স্বাবলম্বী সমাজ


মরু রাজ্যের এই ছবির সঙ্গে তুলনা করুন রাজস্থানের l এখানে সমাজ কয়েকশো বছর ধরে বৃষ্টির জলের রজত বিন্দুগুলিকে জায়গায় জায়গায় সংগ্রহ করে রাখার এক অনন্য ঐতিহ্য তিলে তিলে তৈরি করেছে l আর এই ঐতিহ্যেই কম করে কয়েক লক্ষ কুণ্ডি, কয়েক লক্ষ টাকা, কয়েক হাজার কুঁই এবং কয়েক হাজার ছোট-বড় পুকুর তৈরি হয়েছে l এর জন্য তারা কারো কাছেই হাত পাতেনি l

রাজস্থানে, বিশেষ করে মরুভূমির সমাজ জল সংগ্রহের বিষয়টিকে নিছক কোন কাজ হিসেবে না নিয়ে পবিত্র কর্তব্য হিসেবে নিয়েছিল l সেই জন্য আজকাল যাকে সিভিল ইঞ্জনিয়ারিং প্রভৃতি বলা হয়ে থাকে সেসবের ঊর্ধ্বে উঠে এটি একটি সমগ্র জল সচেতনতার দর্শনে উত্তরণ লাভ করেছে l

উনিশশো সাতাশি (1987) সালে, আমাদের এই দর্শন বুঝে ওঠার পালা খুব সাধারণ ভাবেই শুরু হয়েছিলো l বিকানের অঞ্চলের গ্রাম ভিনাসর, সেখানে গোচারণ ভূমি বাঁচানোর আন্দোলন চলছিল l সেই সংকটে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা সেখানে পৌঁছাই l

ভিনাসর গ্রামের গোচারণ ভূমির সঙ্গে লাগোয়া একটা ছোট সুন্দর মন্দির ও বাগান আছে l বাগানের এক কোণায় সুন্দর নিকানো লেপা উঠোন l এর চারদিকেই মোটামুটি এক হাত উঁচু দেওয়াল l কোণার দিকে ট্যাংকের মতো কিছু একটা তৈরি করা হয়েছে l সেটা আবার কাঠের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা l তার সঙ্গে দড়ি বাঁধা একটা বালতিও ছিল l জিজ্ঞাসা করে জানা গেল - একে টাঁকা বলে l এতে বর্ষার জল সংগ্রহ করে রাখা হয় l উঠোনের বাইরে জুতো খুলিয়ে আমাদের ভেতর নিয়ে যাওয়া হল l ঢাকনা খুলে দেখার পর বোঝা গেল, ভেতরে সুবিশাল একটা কুণ্ডে জল ভর্তি।

রাজস্থানে জল সংগ্রহের বিশাল ঐতিহ্যের সঙ্গে এই ছিল আমাদের প্রথম পরিচয় l এরপর যেখানেই গেছি, সেখানেই এই ঐতিহ্যকে আর একটু ভালোভাবে বুঝতে পারার সৌভাগ্য হয়েছে l তার আগে তো রাজস্থান সম্পর্কে এ কথাটাই শুনেছিলাম যে, সেখানে জলের ঘোরতর সংকট l সেখানকার সমাজ খুবই কষ্টের সঙ্গে জীবন যাপন করে l কিন্তু জল সংগ্রহের নমুনাগুলি থেকে অন্য এক চিত্রই বেরিয়ে আসছিল l তখন এই বিচিত্র জল – সংগ্রহ প্রক্রিয়ার অনেক ছবিও তুলেছিলাম l তখনও পর্যন্ত যে টুকরো টুকরো তথ্য জমা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে সসংকোচে এক-আধবার রাজ্যের কিছু সামাজিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলি l তখনই বুঝতে পারলাম, এখানে যে সমস্ত সংস্থা মানুষের মধ্যে কাজ করছে, তারা নিজেদের সমাজের এ নিপুণতা থেকে বিচ্ছিন্ন l এ ব্যাপারে আমরা যারা রাজস্থানের বাইরের লোক, তাদের সঙ্গে ওদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই l সংকোচ কিছুটা কাটল l তার পর থেকে যখন যেখানে সুযোগ হয়েছে, এই অর্ধেক - জানা তথ্যগুলোই যেসব স্থানে পৌঁছাতে শুরু করে দিই l

এ কাজের গভীরতা এবং বিস্তার দুটোই বুঝে ওঠা আমাদের সাধ্যাতীত l সারা রাজস্থান জুড়ে জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কাজগুলির কথা নতুন শিক্ষাক্রমে, বইতে, গ্রন্থাগারে – সর্বত্রই অনুপস্থিত l বিভিন্ন সরকারের আসা যাওয়ার মাঝখানে, নতুন সরকারী, সামাজিক সংস্থাগুলিও সমাজের এই বিস্তৃত কাজকে বিস্মৃতির অন্ধকারেই ঠেলে দিয়েছে l শুধু মাত্র মানুষের স্মৃতিতেই বেঁচে ছিল কাজের নমুনা l তাঁরাই এই স্মৃতিকে শ্রুতি শাস্ত্রের মতোই যেন মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সমর্পণ করে আসছিল l এই স্মৃতি, শ্রুতি ও কৃতি আমরা খুব ধীরে ধীরে, বিন্দু বিন্দু করেই বুঝতে পেরেছি l পুরো চেহারাটার কিছু অঙ্গ প্রতঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলাম, সাধারণ কিছু কিছু কথা বুঝতেও পারছিলাম, কিন্তু কাজের আত্মিক চেহারাটা অনুভব করি আরো আট, নয় বছর পরে। জয়সলমেরে গিয়ে সেখানে শ্রী ভগবান দাস মহেশ্বরী, শ্রী দীনদয়াল ওঝা এবং শ্রী জেঠু সিং ভাটির মতো সজ্জন মানুষদের সঙ্গ পেয়েই তা সম্ভব হয় l

জল সংগ্রহের ব্যাপারে রাজস্থানের জন-সমাজ বহু বছরের সাধনায় এবং নিজেদের সামগ্রীতেই যে গভীরতা ও উচ্চতাকে স্পর্শ করেছে, তার সঠিক তথ্য – প্রচুর বর্ষা হওয়ার পরেও তৃষ্ণার্ত থেকে যায় দেশের যে সমস্ত অঞ্চল সেসব জায়গায় অবশ্যই পৌঁছানো প্রয়োজন l সাথে সাথে এও মনে হয়েছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য মরুভূমিতেও এই কাজের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে l সেই সূত্রেই এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন মরুভূমি সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জোগাড় করি। কিছু প্রত্যক্ষ, কিছু পরোক্ষ সম্পর্কও গড়ে ওঠে l আজ প্রায় পৃথিবীর একশোটি দেশে মরুভূমি ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বড়লোক দেশের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক l এমনকী চাইলে পেট্রলের জন্য সম্প্রতি বড়লোক হওয়া উপসাগরীয় দেশগুলিকেও আমরা বাদ দিতে পারি l তবু এর পরও এশিয়া, আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকায় এমন অনেক দেশ পাওয়া যাবে, যেখানে মরুভূমিতে জলের, বিশেষ করে পানীয় জলের ভয়ংকর অভাব l চট করে একথা বিশ্বাস হয় না যে সেখানকার জনসমাজ দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে বসবাস করার পরও জল সংকটের সমাধানে তেমন কোনো বড় ধরনের কাজ করে উঠতে পারেনি, যেরকম রাজস্থানের মানুষেরা অনায়াসে করতে পেরেছে l সেখানকার জ্ঞানী গুণী মানুষেরা আর বিভিন্ন সংস্থাগুলো তো একথাই বলে যে, সে সব স্থানে জলের ব্যাপারে কোন ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থাপনা নেই l যদিও বা ছিল, পরাধীনতার দীর্ঘ সময় কালে সেসব ছিন্নভিন্ন ও বিনষ্ট হয়ে গেছে l

এসব দেশে মরুভূমির প্রসার আটকাতে সম্মলিত জাতিপুঞ্জের পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রমে এক বিরাট আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার রূপায়ণ চলছে l তাছাড়াও আমেরিকা, কানাডা নরওয়ে, হল্যাণ্ড, সুইডেন প্রভৃতি দেশের প্রায় আধ ডজন সংস্থা অনুদান হিসেবে প্রচুর টাকা এসব দেশে পানীয় জল জোগানোর উপায় বের করার জন্যই খরচ করছে l প্রচুর টাকার মালিক এসব সংস্থাগুলি এ কাজে নিজেদের দেশ থেকে পরিকল্পনা, পুঁজি, যন্ত্রপাতি, নির্মাণসামগ্রী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ পর্যন্ত সেখানে পাঠাচ্ছে l এমনকী বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সামাজিক কর্মী ও কর্মকর্তাও সেখানে যাচ্ছেন। জল সংগ্রহের এ হেন আন্তর্জাতিক প্রয়াসের এক বিচিত্র দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বটসোয়ানা দেশ l

আফ্রিকার মরু অঞ্চলের একটি গণরাজ্য হল বটসোয়ানা l ক্ষেত্রফল পাঁচ লক্ষ একষট্টী হাজার আটশো (5,61,800) বর্গকিলোমিটার; জনসংখ্যা আট লক্ষ সত্তর হাজার (8,70,000) l তুলনা করুন রাজস্থানের সঙ্গে l ক্ষেত্রফলটা আরেকবার আউড়ে নেওয়া যাক : তিন লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার (3,42,000) বর্গ কিলোমিটার l বটসোয়ানার থেকে অনেকটাই কম l জনসংখ্যা কিন্তু চার কোটি (4,00,00,000) l অর্থাত্ বটসোয়ানার জনসংখ্যার থেকে প্রায় পঞ্চাশ গুণ l বটসোয়াননার আশি শতাংশ অঞ্চল কালাহারি মরুভূমিতে পড়ে l

রাজস্থানের মরুভূমির তুলনায় বটসোয়ানার বর্ষার অবস্থা কিছুটা ভালোই বলা চলে l এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত পঁয়তাল্লিশ সেণ্টিমিটার l কালাহারি মরুভূমিতে পরিমাণ কিছুটা কমলেও, তা ত্রিশ সেণ্টিমিটারের কম নয় l আরও একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক যে, থর মরুভূমিতে এই পরিমাণটা মাত্র ষোলো থেকে পঁচিশ সেণ্টিমিটার l তাপমাত্রার দিক থেকেও কালাহারি থরের তুলনায় ভালো অবস্থাতেই আছে l সর্ব্বোচ্চ তাপমান ত্রিশ ডিগ্রি সেণ্টিগ্রেডের বেশি হয় না l থর মরুভূমি কিন্তু অনেক সময়ই পঞ্চাশ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলে l

অর্থাত বটসোয়ানায় জায়গা বেশি, লোক কম, বর্ষাও কিছুটা ভালো এবং তাপমাত্রাও কম l ফলে বটসোয়ানার সমাজ কিছুটা ভাল অবস্থায় আছে একথা বলাই যেতে পারে l অথচ আজ এখানে জলের সংকট ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে l আগে হয়তো এখানে জল সংগ্রহের কোনো উন্নত ঐতিহ্য ছিল, কিন্তু আজকে তার চিহ্নমাত্র পাওয়া যায় না l দুটো সমাজের এভাবে তুলনা করা খুব একটা ভাল কাজ নয়, তবুও যেটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, বটসোয়ানায় বেশি বৃষ্টি হলেও সেখানে সেই জল সংগ্রহ করে রাখার কোনো সমাজসিদ্ধ, স্বয়ং সম্পূর্ণ ঐতিহ্য দেখতে পাওয়া যায় না l

রাজস্থানের মতোই বটসোয়ানাতেও শতকরা পঁচাশি ভাগ মানুষ গ্রমে বাস করে l তবে একটা তফাত আছে এবং তফাত্টা জলের অভাবের জন্যই l বটসোয়ানার মানুষ সারা বছর একই বাড়িতে না থেকে ঘুরে ঘুরে তিনটি বাড়িতে বাস করে l একটি ঘর হল গ্রামে, দ্বিতীয়টি চারণ ভূমিতে, তৃতীয়টি হল গোশালায় l জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সবাই গ্রামে থাকে, তারপর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পশুচারণ ক্ষেত্রে এবং ফেব্রুয়ারি থেকে জুন গোশালায় l

এখানে রাজস্থানের মতো কুণ্ডি, কুঁই, টাঁকা প্রভৃতির উপস্থিতি অন্তত আজকের দিনে দেখা যায় না l বেশির ভাগ জল পাওয়া যায় কুয়ো থেকে এবং বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবে ভরে ওঠা পুকুরে l

যতাটা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা যায় যে, কানাডার একটি সংস্থার অনুদানের টাকায় উনিশশো পঁচাত্তর থেকে একাশির মধ্যে প্রথম বার বটসোয়ানায় জল সংগ্রহের জন্য কুণ্ডির মতো পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয় l এই প্রকল্পে সরকারের বড় বড় আধিকারিক, বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার ও জল বিশেষজ্ঞরা সেখানকার কিছু গ্রামে ঘোরেন l তারা খামারের আনাজ শুকানোর উঠোনগুলিকে কিছুটা ঢালু করে তার এক কোণায় গর্ত খুঁড়ে তাতে বর্ষার জল সংগ্রহ করেন l একশো ভাগ বিদেশি সহায়তা, অনেক দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসা নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে এখানে দশটি কুণ্ডি তৈরি হল l প্রত্যেকটির সর্ব প্রকার লাভ লোকসানের হিসেব সূক্ষ্মভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু হল l কুণ্ডিগুলি গোল না করে চৌকোভাবে বানানো হয় l চৌকো গর্তে মাটির চাপ চারপাশে থেকেই পড়ে তাই ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি l গোল না করে চৌকো করলে এতে পলেস্তরার ক্ষেত্রফলও বেশি হয় কিন্তু জল সংগ্রহের ক্ষমতা বাড়ে না l তাই সেইসব বিশেষজ্ঞরা এখন স্বীকার করছেন যে, ভবিষ্যতে কুণ্ডি চৌকো না করে গোল করাই ভাল l

যে গ্রামবাসীরা এই কুণ্ডিগুলি ব্যবহার করবে, এখন তাদের ‘সরকারী ভাষায়’ এর রক্ষণা বেক্ষণের কৌশলগুলো শেখানো হচ্ছে l কুণ্ডিতে যাতে জলের সাথে সাথে বালি না যায়, তারও ব্যবস্থা চলছে l বিশেষ এক ধরনের ছাঁকনি লাগানো হয়েছে l তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে কিছু অসুবিধাও আছে l প্রতি বছর এই ছাঁকনি পাল্টাতে হবে l কুণ্ডিগুলোর মুখে বসানো সিমেণ্টের ঢাকনাতেও ফাটল দেখা দিচ্ছে l তাই এই ঢাকনাগুলো পাল্টানোর কথাও চলছে; পাল্টানোর পর যে ঢাকনা লাগানো হবে সেগুলি গম্বুজাকৃতি করার কথা ভাবা হচ্ছে l

একই ভাবে ইথিওপিয়াতে আন্তর্জাতিক পাঁচটি সংস্থা জল সমস্যায় জেরবার গ্রামগুলিতে ছোট ছোট কুয়ো খোঁড়ার কাজ শুরু করেছে l ইথিওপিয়াতে ভৌমজল পেতে খুব একটা গভীরে যেতে হয় না l তাই কুয়োগুলিও কুড়ি মিটারের বেশি গভীর নয় l কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাছে সব থেকে বড় সমস্যা হল, কুয়োগুলির পলেস্তরা l মাটি ধ্বসে পড়ছে। তুলনা করুন রাজস্থানের সেই ষাঠি কুয়াগুলির সঙ্গে যেখানে তারা ষাট মিটারেরও বেশি গভীরে অনায়াসে চলে যায় l এদের পলেস্তরার সোজা, উল্টো ও ফাঁক পদ্ধতি না জানি কবে থেকে কার্যকর হয়ে আসছে l

ইথিওপিয়ায় এই ধরনের কুয়ো ছাড়াও অনেকগুলো হ্যাণ্ড পাম্প বসেছে l সোজা ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা থেকে ভালো হ্যাণ্ড পাম্প আসছে l একটা ভালো হ্যাণ্ড পাম্পের দাম পড়ে প্রায় ছত্রিশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজার টাকা l বলা হয় এই পাম্পগুলো খুবই টেঁকসই, বার বার খারাপ হয় না, ভাঙেও কম l প্রতিটি গ্রামে এত দামী পাম্প বসাতে সরকারের ধার নেওয়া টাকাও কম পড়ছে l তাই সস্তা হ্যাণ্ড পাম্পের খোঁজও চলছে l সেগুলোও অবশ্য কুড়ি হাজার টাকার কম নয় l এগুলো আবার তাড়াতাড়ি খারাপ হয় l এদিকে একটা থেকে আরেকটা গ্রামের দূরত্ব অনেক l যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত নয় l তাই পাম্পগুলোর সঠিক রক্ষণা বেক্ষণ শেখানোর জন্য সরকার গ্রামে গ্রামে প্রশিক্ষণ শিবির চালাতে তাদেরই কাছে অনুদান চাইছে - যেসব দেশ থেকে ঐ পাম্পগুলি কেনা হয়েছে l

তানজানিয়া দেশের মরুভূমি অঞ্চলেও বিদেশি সংস্থাগুলি একই ভাবে ‘শস্তা ও বিশুদ্ধ’ জল পাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে – গ্রামের সংকটজনক পরিস্থিতি সার্ভে করা হয়েছে, সার্ভের তথ্য গ্রাম থেকে জেলা, জেলা থেকে কেন্দ্র এবং কেন্দ্র থেকে আবার ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে, বিমান থেকে এরিয়াল ফটো তোলা হয়েছে, বিদেশী স্পর্শকাতর সব যন্ত্রে ভৌম জলের পরিস্থিতি বিচার করে মানচিত্র তৈরি হয়েছে l এত কিছুর পর এখানে প্রায় দু-হাজার কুয়ো কাটা হল, কুয়োগুলির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সরাসরি কুয়ো থেকে জল তোলা নিষিদ্ধ হল, কুয়োতে হ্যাণ্ড পাম্প বসল l এবার দেখা যাচ্ছে হ্যাণ্ড পাম্পগুলি বিভিন্ন কারণে খারাপ হচ্ছে l তাই এখন এখানে হ্যাণ্ড পাম্প ‘আরো উন্নত ব্যবহার’ প্রশিক্ষণের জন্য গ্রামীণ সংঘ তৈরি করা চলছে l হ্যাণ্ডপাম্প খারাপ হয়ে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যাতে গ্রাম ও জেলার মধ্যে দ্রুত খবর আদানপ্রদান করা যায়, সে জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন পরিকাঠামো l

কেনিয়ার বালুকাময় এলাকায় শুরু হয়েছে ছাতে, বর্ষিত বৃষ্টির জল সংগ্রহের কাজ l জল সম্পর্কিত যেসব আন্তর্জাতিক সেমিনার হয় তাতে জনগনের অংশগ্রহণ কেনিয়া সরকারের আমলারা উত্কৃষ্ট উদাহরণ রূপে তুলে ধরেন l

পৃথিবীর অন্যান্য যত মরু রাজ্য, যেমন - বটসোয়ানা, ইথিওপিয়া, মালাউই, কেনিয়া, সোয়াজিল্যাণ্ড কিংবা সহেলের মতো দেশগুলি কি এভাবেই নিজেদের জন্য জলের ব্যবস্থা করবে ? যদি এভাবে জল আহরণের সমস্ত উদ্যোগ ও প্রযুক্তিটাই বাইরের দেশ থেকে আসতে থাকে তাহলে কি তা দেশের একেবারে ভেতরের গ্রামগুলোর চাহিদা দীর্ঘ সময় ধরে মেটাতে পারবে ? সমাজের নিজস্ব প্রতিভা এবং কৌশল, নিজেদের দেহ, মন এবং সম্পত্তি সব কিছুই যদি অনুপস্থিত থাকে, সবই যদি বাইরের থেকে আসে তাহলে জলই বা কতদিন উপস্থিত থাকবে সেখানে?

এসব দেশের সঙ্গে তুলনা করুন রাজস্থানের l রাজস্থানের সমাজ উনিশশো পঁচাত্তর থেকে একাশি বা পঁচানব্বই সালের মধ্যে নয়, কয়েকশো বছর ধরে বৃষ্টির জলের রজত বিন্দুগুলিকে সংগ্রহ করে রাখার এক অনন্য ঐতিহ্য তিলে তিলে তৈরি করেছে l আর এই ঐতিহ্যেই কম করে কয়েক লক্ষ টাঁকা, কয়েক হাজার কুঁই এবং কয়েক হাজার ছোট -বড় পুকুর তৈরি হয়েছে, যার সমস্তটাই নিজেদের দেহ, মন এবং পুঁজি দিয়ে নির্মিত l এর জন্য কারো কাছেই তাঁরা হাত পাতেন নি l এই রকম বিবেকবান, স্বাবলম্বী সমাজকে শত শত প্রণাম l

Path Alias

/articles/sabaabalamabai-samaaja

Post By: Hindi
×