সাগরের আগর


পুকুর নিজেই একটি বড় শূন্যl


জলস্তম্ভ দিয়ে থাকে জলস্তরের খবর l আর পুকুরের গভীরতা মাপা হতো সাধারণত পুরুষ মাপ দিয়ে l দুই হাত দুই দিকে মেলে থাকা পুরুষের এক হাত থেকে অন্য হাত পর্যন্ত পুরো দৈর্ঘকে বলা হয় পুরুষ বা পুরুখ l

কিন্তু পুকুর পশুদের খুরে তৈরী এমন কোন গর্ত নয় যা বৃষ্টির জলে নিজে নিজেই ভরে উঠবে l এই শূন্যটিকে ভেবেচিন্তে সুক্ষ্মভাবে তৈরী করা হয় l ছোট বড় সকল পুকুরেরই কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে এবং প্রত্যেকটিরই একটি বিশেষ কাজ এবং নামও l এই নাম পুকুরের সঙ্গে সঙ্গে পুকুর প্রস্তুতকারী সমাজের ভাষা এবং রুচির সমৃদ্ধির প্রমান দেয় l কিন্তু সমাজ যেমন ধীরে ধীরে পুকুর বিষয়ে গরিব হতে লাগলো, ভাষা থেকে সে সব শব্দ, নামও উঠে যেতে লাগলো l

মেঘ ওঠে, ঘন হয়ে বৃষ্টি আসে, আর বৃষ্টি যেখানে পড়লো, সেখানে এমন একটা জায়গা থাকে যেখানে জল ধরে l একটা প্রক্রিয়া হলো- ‘আগৌরণা’, অর্থাত একত্র করা l এর থেকেই এসেছে আগৌর l আগৌর পুকুরের এমন অঙ্গ, যেখান থেকে পুকুরে জল আসে l এটা এমন ঢাল যেখানে বর্ষার জল একদিকে গড়িয়ে আসে l এর অপর এক নাম ‘পানঢাল’ l মধ্যপ্রদেশের কিছু জায়গায় আগৌরকে পৈঠু, পৌরা বা পৈন বলে l আর বই, খবরের কাগজ ও বিভিন্ন সংস্থাগুলিতে মিলে এই অঙ্গটির জন্য একটি নতুন শব্দ চালু করেছে – ‘জলাগমক্ষেত্র’ l শব্দটি ইংরাজী ক্যাচমেন্ট শব্দ থেকে অনুবাদ করা l বানানো l একদিক থেকে ভুলও l সংস্কৃত ‘জলাগম’-এর অর্থ বর্ষা ঋতু l

যেখানে জল এসে ভরবে তাকে পুকুর বলে না, তা হলো ‘আগর’ l পুকুরতো হলো সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আগাগোড়া যোগফল l আগর অর্থাত ঘর, কোষাগার১ l পুকুরের এই কোষাগার হলো আগর, সেখানে সবটুকু জল এসে জমা হবে l রাজস্থানে পুকুর ছাড়া অন্যত্রও এই শব্দটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় l রাজ্য পরিবহন বাসডিপোকেও আগর বলে l আগরা নামও আগর থেকে এসেছে l আগর নামে অনেক গ্রামও পাওয়া যাবে l

আগৌর ও আগর হলো পুকুরের দুটি প্রধান অঙ্গ l আলাদা আলাদা জায়গায় এগুলির আলাদা নামও রয়েছে l অনেক জায়গায় দেখা যায় এই শব্দগুলি মূল সংস্কৃত শব্দ থেকে সরতে সরতে সহজ মুখের ভাষায় পরিণত হয়েছে, আবার কোথাও এমন কি প্রকৃত গ্রামীন এলাকাতেও মুখের ভাষাকে সংস্কৃত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে l আগর কোথাও আব, তো কোথাও পয়তান অর্থাত যেখানে পুকুরের পা ছড়িয়ে রয়েছে l যেখানে এই ছড়িয়ে থাকা অংশ গুটিয়ে যায় তা হল আয়তন অর্থাত আগর l একে কিছু জায়গায় ভরাও বলা হয় l অন্ধ্রপ্রদেশে পৌঁছে এ আবার হয়েছে পরিবার প্রদেশম l আগৌর থেকে জল আসে আগরে l কোথাও আবার আগরের মাঝামাঝি কুয়োও খোঁড়া হয় এবং এই স্রোতেই পুকুরে জল হয় l একে বলা হয় ‘বোগলি’ l বিহারে এই রকম শত শত পুকুর রয়েছে বোগলি করা l বোগলির আরও এক নাম - চুহর l

জলের আগরকে তথা মূল্যবান কোষাগারকে রক্ষা করবে পাড় বা পাল l পাল শব্দ সম্ভবত পালক শব্দ থেকে এসেছে আকারে ছোট হলে ভীঁণ্ড l বিহারে ভীঁণ্ড-কে ভিঁণ্ডও বলা হয় l কোথাও আবার ‘মহার’ l ‘পুশ্তা’ শব্দ বোধহয় পরে এসেছে l কিছু জায়গায় এটা আবার পার l নদীর পারের মতই ধারের অর্থে l পারের সঙ্গে আরও রয়েছে – আর; পারও পুকুরের এই পার থেকে ঐ পারকে আর-পার অথবা পার-আর, বদলে পারাওয়ার বলা হয় l আজ পারাওয়ার শব্দ পুকুর বা জল থেকে সরে গিয়ে আনন্দের মাত্রা বোঝাতে ব্যবহার হচ্ছে l কিন্তু প্রথমে এটি আনন্দেরই পারওয়ার ছিলো বোধহয় l

পাড় বা পাল মজবুত হবে, কেননা সে পুকুরের রক্ষাকর্তা l তবে এই রক্ষাকর্তারও রক্ষাকারী চাই তা না হলে আগৌর থেকে ক্রমান্বয়ে বয়ে আসা জল আগর ভরিয়ে, না জানি কখন উপচে যাবে l আর তখন জলের প্রচণ্ড শক্তি ও গতিবেগ পাড় ভেঙ্গে ফেলতে পারে l পুকুরকে এই ভাঙ্গনের হাত থেকে বাঁচায় ‘অফরা’ l আগর তো হলো পুকুরের পেট l এটা একটা সীমা পর্যন্ত ভরতেই হবে l তবেই তো সারা বছর পুকুরের কোন মানে হয় l আবার এই সীমা পেরিয়ে গেলেও পাড়ের বিপদ l পেট পুরো ভরে গেছে, অতিরিক্ত হয়ে গেলে তা তো খালি করতেই হবে l এ কাজটি করে অফরা l

এই অঙ্গের অনেক নাম l অফরা, কোথাও কাথাও হয়ে যায় অপরা l উপরা, ওবরাও রয়েছে l সম্ভবত উবর, উবরনে, বাঁচে – বাঁচানোর অর্থ থেকে এসেছে l রাজস্থানে এ সব নামগুলোই প্রচলিত রয়েছে l ভালো বৃষ্টি হয়েছে l পুকুরে এত জল হয়েছে যে অপরা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে – একে বলা হয় ‘অপরা চলা’ l মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশর কয়েক জায়গায় একে চাদর চলাও বলা হয় l ছত্রিশগড়ে এই অঙ্গকেই আবার বলা হয় ‘ছলকা’ l পাড় না ভেঙ্গে জল যেখান থেকে ছলকে বেরিয়ে যায় l

এই অঙ্গের পুরনো নাম ছিল উচ্ছ্বাস l ছেড়ে দেওয়ার অর্থে l নিকাশ থেকে নিকাশিও বলা হয় l অবশ্য শুদ্ধ সংস্কৃত থেকে এসেছে নেষ্টা l রাজস্থানের থর এলাকার জয়সলমের, বিকানের, প্রভৃতি জায়গায় গ্রামে বা শহরে এটি এক মাত্রাও না হারিয়ে নেষ্টা নামেই প্রচলিত রয়েছে l সীমা পার করে সিন্ধু প্রদেশেও একই নাম প্রচলিত l এটি দক্ষিণে ‘কালঙ্গল’ তো বুন্দেলখণ্ডে ‘বগরণ’ অর্থাত যেখান থেকে পুকুরের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় l

প্রথম বছর নেষ্টা ছোট করা হয় l অর্থাত অনেকটা নীচে l প্রথম বছর পাড়ও জলপান করবে, কিছু ধ্বসে পড়বে সুতরাং পুকুরে বেশী জল আটকানোর লোভ করতে নেই l যদি এক বছরেই সব ঠিক হয়ে যায় তাহলে পরের বছর নেষ্টা কিছুটা ওপরে ওঠানো হয় l তখন পুকুর বেশী জল আটকাতে পারবে l নেষ্টা মাটির কাঁচা পাড়ের কম উঁচু অংশ l কিন্তু জলের প্রধান চাপটাই সহ্য করে নেষ্টা l তাই এটিকে পাকা অর্থাত পাথর, চুনের করা হয় l নেষ্টার পাশের দুই দিকের পাড় অর্ধবৃত্তাকার হয় যাতে জলের বেগ সেখানে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে যায় l এই অর্ধবৃত্তাকার অঙ্গের নাম ‘নাকা’ l নাকা যদি পুকুরের বদলে বাঁধে করা হয়, অর্থাত কোন ছোট নদী বা নালার প্রবাহকে আটকানোর জন্য করা হয় তখন তাকে ‘ওড়’ বলে l আবার আকৃতি খানিকটা ডানার মতো হয় বলে কোথাও কোথাও একে পাখা-ও বলা হয়েছে l

নেষ্টা অবশ্যই একটি টেকনিক্যাল অঙ্গ l কিন্তু কোথাও কোথাও এমন নেষ্টাও তৈরী হয়েছে যা সব কিছু ছাপিয়ে শিল্প হয়ে উঠেছে l যে সকল সিদ্ধহস্ত গজধরদের বর্ণনা আমরা করলাম তাদের হাতে বারে বারে এই শিল্প সৃষ্টি হয়েছে l রাজস্থানের যোধপুর জেলার এক ছোট্ট শহর ফলৌদি l সেখানে শিবসাগর নামে পুকুর রয়েছে l এর ঘাট তৈরী করা হয়েছে লাল পাথর দিয়ে l সোজা সরলরেখায় চলতে থাকা ঘাট হঠাতই সর্পিল আকার ধারণ করে l এই আকৃতি কোন প্রকার টেকনিক্যাল গাম্ভীর্য ছাড়াই, খেলার ছলে অতিরিক্ত জল বাইরে বার করে দিয়ে বড়ই শৈল্পিকভাবে শিবসাগরকে রক্ষা করছে l

ফিরে আসি আগৌরে l আগৌর থেকেই জল আসে আগোরে l শুধু জলই আসা চাই, বালি ও মাটিকে আটকাতে হবে l এইজন্য আগৌরের জলের ছোট ছোট ধারাগুলিকে এদিক ওদিক খেকে ঘুরিয়ে কিছু মূখ্য পথ দিয়ে আগরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুকুরে পৌঁছানোর অনেক আগেই এই ধারাগুলিতে খুরা লাগিয়ে দেওয়া হয় l সম্ভবত শব্দটি পশুর খুর থেকেই এসেছে l এর আকারও খুরের মতোই হয় l বড় বড় পাথর এমনভাবে জমানো হয় যে তার মাঝ দিয়ে শুধু জলই বোরিয়ে আসে মাটি, বালি পিছনে জমা হয়ে যায় l আলাদা হয়ে যায় l

মরুভূমি অঞ্চলে বালির মাত্রা সমভূমি অঞ্চল থেকে অনেক বেশী l তাই মরুভূমিতে খুরা অনেক বেশী বাস্তব সম্মত l কাঁচার বদলে পাকাও করা হয় l পদ্ধতিগতভাবে পাথরের গারা চুন দিয়ে জমিয়ে একটা ছোট্ট মতো দোতলা পুল তৈরী করা হয় যাতে ওপরের তলার জানালা বা ছিদ্র দিয়ে জল আসে l

এই ছিদ্রের নীচে এক নালা যায় l এখানে সমস্ত ভার (বালি, কাঁকর, মাটি প্রভৃতি) ফেলে রেখে পরিস্কার জল, পরের তলার ফুটো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আগরের দিকে এগিয়ে চলে l কয়েক প্রকার উঁচু-নীচু, ছোট-বড় ছিদ্র দিয়ে জল ছেঁকে আগরে পাঠানোর এ প্রক্রিয়াকে ছেদি বলে l

এইভাবে আটকে রাখা বালি, মাটিরও কয়েক প্রকার নাম দেওয়া হয়েছে l কোথাও এর সাদ, কোথাও পাদ, কোনখানে লদদি, তো কোথাও তলছট l সমস্ত সাবধানতা নেওয়ার পরও প্রতি বছরই জলের সাথে কিছু না কিছু মাটি এসে আগরে পড়ে l এই মাটি বার করারও বাস্তবসম্মত উপায় ও সময় রয়েছে l সেকথা পরে l এখন একবার পাড়ে যাওয়া যাক l পাড় কোথাও সোজা, কোথাও অর্ধচন্দ্রাকার কোথাও আবার দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো করা হয় l কোথাও তাতে আমাদের হাতের কনুই-র মতো মোড় থাকে l এই মোড়কে কোহনী বলে l আগৌর থেকে আসা জল পাড়ের যেখানে ধাক্কা লাগতে পারে সেখানে পাড়ের শক্তি ও স্থায়িত্ব বাড়াতে কোহনী দেওয়া হয় l

যেখানে সম্ভাবনা ও সামর্থ আছে সেখানে পাড় ও জলের মাঝখানে পাথরের পাট লাগনো হয় l পাথর যে পদ্ধতিতে জোড়া দেওয়া হয় তাকে জুহানা বলে l ছোট পাথর গারায় জোড়া হতো আর সেই গারার মধ্যে বালি, চুন, বেল (বেলপাতা) গুড়, গঁদ, মেথি মেশানো হতো l কোথাও কোথাও ধুনোও l বড় ভারী পাথর জোড়া দেওয়ার পদ্ধতি ছিল কিল ও ছেদ l একটা বড় পাথরের ছেদ বা ফুটো করে দ্বিতীয়টাতে ঐ আকারেরই কিল তুলে দেওয়া হতো l কখনো কখনো বড় পাথর জোড়া দেওয়া হতো লোহার পাত দিয়ে l এই রকম পট্টিকে বলা হতো জোঁকা বা আকুণ্ডি l পাথরের পাট পাড়ের মাটিকে আগরে যেতে বাধা দেয় l পাথর দিয়ে ঘেরা এই ক্ষেত্রকে বলে পঠিয়াল l পঠিয়ালে সুন্দর মন্দির, ছত্র ও ঘাট করার প্রচলন রয়েছে l

পুকুর বা ঘাটের আকার খুব বড় হলে ঘাটে পাথরের সিঁড়ি করা হয় l যদি পুকুর খুবই বড় ও গভীর হয় তাহলে সিঁড়ির দৈর্ঘ্য ও সংখ্যাও সেই অনুপাতে বাড়বে l এক্ষেত্রে পাড়ের মতো সিঁড়িও মজবুত করার জন্য হথনি করা হয় l হথনি হল প্রতি আট বা দশ সিঁড়ি অন্তর একটা করে বারান্দার মতো চওড়া সিঁড়ি l তা না হলে জলের বেগ সিঁড়ি ফাটিয়ে দিতে পারে l এই রকমই কোন হথনির দেওয়ালে তাক করে তাতে ঘাটৈয়াবাবার প্রতিষ্ঠা করা হয় l ঘাটৈয়াবাবা ঘাটের দেখাশোনা করেন l সাধারণভাবে ঘাটৈয়াবাবা প্রতিষ্ঠিত হন অপরার উচ্চতার হিসেবে l যদি বৃষ্টি বেশি হয়, আগৌর থেকে জল লাগাতার আগরে আসতে থাকে, পুকুরের বিপদ ঘনিয়ে আসে তাহলে ঘাটৈয়াবাবার চরণ পর্যন্ত জল আসার পর অপরা বইতে শুরু করবে l জল আর বাড়বে না l এইভাবেই মানুষ ও দেবতা উভয়ে মিলে ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ করবে l

পুকুরের মতো নদীতেও ঘাটৈয়াবাবা স্থাপিত হয়েছেন l বুড়ো-বুড়ি, ঠাকুরদা-ঠাকুরমা যাঁরা নিজেরা ঘাটে যেতে পারেন না, (বন্যার সময়) তাঁরা ঘাট ফেরত নাতি-নাতনি, ছেলে-মেয়েদের খুব উত্সাহের সঙ্গে এই প্রশ্নটাই করেন – ‘জল কতদূর বেড়েছে, ঘাটৈয়াবাবার চরণ পর্যন্ত এসেছে?’ জলে তার পা ধোয়া গেলেই হলো l এতটা জল যদি আগরে জমা হয় তাহলেই সারা বছরের কাজ চলবে l

আগরের ভেতর আলাদা আলাদা জায়গায় স্থাপিত স্তম্ভ সারা বছর ধরে আগরের জলরাশিকে, কোষাগারকে পরিমাপের কাজ করে l নাগযষ্ঠী খুবই পুরোনো শব্দ l এটি কাজে লাগে সাধারণত নতুন খোঁড়া পুকুরের জলস্তর মাপার জন্য l এর ওপর সাধারণত সাপ প্রভৃতি মূর্তি খোদাই করা হয় l যেটাতে নাগের অলঙ্করণ থাকে না সেটাকে শুধু যষ্ঠীই বলা হয় l ধীরে ধীরে সরতে সরতে এই শব্দই হয়ে যায় ‘লাঠ’ l স্তম্ভ, জলস্তম্ভ বা শুধু থামও বলা হয় l কোথাও আবার পনসাঁল অথবা পৌসরাও বলা হয়েছে l এই স্তম্ভ শুধু পুকুরের আগরেই নয়, বিভিন্ন অঙ্গে বসানো হয়ে থাকে l বসানোর সময়ও আলাদা এবং প্রয়োজনও বিভিন্ন প্রকারের l

স্তম্ভ-পুকুরের মাঝামাঝি, অপরাতে, মোখিতে অর্থাত যেখান থেকে সেচ হয় এবং আগৌরেও বসানো হয় l স্তম্ভ, জল পরিমাপের কাজে লাগে ঠিকই তবে এতে গজ, ফুট প্রভৃতি নীরস চিহ্নের বদলে পদ্ম, শঙ্খ, নাগ, চক্র-র মতো চিহ্ন জলের এক নিশ্চিত গভীরতার ইঙ্গিত দেয় l সেচের জন্য যে পুকুর, তার স্তম্ভের এক বিশেষ চিহ্ন পর্যন্ত জল নেবে গেলে জলের ব্যবহার তখনই বন্ধ করে দেওয়া হবে, বাকি জলটুকু অসময়ের জন্য সুরক্ষিত করে রাখা হবে l পাড়েও স্তম্ভ লাগানো হয় কিন্তু পাড়ের স্তম্ভ ডোবার অর্থ প্রলয় আসছে l

স্তম্ভ পাথরের হতো আবার কাঠেরও l কাঠের জাত এমনভাবে বাছা হত যাতে জলে নষ্ট না হয়ে যায় l এইরকম কাঠের এক পুরোনো নাম ক্ষত্রীয় কাষ্ঠ l স্তম্ভর জন্য সবসময় জাম, শাল, তাল প্রভৃতি কাঠের ব্যবহার হয়েছে l এগুলির মধ্যে শালের স্থায়িত্বর জন্য এমন কিছু প্রবাদ চালু ছিল যা আজও হারিয়ে যায়নি l শাল সম্পর্কে বলা হয়- হাজার সাল খাড়া, হাজার সাল পড়া, হাজার সাল সড়া’ l ছত্রিশগড়ের অনেক পুকুরে আজও শালের স্তম্ভ পাওয়া যায় l রায়গড়ের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালায় শাল গাছের হাজার বছরের পুরোনো একটা টুকরো সত্যি সত্যিই, যেন প্রবাদের জগত থেকে বের করে এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে l এটা একটি জলস্তম্ভের অংশ যা ঐ এলাকারই চন্দ্রপুর, অধুনা বিলাশপুর জেলার, কিরাণি গ্রামে হীরাবাঁধ নামক পুকুর থেকে পাওয়া গেছে l হীরাবাঁধ দ্বিতীয় শতাব্দীরও আগে সাতবাহণ রাজার সময়ের তৈরী স্তম্ভটির উপর রাজ্যের শাসনকর্তাদের নাম খোদাই করা আছে l সম্ভবত যাঁরা ঐ পুকুর ভর্তি উত্সবের সময় উপস্থিত ছিলেন নামগুলি তঁদেরই l

পরিস্থিতি না বদলালে কাঠ খারাপ হয় না l স্তম্ভ সবসময় জলেই ডুবে থাকত l তাই বছরের পর বছর কেটে গেলেও খারাপ হত না l

কোথাও কোথাও পাড় বা ঘাটের পুরো দেওয়ালে ভিন্ন উচ্চতায় ভিন্ন ধরেণর মূর্তি খোদাই করা হতো l এগুলির আকার দেওয়া হতো প্রায়ই মাথার মতো l সবার নীচে ঘোড়া ও সবার ওপরে হাতি l পুকুরে বেড়ে ওঠা জল পর্যায়ক্রমে এই মূর্তিগুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে উঠত আর সকলেই জানতে পারতেন জল কতটা ভরেছে l এইরকম স্থাপত্যের অমর উদাহরণ জয়সলেমেরের অমরসাগরের দেওয়ালে খোদিত ঘোড়া, হাতি ও সিংহের মূর্তিগুলি l

স্তম্ভ ও নেষ্টা একটিকে অন্যটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়াতে দেখতে লাগে চমত্কার l আলোয়ার থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে আরাবল্লী পাহাড়ের ওপর জনবসতি থেকে অনেক দূরে একটি পুকুর রয়েছে – শ্যামসাগর l এটা সম্ভবত পনেরোশো সতাব্দীতে যুদ্ধের সময় সৈনিকদের প্রয়োজনে তৈরী করা হয়েছিল l এর পাড়ে বরুণ দেবতার একটা স্তম্ভ আছে l স্তম্ভের উচ্চতার হিসেবে তার থেকে এক ফালং দূরত্বে শ্যামসাগরের অপরা l আগরে বেড়ে ওঠা জল বরুণ দেবতার পা ছোঁয়ামাত্র অপরা বইতে শুরু করে l পুকুরে এর থেকে বেশি জল ভরে না l বরুণ দেবতা কখনও ডোবেন না l

জলস্তম্ভ দিয়ে থাকে জলস্তরের খবর l আর পুকুরের গভীরতা মাপা হতো সাধারণত পুরুষ মাপ দিয়ে l দুই হাত দুই দিকে মেলে থাকা পুরুষের এক হাত থেকে অন্য হাত পর্যন্ত পুরো দৈর্ঘকে বলা হয় পুরুষ বা পুরুখ l ইন্চি ফুটের মাপে এই মাপ হয় ছয় ফুট l এইরকম কুড়ি পুরুখ গভীরতার পুকুরকে মনে করা হতো আদর্শ পুকুর l পুকুর যাঁরা তৈরী করতেন তাঁদের ইচ্ছে থাকতো এই বিশিকে ছোঁয়ার l কিন্তু তাদের সামর্থ ও আগর-আগৌরের ক্ষমতা অনুসারে এই গভীরতা কম-বেশি হতো l

সাধারণত বিশি বা তার থেকেও গভীর পুকুরগুলিতে তরঙ্গের বেগ ভাঙ্গার জন্য আগরের মাঝে টাপু (দ্বীপ) করা হতো l তা ছাডা়ও এই ধরেণর গভর পুকুর খোঁড়ার সময় প্রচুর মাটি উঠতো l পাড়ের প্রয়োজন মিটিয়েও মাটি বেঁচে যেতো l কিন্তু এতো মাটি বাইরে দূরে কোথাও বয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলাও কঠিন l তাই টেকনিক্যালি ও ব্যবহারিক উভয় কারণেই পুকুরের মাঝে দ্বীপের মতো এক বা একাধিক স্থান ছেড়ে দেওয়া হতো l প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটি এর ওপর ঢালা চলতো l এ সব সুবিধার কথা বাদ দিলেও কানায় কানায় ভরে ওঠা পুকুরের মাঝে উঁচু হয়ে থাকা এই দ্বীপ দৃশ্যতঃ মনোরম l

টাপু, টিপুয়া, টেকরি ও দ্বীপের মতো শব্দ তো এই অঙ্গটির জন্য পাওয়া যায়ই l কিন্তু রাজস্থানে এই বিশেষ অঙ্গটিকে একটি বিশেষ নাম দেওয়া হয়েছে- লাখেটা l

লাখেটা ঢেউয়ের গতিকে বাধা দেয় l এ ছাডা়ও সে পুকুর ও সমাজকে যুক্ত করে l যেখানে লাখেটা পাওয়া যায়, দেখা যায় তার ওপর সেই এলাকার কোন সিদ্ধ পুরুষ, সতী বা স্মরণযোগ্য ব্যক্তির, স্মৃতির উদ্দেশ্যে সুন্দর ছত্র রয়েছে l লাখেটা বড় হলে ছত্রের সঙ্গে খেজুরি ও অসত্থ গাছও পাওয়া যায় l

সব থেকে বড় লাখেটা l আজ এই লাখেটার ওপর রেল স্টেশান, বাস স্ট্যাণ্ড- পরিকল্পিত এক শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে l যেখানে হিন্দুস্থান ইলেকট্রোগ্রাফাইটের মতো কারখানা গড়ে উঠেছে l মধ্য রেলওয়ে দিয়ে ভূপাল হয়ে ইটারসি যাওয়ার পথে মণ্ডি দ্বীপ নামক স্থানে এক সময় ভূপাল পুকুরের লাখেটা ছিলো l কোনো এক সময় প্রায় দুশো বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই পুকুর, হুসেনশাহের আমলে ভেঙ্গে দেওয়া হয় l আজ সে পুকুর শুকিয়ে যাওয়াতেই মণ্ডিদ্বীপ, দ্বীপ না থেকে এক শিল্পনগরী হয়ে উঠেছে l

‘­­­­প্রানালী’ ও ‘সারণী’ পুকুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা দুটি শব্দ l শব্দ দুটি নিজেদের অর্থের বিস্তার ঘটিয়েছে ক্রমাগত l এক সময় শব্দগুলি পুকুর প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত সেচের জন্য তৈরী নালার নাম ছিল l আর এখনতো শাসনের জন্যও প্রনালী রয়েছে এবং সময় ‘সারণী’র কথাও আমার জানি l

সেচের প্রথম নালা যেখান থেকে বের হয় তা হলো মুখ, মোখা বা মোখী l মুখ্য নহর বা ‘রজবহা’-ও বলা হয় l খুবই বিশিষ্ট পুকুরের রজবহা মর্তলোকের রাজ্য পেরিয়ে দেবলোককেও ছুঁয়ে ফেলতো, তখন একে বলা হতো রামনাল l জয়সলমেরের ধূত মরুভূমি এলাকায় সাজানো-গোছানো লুন্দর বাগান- ‘বড়াবাগ’ l বড়াবাগের সেচ জৈতসর নামের এক বড় পুকুর থেকে বেরোনো রামনাল থেকেই হয়ে চলেছে l এখানকার আমবাগানসহ অন্যান্য বাগান এতো ঘন সবুজ যে মরুভূমিতে আগুন বর্ষনকরী সূর্য যদি বড়াবাগে এসেও থাকে, তো তবে তা সবুজ রঙ-এ ডুবে শীতল হওয়ার জন্যই l

রজবহা থেকে বেরিয়ে আসা অন্য নহরগুলিকে বহতল, বহিয়া, বহা এবং বাহ-ও বলা হয় l জল বয়ে চলা রাস্তার ওপর যে বসতি গড়ে উঠেছে তারও নামকরণ করা হয়েছে এরই অনুসঙ্গে l কোন অংশ থেকে এপার ওপার বার করা নালির মুখ পুকুরের দিকে ডাট লাগিয়ে বন্ধ করে রাখা হয় l যখন জল বার করার প্রয়েজন তখন ডাট খুলে দেওয়া হয় l তাহলেতো কাউকে জলে ঝাঁপ দিতে হবে l কেননা ঐ তলায় গিয়ে ডাট খুলতে হবে এবং একইভাবে বন্ধ করতে হবে l এই কাজকেই সহজ করে দেয় ডাট নামক অঙ্গ l ডাট পাড়ের থেকে পুকুরের ভিতর দিকে, ছোট্ট কিন্তু গভীর চৌবাচ্চার ঢং-এ তৈরী l এ বর্গাকার চৌবাচ্চা সাধারণত দুই থেকে তিন হাতের হয় l জলের দিকের দরজাতে উচ্চতা অনুসারে আলাদা আলাদা দু-তিনটে ফুটো থাকে l ফুটোর আকার হয় এক বিঘত বা ততোটাই যতটা একটা বড় লাঠি দিয়ে বন্ধ করা যায় l সামনের দেওয়ালেও এই ধরেণর ফুটো থাকে কিন্তু শুধুমাত্র নীচের দিকে l এই ফুটো পার করে পাড়ের অপর দিকের নালি দিয়ে দল বাইর নিয়ে যাওয়া হয় l চৌবাচ্চার উচ্চতা হয় আট থেকে বারো হাত এবং নীচে নামার জন্য দেওয়ালে এক হাত পরপর ছোট ছোট পাথর গাঁথা থাকে l এই ব্যবস্থার জন্য ডাট ফুলতে জলে নামতে হয় না l পাথর দিয়ে শুকনো টৌবাচ্চায় নেমে যে ফুটোটা খুলতে হবে তার ডাট সরিয়ে জল ছেড়ে দিলেই হলো l পাড়ের দিকের নালি বেয়ে জল বাইরে আসে l এই ডাটের মতোই স্থাপত্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং গোয়াতে পর্যন্ত পাওয়া যায় l নাম অবশ্যই পাল্ট যায় l যেমন- চুকরৈণ্ড, চুরণ্ডি, চৌণ্ডা ও উরৈণ্ড l প্রত্যেকটি জল বাইরে আসার প্রক্রিয়া, তাই প্রতিটি নামেই উণ্ডেলনে (তরল পদার্থ ঢালা) শব্দটির আংশিক উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় l

পুকুর থেকে নহর বা নালায় যে জল ছাড়া হয় তা গড়ান দিয়ে দূরে দূরে বয়ে যায় কন্তু কিছু বড় পুকুরে যেখানে মোখির পাশে জলের চাপ খুব বেশি সেখানে এই চাপকে, নহরের ওপরে জল তোলার কাজে ব্যবহার করা হয় l মোখি থেকে বেরিয়ে আসা জল কয়েক হাত ওপরে উঠে আবার নহরের ঢালুতে অনেক দূর পর্যন্ত শুধু বয়ে যায় তাই নয়, কিছুটা ওপরের জমিতেও গিয়ে পৌঁছায় l

প্রধান নহরের দুইদিকে কিছু দূরে দূরে কুয়োও করা হয় l এতে কপিকল লাগিয়ে জল তোলা হয় l পুকুর, নহর এবং কুয়ো ও কপিকল এই চারের সুন্দর মিলন একের পর এক ক্ষেতকে সেচের সঙ্গ যুক্ত করে নিত l এই ব্যবস্থা বুন্দেলখণ্ডে চন্দেলো- বুন্দেলোর সময় তৈরী এক এক হাজার একরের বরুয়াসাগর, অরজরসাগর-এ আজও কাজ করছে l ওরছার রাজা উদিত সিংহ, বরুয়াসাগর তৈরী করিয়েছিলেন ১৭৩৭ সালে এবং ১৬৭১ সালে সুরজন সিংহ, অরজরসাগর তৈরী করান l এই নহরগুলি আজ উত্তর প্রদেশের সেচ দপ্তরের সুমান বৃদ্ধি করছে l

সমস্ত ব্যবস্থার পরও যদি জল চুরি বন্ধ না করা যায়, তাহলে দেখতে দেথতেই ভালো ভালো বড় পুকুরও শুকিয়ে যাবে l বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ, শরত-এর ঝকঝকে নীল রং-এ ডুব দেওয়া শিশিরে শীতল হওয়া, বসন্তে নেচে ওঠা কিন্তু তারপর গরমে ? জলন্ত সূর্য পুকুরের সব জল টেনে নেবে l সম্ভবত এই পুকুর প্রসঙ্গেই সূর্যের আর এক নাম রাখা হয়েছিলো ‘জলচোর’ (অম্বুতস্কর)l সূর্যের মতো চোর এবং আগর অর্থাত কোষাগার বিনা পাহারায় পড়ে থাকলে চুরি হতে আর কতো দেরী!

এই চুরি ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয় আগর ঢালদার করে l জল যখন কমে আসে তখন এই কম পরিমাণ জল বেশী জায়গায় ছডি়য়ে থাকলে তা তাড়াতাড়ি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে l তাই আগর ঢালু হলে জল কম জায়গায় জমে থাকবে l ফলে জল তাড়াতাড়ি বাষ্প হয়ে যেতে পারবে না l ঢালু স্তরে কিছুটা গভীরতাও রাখা হয় l এইরকম গভীর গর্তকে আখড়া বা পিয়াল বলে l বুন্দেলখণ্ডে একে বলা হয় ভর l কোথাও কোথাও এটির বাণ্ডারৌ বা গর্ল নামেও পরিচিতি হয়েছে l পুকুরের এই অঙ্গের স্থান রাখা হয় প্রধন ঘাটের দিকে অথবা মাঝখানে l মাঝখানে গর্ত থাকলে গরমের দিনে পুকুর চারদিক থেকে শুকিয়ে আসবে l এই অবস্থায় জল ঘাট থেকে সরে আসবে, এটা দেখতেও ভালো লাগে না, ব্যবহারেও অসুবিধা l তাই প্রধানত মুখ্য ঘাটের দিকেই ঢাল রাখার প্রচলন বেশি l তখনো তিন দিক থেকে কিছুটা জল চুরি হতেই থাকে কিন্তু মূখ্য বাহুতে জল থাকে সবসময়ই l

গ্রীষ্ম শেষ হতে না হতেই মেঘ জমতে শুরু করে, আগৌর থেকে আগর ভরে, সাগরে ঢেউ ওঠে l

সূর্য জল চুরি করে আবার সূর্যই জল ভরিয়ে দেয় l

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishraa in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bunddelkhand, Tanks in Rajasthan, Simple living and High Thinking, Honest society
Path Alias

/articles/saagaraera-agara

Post By: Hindi
×