জসমা ওঢ়নের গাণ গাওয়া হয়, নাটক হয় l ভবই-এর মঞ্চ থেকে শুরু করে ভারত ভবন রাষ্ট্রীয় নাটক বিদ্যালয়ে পর্যন্ত জসমার চরণ পড়েছিল l
জসমা ওঢ়নের যশ তো মানুষ মনে রেখেছে কিন্তু ওঢ়হিদের কুয়ো, পুকুর তৈরীর যশ মানুষ ভুলে গেছে l যাঁরা সত্যি সত্যি রাষ্ট্র নির্মাতা ছিলেন তাঁদের অনিশ্চিত রুটি রুজির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য করা হলো l তবুও ওঢ়হি আজও এ কাজই করেন l ‘ইন্দিরা নহর’ তৈরী করতে হাজার হাজার ওঢ়হি কাজে লেগেছিল l তবে তাঁদের সম্মান চলে গেছে আগেই l
উড়িষ্যাতে ওঢ়হিরা ছাড়াও সোনপুরা ও মহাপাত্ররাও পুকুর কুয়োর নির্মাতা ছিলেন l এঁরা গঞ্জাম, পুরী, কোনারক ও তার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিলেন l বোলঙ্গি জেলার সোনপুর গ্রাম থেকে আসেন সোনপুরারা l এঁরা একদিকে মধ্যপ্রদেশ ও অন্যদিকে অন্ধ্র পর্যন্ত পৌঁছান l খরুয়া জাতি রামগড়, বিলাশপুর ও সরগুজার আশপাশে পুকুর, ছোটবাঁধ ও নহরের কাজ করতেন l ১৯৭১-এর আদমসুমারীতে এঁদের জনসংখ্যা পাওয়া যায় ২৩হাজার l
বিহারে মুসর, বিহার সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশে লুনিয়া, মধ্য প্রদেশে নৌনিয়া, দুধাস ও কোল জাতিও পুকুর তৈরীতে মগ্ন থাকতেন l সেই সময় মুসর, লুনিয়া বা নৌনিয়ারা আজকের মতো দুর্দশা- গ্রস্থ ছিলেন না l ১৮০০ শতাব্দী পর্যন্ত পুকুর সম্পূর্ণ হলে মুসরদের উচিত পারিশ্রমিকের সঙ্গে জমিও দেওয়া হত l লুনিয়া, নৌনিয়ার পুজা করা হত পুকুর শেষ হলে l মাটি পরীক্ষক মুসরদের সমাজে একটা স্থান ছিল l কোন এক সময় তাদের এক শক্তিশালী নেতা ছিলেন চোহরমল l শ্রীসলেষ (শৈলেশ) দুসাধদের পূজনীয় ছিলেন l শুধু দুসাধই নন আন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছেও ইনি সম্মানিত ছিলেনl দুসাধ যখন শ্রীসলেষ-এর যজ্ঞ করে তখন অন্য জাতির লোকেরাও তাতে অংশ গ্রহণ করেন l এনার গাণ বিভিন্ন জায়গায় গাওয়া হত l
এই অঞ্চলেই এক সময় ডাঢ়ি নামে এক জাতি বাস করতেন l এঁদের প্রসিদ্ধি ছিল কঠিন পরিশ্রমের কাজের জন্য l কুয়ো পুকুরের কাজ অবশ্য এই তালিকাতেই ছিল l বিহারে যদি আজও কোন কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে পারা না যায়, তখন বলা হয় ‘ডাঢ়ি গালিয়ে দাও’ l ডাঢ়িদের শরীর যেমন মজবুত ছিল, শারীরিক গঠনও ছিল ততটাই সুন্দর l এদের সুডৌল, সুঠাম শরীরের পেশী দেখার মতো ছিল l
বর্তমান বিহার, ঝাড়খণ্ড ও বাংলায়১ বসবাসকারী সাঁওতালরাও খুব সুন্দর পুকুর তৈরী করতেন l সাঁওতালদের এই কুশলতাকে মনে করিয়ে দেবার জন্যই সাঁওতাল পরগণায় অনেক কিছু নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও কিছু আহর (পুকুর)আজও বেঁচে রয়েছে l
কোহলিও-দের হাতে মহারাষ্ট্রের নাসিকে এত পুকুর ও বাঁধ হয়েছিল যে এই অংশে দুর্ভিক্ষের ছায়া পর্যন্ত পড়ত না l সমুদ্র তীরবর্তি কোঙ্কন ও গোয়া প্রদেশে ঘনঘোর বর্ষা হয় এবং দেখতে না দেখতেই বৃষ্টির মিষ্টি জল সমুদ্রের নোনা জলের সঙ্গে গিয়ে মেশে l কিন্তু পশ্চিমঘাট পাহাড়ের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিভিন্ন পুকুরে এ বৃষ্টির জলকে ধরে রাখা হত l এই কুশলতা ছিলো ‘গাউড়ী’ জাতির l কর্ণাটকের উত্তরী কন্নাড় অঞ্চলে ‘চীরে’ নামের এক প্রকার পাথর পাওয়া যায় l প্রবল বৃষ্টির জল প্রবাহকে এই চীরে পাথর দিয়ে বাঁধা যায় l চীরে পাথর খাদান থেকে তুলে এনে একটা নির্দষ্ট আকারে সেটাকে কাটা হয় l এই নির্দষ্ট আকারের এক রতিও এদিক ওদিক হয় না l
এত ব্যবস্থাসম্মত কাজ, ব্যবস্থাসম্মত পরিকল্পনা ছাড়া হওয়া সম্ভব ছিল না l বুদ্ধি ও সংগঠনের জুগলবন্দী ছাড়া এতো পুকুর তৈরী হওয়া সম্ভব ছিল না, এতোদিন টিকেও থাকত না l দক্ষিণের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় এই সংগঠন কত সতেজ ও সতস্ফূর্ত ছিল l
দক্ষিণে সেচের জন্য যে পুকুর তাকে বলা হতো ‘এরি’l গ্রামে গ্রামে এরি ছিল এবং উপেক্ষার দুশো বছর পার করে হাজার হাজার এরি আজও পরিষেবা দিয়ে চলেছে l গ্রামের পঞ্চায়েতের ভিতরই আরও একটা সংস্থা থাকতো ‘এরি ওয়ার্যাম’ l এরি ওয়ার্যামে গ্রামের ছয়জন সদস্য নিযুক্ত হতেন এক বছরের জন্য l এরি সম্বন্ধীয় সমস্ত প্রকার কাজ- এরি তৈরী করা, তার রক্ষণাবেক্ষণ, সেচের ন্যায় নিরপেক্ষ ব্যবস্থা এই সব কাজের জন্য জিনিসপত্র জোগাড় করা ওয়ার্যামের জিম্মায় থাকতো l ওয়ার্যামে ছয় সদস্য যদি ঠিক মতো কাজ না করতেন তাহলে তাদের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সরানো যেতো l
এরি তৈরীর কাজ করতেন বোদদার l সম্পূর্ণ সেচ ব্যবস্থার জন্য একটি পদ নির্দিষ্ট থাকতো l এটি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল l যেমন- নীর্ঘন্টি, নীর্গন্টি, কম্বককক্টি, মাইয়োনথোটটি প্রভৃতি l পুকুরে কত জল আছে, কত জমিতে সেচ হবে, জল বন্টন ব্যবস্থা কিভাবে করা হবে, তার ব্যবস্থা করতো নীর্ঘন্টি l নীর্ঘন্টির পদ শুধুমাত্র হরিজনদেরই দেওয়া হত ও সেচের ব্যাপারে নীর্ঘন্টির মতই ছিল সর্বোচ্চ l কৃষক সমাজে যত বড়ই স্থানাধিকারী হোক না কেন এই ব্যাপারে তাঁকে নীর্ঘন্টির তুলনায় ছোটই মনে করা হতো l
একদিকে নীর্ঘন্টিদের মতো হরিজন যেমন ছিলেন, পশ্চিমে তেমনি পালীওআল ব্রাহ্মনেরাও এ কাজ করতেন l দশম শতাব্দীতে জয়শলমের, যোধপুর-এর পল্লীনগরে বসবাস করতেন বলে এদের পল্লাওয়ালা বা পলীওয়াল বলা হতো l পলীওয়াল ব্রাহ্মনেরা মরুভূমিতে বর্ষিত অল্প একটু জলকেও ধরে রাখার অপূর্ব কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন l এঁরা সুন্দর খডিন তৈরী করতেন l খডিন প্রধানত পুকুরই l মরুভূমির এমন একটা বড় অংশ যেথানে জল বয়ে আসে, তার দুই বা তিন দিকে আল দিয়ে জল আটকে বিশেষভাবে তৈরী বাঁধের মতো ক্ষেত্রকে খডিন বলে l মরুভূমিতে একশো মণ আনাজ এই খডিন থেকেই উত্পাদন করা হয়েছে l আজও জয়সলমের, যোধপুর, বাড়মের এলাকায় কয়েকশো খডিন পাওয়া যাবে l
জলের কাজের এই প্রসিদ্ধি ছাড়াও আত্মাভিমান যে কি জিনিস তার মূর্ত উদাহরণ হতে পারেন পালীওয়াল ব্রাহ্মনরা l জয়সলমেরে না জানি কত গ্রাম ছিলো এঁদের l কোন কারণবশতঃ রাজার সঙ্গে পালীওয়ালদের বিরোধ বাঁধে l রাতের মধ্যেই পালীওয়ালদের গ্রাম খালি l সুন্দর সুন্দর ঘর, কুয়ো, খডিন ফেলে রেখে তাঁরা রাজ্যের বাইরে চলে যান l জয়সলমের পর্যটন গাইড আজ বড় গর্বের সঙ্গে পালীওয়ালদের গ্রামগুলি দেখায় l সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁরা কোথায় যে যান তার ঠিক আন্দাজ পাওয়া যায় নি, তবে একটা বড় অংশ জৈনপুর ও আগ্রায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন l
মহারাষ্ট্রে চিতপাবন ব্রাহ্মণরাও পুকুর তৈরী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন l কিন্তু অন্যান্য কিছু ব্রাহ্মণদের এটা ভালো লাগলো না যে ব্রাহ্মণরা মাটি কাটা, বওয়া- এই সম্স্ত কাজ করে l বাসুদেব চিতের নামে এক চিতপাবন ব্রাহ্মণ সম্পর্কে লোক কথা রয়েছে-বাসুদেব কিছু কুয়ো, পুকুর ও বাউড়ি তৈরী করেন l একদিন তিনি পরশুরাম ক্ষেত্রতে একটা পুকুরে কাজ করছিলেন l সঙ্গে আরো অনেকে কাজ করছিলেন- দেবরুখ থেকে আসা এক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করেন l বাসুদেব তাদের আভিশাপ দেন, ‘যেব্রাহ্মণ তোমাদের সভ্গ দেবে তারা তেজহীন হয়ে লোকের নিন্দার পাত্র হবে’ সেই চিতপাবনের অভিশাপের পর তাদের বলা হয় ‘দেবরুখ’ ব্রাহ্মণ l
দেবরুখ ব্রাহ্মণ তেজহীন হয়েছিল নাকি লোক নিন্দনীয় হয়েছিল তা জানা যায় না l তবে চিতপাবন ব্রাহ্মনরা নিজের এলাকায় বা দেশেও প্রতিটি ক্ষেত্র নিজের পরিচিতি তৈরী করতে পেরেছেন l বলা হয়ে থাকে পুষ্করণা ব্রাহ্মণরাও সমাজে ব্রাহ্মণের মর্যাদা পেয়েছিলেন পুকুরেরই জন্য l জয়সলমেরের কাছে পোখরানে বসবাসকারী এঁরা সকলেই পুকুর তৈরীর কাজ করতেন l প্রসিদ্ধ তীর্থ পুষ্করদেবের পুকুর তৈরীর কাজ এঁদেরই অর্পন করা হয়েছিল l বালি দিয়ে ঘেরা খুব কঠিন জায়গায়, দিনবাত্রি পরিশ্রম করে এঁরা খুব সুন্দর পুকুর তৈরী করেন l পুকুর যখন ভরে ওঠে তখন প্রসন্ন হয়ে তাদের ব্রাহ্মণের মর্যাদা দেওয়া হয় l এখানে এখনো পুষ্করণ ব্রাহ্মণদের কোদালরূপী মূর্তি পুজা করা হয় l
ছত্রিশগড়ে রামনামীরা পুকুর বিষয়ে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন l এঁরা সারা শরীরে রামনামের উল্কি করাতেন. গায়ে যে চাদর দিতেন তাতেও লেখা থাকত রাম নাম l মাটির কাজ এঁদের কাছে রাম নাম নেওয়ারই সমতুল্য ছিল l রায়পুর বিলাসপুর ও রায়গড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সম্পরদায়ের লোকেরা ঘুরে ঘুরে পুকুর খুঁড়তেন l সম্ভবত এই ঘুরে বেড়ানোর জন্যই তাঁরা বাঞ্জরার পরিচিতি পেয়েছিলেন l ছত্রিশগড়ে এমন অনেক গ্রাম পাওয়া যাবে, যেখানে গ্রামবাসীরা বলেন তাঁদের পুকুর করেছিলেন বাঞ্জারারা l রামনামী পরিবারগুলি হিন্দু ছিলেন কিন্তু অন্তিম সত্কারে দাহ না করে তাঁরা সমাধি দিতেন l কেননা রামনামীদের কাছে মাটির থেকে বড় কিছুই নয় l জীবনভর রামের স্মরণ নিয়ে পুকুরের কাজ করে যাওয়া এই মানুষগুলির জীবনের পূর্ণ বিশ্রামের জন্য এর থেকে পবিত্র রীতি কী-ই আর হতে পারে!
এ সমস্ত নাম আজ হারিয়ে গেছে l তাঁদের নামগুলি স্মরণ করার জন্যই এই নাম মালা l তবে জগধর থেকে শুরু করে রামনামী এই যে মালা, এ মালাও পূর্ণ নয় l বড়জোর আংশিক l সব জায়গাতেই পুকুর হতো এবং সব জায়গাতেই তা করার লোকও ছিলেন l
শত-শত, হাজার-হাজার পুকুর শূণ্য থেকে প্রকট হয়নি l কিন্তু সেগুলি যাঁরা তৈরী করেছিলেন তাঁদের পরিচয় আজ শূন্যে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে l
Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishraa in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bundelkhand, Tanks in Rajasthan, Simple living and High Thinking, Honest society, Role Models for Water Conservation and management, Experts in tank making techniques
Path Alias
/articles/samsaara-saagaraera-naayaka
Post By: Hindi