প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের গল্পটার কথাই মনে পড়ে ও প্রসঙ্গে l প্রতিদিন মাত্র দু-তিন ঘড়া মিষ্টিজল কুঁই থেকে পাওয়া যায় l
‘কুঁই’-এর ভিতর কাজ করেছে ‘চেলওয়াজি’ l ঘামে ভিজে গেছে তার শরীর। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ হাত গর্ত হয়ে গেছে l এবার গর্ত যত গভীর হতে থাকবে, গরমও তত বেড়ে চলবে l কুঁই-এর ব্যাস অর্থাত্ ঘের খুবই সংকীর্ণ হয় l উবু হয়ে বসে থাকা চেলওয়াজির পিঠ ও বুকের থেকে কুঁই- এর দেওয়াল মাত্র এক হাত দূরে l এই সংকীর্ণ জায়গায় গাঁইতি বা টামনা দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করা যাবে না, তাই খোঁড়া হচ্ছে বাঁসলা দিয়ে l ‘বাঁসলা’, টামনার মতোই দেখতে তবে টামনার তুলনায় এটি আকারে ছোট এবং এর হাতলটিও হয় ছোট l বাঁসলার ফলাটা হয় লোহার, হাতল কাঠের lকুঁই-এর ভিতর খোঁড়ার কাজ একে তো পরিশ্রমের, তার ওপর আবার প্রচণ্ড গরম l এই গরম কাজের ওপর প্রভাব ফেলে l গরম কমানোর জন্য ওপরে যারা রয়েছে তারা কিছুক্ষণ পর পর মুঠো মুঠো বালি, জোরে জোরে কুঁইয়ের ভেতরে ছুঁড়তে থাকে l এতে খানিকটা টাটকা হাওয়া ওপর থেকে নিচে নেমে যায় এবং নীচের দমবন্ধ করা কিছুটা গরম হাওয়া ওপরে উঠে আসে l নীচে চেলওয়াজি একা কাজ করে চলেছে l ওপর থেকে ছোঁড়া বালি তার মাথায় লাগতে পারে তাই সে মাথায় পরে রয়েছে কাঁসা বা পিতলের টুপির মতো কোনো পাত্র। কিছুটা খোঁড়া হতেই চেলওয়াজির চার পাশে মাটি, বালি জমে উঠেছে l ওপর থেকে দড়ি বাঁধা ছোট বালতি নামিয়ে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে l যতই সাবধানতার সঙ্গে দড়ি টানা হোক না কেন তোলার সময় কিছু বালি ও কাঁকর পড়তেই পারে l মাথায় বসানো ধাতব টুপি মাথাকে এই আঘাত থেকে বাঁচিয়ে থাকে l
কুঁই খোঁড়া এবং তাতে বিশেষ এক ধরনের পলেস্তরা লাগানোর দক্ষতম লোকই হল ‘চেলওয়াজি’ বা ‘চেজারো’। চেজারো যে ‘কুঁই’ তৈরি করে তা মোটেই কোনো সাধারণ স্থাপত্য নয় l কুঁই হল খুবই ছোট কুয়ো। কুয়ো হল পুংলিঙ্গ, কুঁই স্ত্রীলিঙ্গ l কুঁই অবশ্য শুধু ব্যাসেই ছোট, গভীরতায় কিন্তু কারো থেকে কম নয়, তবে তারতম্য হয়ে থাকে l হয়তো এর বিশেষ কোন কারণ রয়েছে এবং তাই রাজস্থানের এক এক স্থানে কুঁইয়ের গভীরতা এক এক রকম দেখা যায় l
আরও এক অর্থে কুয়োর থেকে কুঁই সম্পূর্ণ আলাদা l কুয়ো তৈরি হয় ভৌমজল পাওয়ার জন্য, কুঁই কিন্তু ভৌমজলের সঙ্গে ঠিক সেভাবে সম্পর্কিত নয় l এটি বর্ষার জলকে, বর্ষা ছাড়া অন্যান্য ঋতুতেও বড়ই অপূর্ব ও বিচিত্র ভাবে সংরক্ষণ করে l অর্থাত্ কুঁই-তে যে জল পাওয়া যায় তা বৃষ্টির পর মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলও নয়, আবার ভৌমজলও নয় l এ যেন সেই নেতি-নেতি সংক্রান্ত দার্শনিক সমস্যার মতো প্যাঁচালো ব্যাপার l মরুভূমিতে বালির গভীরতা ও বিস্তৃতি সীমাহীন l এখানে যদি বৃষ্টি বেশি পরিমাণেও হয় তাহলেও তা বালির তলায় চলে যেতে সময় লাগবে না, কিন্তু মরুভূমিতে কোথাও কোথাও বালির তলায় এই দশ পনেরো হাত নীচ থেকে পঞ্চাশ ষাট হাত পর্যন্ত খড়িয়া নামক এক ধরনের পাথরের স্তর চলে গেছে l এই স্তর যেখানেই রয়েছে, সেখানে তা বেশ লম্বা-চওড়া, বিস্তৃত l তবে বালির তলায় চাপা থাকার জন্য ওপর থেকে দেখা যায় না l
এরকম জায়গায় বড় কুয়ো তৈরীর সময় মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ক্রমে মাটির চরিত্রের পরিবর্তন দেখেই খড়িয়া স্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যায় l সাধারণত বড় কুয়ো-গুলোতে জল পাওয়া যায় একশো দুশো হাত গভীরে আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে জল নোনতা ও বিস্বাদ l পানের অযোগ্য। তাই এসব স্থানে কুয়োর বদলে কুঁই খোঁড়া হয় l খড়িয়া পাথরের স্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতাও কাজে লাগে l যদি দেখা যায় যে বর্ষার জল কোন স্থানে একদমই বসছে না (অর্থাত্ জমা হওয়ার পরই তা ধীরে ধীরে শোষিত হয়ে যাচ্ছে), তাহলেই বুঝতে হবে সেখানে বালির নীচে খড়িয়া পাথরের স্তর বিছানো রয়েছে l এই স্তর বর্ষার জলকে মাটির একেবারে গভীরে গিয়ে নোনতা ভৌমজলের সঙ্গে মিশে যেতে দেয় না l তাই যে স্থানে, যতদূর এই খড়িয়া পাথরের স্তর রয়েছে, ততদূর পর্যন্ত বর্ষার জল মাটির অল্প নীচে বালুকাময় উপরিভাগ ও নীচে খড়িয়া পাথরের স্তরের মাঝে আটকে বিস্তৃত এক আর্দ্রতা রূপে মাটির ভিতর ছড়িয়ে যায় l প্রচণ্ড গরমের সময় এই জল যে বাষ্প হয়ে আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাবে, সে আশঙ্কা অমূলক নয় l তবে এক্ষেত্রেও প্রকৃতিরই এক বিচিত্র উদারতা সমস্যার সমাধান করে দেয় l বালির কণাগুলি আয়তনে খুবই ক্ষুদ্র l অন্য জায়গায় যে সব মাটি পাওয়া যায়- তাদের মতো এগুলি পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে যায় না l আসলে যেখানে বন্ধন সেখানেই তো দেখা যায় বন্ধহীনতা l যে সব স্থানে মাটির কণাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে যায়, সেখানে তারা নিজের জায়গায় ছেড়ে এসে তবেই পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন হতে পারে l ফলে, কিছুটা করে জায়গা ফাঁকা হয়ে যায় l যেমন, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে যেখানে ‘দোমঠ’ অর্থাত্ কৃষ্ণ মৃত্তিকা অঞ্চল রয়েছে, সেখানে বর্ষার শেষে রোদ উঠলেই মাটির কণাগুলি একে অপরের সঙ্গে সেঁটে যেতে থাকে, এবং মাটিতে, উঠোনে, খেতে সব জায়গাতেই ফাটল দেখা দেয় l বর্ষায় মাটির ভেতরে সঞ্চিত আর্দ্রতা এই ফাটলগুলি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে l
মরুভূমিতে এলোমেলো ছড়ানো অবস্থার মধ্যেই কিন্তু রয়েছে শৃঙ্খলা l এখানে বালির কণাগুলি সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে থাকে l পরস্পরের মধ্যে বন্ধন যেহেতু নেই, তাই বন্ধনহীনতাও দেখা যায় না l জল পড়লে কণাগুলি কিছুটা ভারী হয়ে পড়ে ঠিকই, কিন্তু নিজের জায়গা ছাড়ে না l তাই মরুভূমির মাটিতে কখনই ফাটল দেখা যায় না l মাটির ভেতর ঢুকে পড়া বৃষ্টির জল ভেতরেই থেকে যায় l ওদিকে কিছুটা নীচে রয়েছে এক টানা বিস্তৃত খড়িয়া পাথরের স্তর, সে ঐ বৃষ্টির জলকে আটকে রাখে, এদিকে ওপরে রয়েছে এসংখ্য বালু কণার কড়া পাহারা l
এই এলাকায় বৃষ্টির জল বিন্দু বিন্দু করে বালিতে শোষিত হয়ে মাটির গভীরে যেন এক বিস্তৃত আর্দ্রতায় পরিণত হয় l যেখানে ‘কুঁই’ তৈরী হল, সেখানে এবার তার পেট, অর্থাত্ ভেতরের শূন্য স্থান চারিদিকে ব্যাপ্ত হয়ে থাকা আর্দ্রতাকে ফের জল বিন্দুতে বদলে নিতে থাকে l এক এক বিন্দু করে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসে, অল্প অল্প করে কুঁইয়ের ভেতর জমা হতে থাকে, চারিদিকে নোনতা জলের সমুদ্রের মাঝে অমৃতের মত মিষ্টি একটুখানি জল l
এই অমৃত পাওয়ার জন্য মরুভূমির সমাজ প্রচুর মন্থন করেছে l নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে পরিণত করতে তাদের হাতে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে পুরো একটি শাস্ত্র গ্রন্থ l মরুভূমিতে যে জল পাওয়া যেতে পারে, শাস্ত্র অনুসারে তাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় প্রথম রূপ হল, ‘পালর পানি’ l অর্থাত্ বর্ষার সময় সরাসরি বৃষ্টির থেকে পাওয়া যায় যে জল সেই জল l এই জল ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে যখন বয়ে চলে, তখনই তাকে নদী, পুকুর ‘প্রভৃতিতে’ আটকে নেওয়া হয় l এই প্রভৃতি শব্দটার মধ্যেও কিন্তু অনেক কথা লুকানো রইল l তার পূর্ণ বিবরণ পরে কোথাও দেওয়া যাবে l
দ্বিতীয় রূপের নাম, ‘পাতাল পনি’ l এ হল সেই ভৌমজল যা গভীর কুয়ো থেকে তোলা হয় l
‘পালর পানি’ ও ‘পাতাল পানি’-র মাঝখানে থাকে জলের তৃতীয় রূপ, ‘রেজানি পানি’ এই জল মাটির নীচে প্রবেশ করেছে বটে, কিন্তু একেবারে গভীরে মূল ভৌম জলের সঙ্গে মিশতে পারে না l মরুভূমিতে বৃষ্টির পরিমাণ মাপতে সেণ্টিমিটার বা ইঞ্চির বদলে ‘রেজা’ শব্দটি ব্যবহার হয় l এই একক আবার ভপৃষ্ঠে বর্ষিত জলের পরিমাণ মাপে না, বরং ভূপৃষ্ঠে প্রবিষ্ট জলের হিসেব দেয় l যেমন ধরা যাক, মরুভূমিতে এক দিনে এতটা বৃষ্টি হল যে জল মাটির পাঁচ আঙুল গভীরে যেতে পারল – এক্ষেত্রে সেই দিনের বৃষ্টিকে পাঁচ আঙ্গুল রেজো বলা হবে l রেজানি জল খড়িয়া পাথরের স্তরে আটকে পাতাল পানি থেকে আলাদা হয়ে থাকে l যেখানে এই স্তর নেই, সেখানে এই জল আস্তে আস্তে নীচে গিয়ে পাতাল পানি অর্থাত্ মূল ভৌমজলের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে l যদি কোনো জায়গার ভৌমজল লবণাক্ত হয়, তাহলে রেজানি জলও তার সঙ্গে মিশে গিয়ে লবণাক্ত হয়ে যায় l এই বিশিষ্ট রেজানি পানি সংগ্রহ করার জন্য যে কুঁই - তার নির্মাণ শৈলীও এক বিশেষ শিল্পের পর্যায়ে পড়ে l চার -পাঁচ হাত ব্যাসের একটা কুঁই ষাট - পঁয়ষট্টি হাত গাভীরতা পর্যন্ত নামিয়ে নিয়ে যায় যে সমস্ত চেজারোরা, তারা নির্মাণ- কৌশল ও সাবধানতার এক চূড়ান্ত স্তরই স্পর্শ করেছে বলা যায় l কুঁই-এর প্রাণ হল শ্রেষ্ঠতম ‘চিনাই’ বা ‘চেজো’ অর্থাত্ পলেস্তরা l এখানে সামান্যতম ত্রুটিও চেজারোদের প্রাণ নাশের কারণ হতে পারে l প্রতিদিন একটু একটু করে খোঁড়া হয়, সাথে সাথে মাটি, পাথর, বালি সব বের করে নেওয়া হয়, কেননা এর পর খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করার আগেই ইতিমধ্যে যতটা খোঁড়া হয়েছে ততটা ‘চিনাই’ করে নিতে হবে l তা না হলে ওপরের অংশের মাটি ধ্বসে পড়তে পারে l
কুড়ি-পঁচিশ হাত খুঁড়ে নীচে নেমে যাওয়ার পর ক্রমশ গরম বাড়তে শুরু করে, হাওয়া কমতে l তখন ওপরে যারা রয়েছে তারা মুঠো মুঠো বালি জোরে জোরে নীচে ছুঁড়ে মারতে থাকে l মরুভূমিতে বালির বিশাল বিশাল টিলগুলিকে এদিক থেকে ওদিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় যে বাতাস, সেই বাতাস এখানে কুঁই-এর ভিতর এক মুঠো বালির সঙ্গে উড়তে উড়তে গরমে ঘেমে নেয়ে ভেপসে যাওয়া চেলওয়াজিদের কিছুটা আরাম দিয়ে থাকে l কিছু কিছু স্থানে কুঁই তৈরির এই কঠিন কাজ আরো কঠিন হয়ে পড়ে - প্রচলিত ইঁটের পলেস্তরা মাটির ধ্বস আটকাতে পারে না, তখন কুঁইকে দড়ি দিয়ে ‘বাঁধা’ হয় l
যেদিন কুঁই খোঁড়া শুরু হয়, সেদিনই ‘খিঁপ’ নামের এক জাতীয় ঘাস প্রচুর পরিমাণে জমা করা হয় l চেজারো খোঁড়া শুরু করে, আর বাকি যারা ওপরে থাকে তারা খিঁপ দিয়ে দড়ি পাকাতে শুরু করে l
সাধারণত তিন আঙুল মোটা হয় এই দড়ি l প্রথম দিনের কাজ শেষ হতে দেখা যায়, কুঁই প্রায় দশ হাত গভীর হয়ে গিয়েছে l এবার কুঁইয়ের নীচে মেঝেতে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে ওই দড়ির প্রথম বৃত্ত পাতা হয় l এর ওপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ - এভাবে বাঁধন ওপরে উঠতে থাকে l ঘাসের তৈরি মোটা অমসৃণ দড়ি প্রত্যেকটা পাকের ওপর নিজের ওজনের চাপ ফেলে এবং বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা গিঁটগুলো ক্রমশ একে অপরের সঙ্গে ফাঁস লেগে দৃঢ়ভাবে পরস্পরের ওপর চেপে বসে l দড়ির শেষ প্রান্তটি থাকে কুঁইয়ের ওপরে l পরের দিন আবার কয়েক হাত মাটি কাটা হয়ে যায় l প্রথম দিন দড়ির যে কুণ্ডলী তৈরী হয়েছিল তা আজকে যতটা খোঁড়া হল - ততদূর পর্যন্ত চাপ দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় l ওপরের খালি দেওয়ালে নতুন দড়ি দিয়ে নতুন করে আবার ঘেরা দেওয়া হতে থাকে l দড়ির এই পাক যাতে ঠিকঠাক দেওয়ালে আটকে থাকে তার জন্য কোথাও কোথাও মাঝে মাঝে পলেস্তরা করে নেওয়া হয় l
পাঁচ হাত ব্যাসের কুঁইয়ের ভিতর কুণ্ডলির এক পাক দিতে পনেরো হাত দড়ি লাগে l এক হাত গর্ত বাঁধতে লাগে আট দশ পাক দড়ি l অর্থাত্ এটুকু বাঁধতেই দড়ি লাগে প্রায় দেড়শো হাত l এবার যদি ত্রিশ হাত গভীর কুঁই-এর মাটি আটকানোর জন্য দড়ির পাক দিতে হয় তাহলে প্রয়োজন চার হাজার হাত দড়ি l নতুন প্রজন্ম তো বুঝতেই পারবে না যে এখানে কুঁই খোঁড়া হচ্ছে না কী দড়ি পাকানো হচ্ছে l
কোনো কোনো জায়গায় খিঁপঘাস বা পাথর কোনোটাই যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না l কিন্তু যেখানে রেজানি পানি পাওয়া যাবে সেখানে তো কুঁই তৈরি হবেই l এইসব জায়গায় কুঁই-এর ভেতরের পলেস্তরা কাঠের লম্বা লম্বা টুকরো দিয়ে করা হয় l টুকরোগুলি হয় বাবলা, অরণি, বন (কয়ের) কিংবা কুম্বট গাছের কাঠ দিয়ে l এই কাজের জন্য অবশ্য সব থেকে উত্তম কাঠ হল অরণি l তবে ভাল বা মাঝামাঝি ধরণের কাঠ না পাওয়া গেলে আক দিয়েও কাজ চালিয়ে নেওয়া হয় l
টুকরোগুলোকে নীচ থেকে ওপরের দিকে একটাকে অন্যটার সঙ্গে আটকে সোজা দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় l তারপর খিঁপের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয় l কোথাও কোথাও শনের দড়ি দিয়েও বাঁধা হয় l এই পলেস্তরা বা বাঁধাই-এর আকার হয় কুণ্ডলীর মতো, তাই এর আর এক নাম ‘সাঁপনী’ l নীচে যে চেলওয়াজ মাটি খোঁড়াখুঁড়ি ও পলেস্তরার কাজ করছে সে ভীষণ-ই ভাল মাটি চেনে l খড়িয়া পাথরের স্তরে পৌঁছানো মাত্র সে খোঁড়া বন্ধ করে দেয় l কুঁইয়ের ভেতর জলের ধারা বয়ে আসতে শুরু করেছে l চেজারো ওপরে উঠে আসে l
কুঁই খোঁড়ার কাজে সফলতা প্রাপ্তি অর্থাত্ তার সজলতা, এক সর্বজনীন উত্সবে পরিণত হয় l প্রথম দিন থেকে যারা কাজ করছে তাদের যত্নআত্তি করাটা এখানকার ঐত্যিহ্যের মধ্যেই পড়ে l এছাড়াও কাজের শেষ দিনে আয়োজন করা হয় এক বিশেষ ভোজের l বিদায়ের সময় চেলওয়াজিদের বিভিন্ন উপহারও দেওয়ার প্রথা তো ছিলই তবে এখানেই কিন্তু তাদের সঙ্গে ওই গ্রামের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল না, ‘আচ’ প্রথা অনুসারে সারা বছরের উত্সব, পার্বণ বা বিয়ের মতো মাঙ্গলিক কাজে তাদের উপহার পাঠানো হত l ফসল উঠলে, ফসলের একটা অংশও তারা পেত l এখন অবশ্য শুধুমাত্র মজুরি দিয়েই কাজ করানোর প্রথা চালু হয়ে গেছে l
কোনো কোনো জায়গায় সাধারণ গৃহস্থও এই কুঁই তেরির শিল্পে নিপুণতা অর্জন করেছিল l জয়সলমেরের অনেক গ্রামেই এই রকম ‘পলিওয়াল’ ব্রাহ্মণ এবং ‘মেঘওয়াল’ ( এখন এরা তফশিলি জাতি বলে চিহ্নিত ) -দের হাতে তৈরি একশো দুশো বছর আগেকার ‘পার’ ও ‘কুঁই’- গুলি এখনও অক্লান্তভাবে জলের জোগান দিয়ে চলেছে l
কুঁই-এর মুখ ছোট করার কারণ তিনটি l বালিতে সঞ্চিত জল খুব ধীরে ধীরে চুঁইয়ে কুঁই-এর ভিতর জমা হয় l সারাদিনে কুঁইয়ে যতটা জল জমা হয়, তাতে মাত্র দু থেকে তিনটে ঘড়া ভরতে পারে l কুঁই-এর ব্যাস বড় হলে এই অল্প একটু জল বেশি জায়গায় ছড়িয়ে থাকবে, ফলে তোলা সম্ভব হবে না l কিন্তু ছোট ব্যাসে কুঁইয়ের জল ক্রমে ক্রমে দু-চার হাত উচ্চতায় পৌঁছে যায় l আর এইজন্যই কোনো কোনো জায়গায় এর থেকে জল তুলতে ছোট বালতির বদলে ছোট চড়স ব্যবহার করা হয় l ধাতুর বালতি সহজে জলে ডুবে না, কিন্তু মোটা কাপড় বা চামড়ায় তৈরি চড়সের মুখে ভারী কড়া বাঁধা থাকে- চড়স গিয়ে জলে ধাক্কা মারে, ওপরের ভারী অংশ প্রথমে জলে পড়ে এবং জল কম থাকলেও তা সহজে জলে ডুবে যায় l জল ভরে গেলেই চড়স তার আকার ফিরে পায় l
যেসব গ্রামে কুঁই আছে, তাদের পাশ দিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই পাকা সড়ক গড়ে উঠেছে l এই রাস্তা দিয়ে ট্রাকও যাচ্ছে l ট্রাকের টায়ারের ফাটা টিউব থেকেও আজকাল ছোট আকারের চড়স তৈরি হচ্ছেl
রাজস্থানের প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে কুঁইয়ের ব্যাসের আয়তনের সম্পর্ক রয়েছে l ব্যাস বড় হলে বেশি জায়গায় ছড়িয়ে থাকবে l আর বেশি জায়গায় ছড়িয়ে থাকা মানেই অধিক বাষ্পীভবন l কুঁইয়ের জল পরিষ্কার রাখতে তার মুখ সবসময় ঢেকে রাখা দরকার l তাই মুখ ছোট হলে ঢাকা দেওয়া সহজ l প্রতিটি কুঁইয়ে দেখা যায়, তাদের মুখে কাঠের তৈরি ঢাকনা দেওয়া আছে l অনেক জায়গায় আবার ঘাস, ডালপালা প্রভৃতি জড়ো করে তৈরী আচ্ছাদনও দেখা যায় l
আজকাল যেখানে পাকা রাস্তা হয়েছে, সেখানে নতুন নতুন অপরিচিত লোকের যাতায়াতও বেড়েছে l তাই যেসব স্থানে ওই অমৃতের মতো মিষ্টি জলের সুরক্ষার ব্যবস্থাও প্রয়োজনীয় l এখন এসব এলাকায় অনেক কুঁইয়ের ঢাকনাতেই তাই তালা লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে l ওপরে জল তোলার কপিকল বা চরকিতেও লাগানো হয়েছে তালা l
‘কুঁই’ গভীর হলে জল তোলার সুবিধার জন্য তাতে ঘড়িঘড়ি বা চরকি (অর্থাত্ কপিকল) লাগানো হয়। একে ‘গড়েরি’, ‘চরখি, বা ‘ফরেড়ি’ও বলে l ফড়েরি লোহার তৈরি দুটো বাহুতে লাগানো যেতে পারে l তবে সাধারণত এটি গুলতির মতো একটা কাঠের টুকরোর এপার ওপার ফুটো করে লাগানো হয় l একে ‘ওড়াক’ বলে l ‘ওড়াক’ ও ‘চরকি’ ছাড়া, এত গভীর কুঁই থেকে জল তোলা খুবই কঠিন l এদের সাহায্যে চড়স সহজে ওপরে ওঠানো যায় l কোথাও ধাক্কা লাগে না, জল ছলকেও পড়ে না l এ ছাড়া কপিকলে ভারী জিনিস তুলবার সুবিধাটুকু তো রয়েইছে l
খড়িয়া পাথরের স্তর এক একটা বৃহত্ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত হয় l তাই পুরো এলাকা জুড়ে একটার পর একটা কুঁই তৈরি হতে থাকে l এসব স্থানো একটা বড়সড় মাঠে ত্রিশ চল্লিশটা পর্যন্ত কুঁই পাওয়া যেতে পারে l ঘর পিছু একটা কুঁই, পরিবার বড় হলে একের বেশিও l
ব্যক্তিগত ও সার্বজনীন সম্পত্তির ধারণার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে যে স্কুল সীমারেখা, কুঁই-এ এসে তার এক বিচিত্র সমাপ্তি ঘটে l প্রত্যেকেরই নিজস্ব কুঁই রয়েছে l এটি তৈরি করা এবং তার থেকে জল নেওয়ার অধিকার তারই, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, কুঁই যেখানে তৈরি হয় তা কিন্তু গ্রাম সমাজের সার্বজনীন জমি l এখানে বর্ষিত জলই সারা বছর ধরে আর্দ্রতা রূপে মাটির তলায় জমা থাকে ও চুঁইয়ে চুঁইয়ে ফের কুঁইগুলিতে ঝরে পড়ে l আর্দ্রতার পরিমাণ আবার নির্ভর করে সে অঞ্চলের বর্ষার ওপর l অতএব, এখন ওই ভূমিতে প্রতিটি নতুন কুঁইয়ের অর্থ হল, পূর্বনির্ধারিত সঞ্চিত আর্দ্রতা ভাগ হয়ে যাওয়া l তাই নিজস্ব হলেও, সার্বজনীন স্থানে র্নিমিত এই কুঁই গ্রাম সমাজের নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয় l অত্যন্ত প্রয়োজন হলে তবেই সমাজ নতুন কুঁই-এর স্বীকৃতি দেয় l
প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের গল্পটার কথাই মনে পড়ে ও প্রসঙ্গে l প্রতিদিন মাত্র দু-তিন ঘড়া মিষ্টিজল কুঁই থেকে পাওয়া যায় l তাই প্রায় সারা গ্রামই গোধূলি লগ্নে কুঁই-তে আসে l যেন মেলা বসে যায় l গ্রামের পাশের মাঠে এক সঙ্গে ত্রিশ চল্লিশটা চরকির শব্দ চারণভূমি থেকে ঘরে ফেরা পশুদের গলায় বাঁধা ঘণ্টা ও খুরের শব্দের সঙ্গে মিশে যায় l দু তিন ঘড়া জল তোলা হতেই দড়ি বালতি গুটিয়ে নেওয়া হয় l কুঁই ঢাকা পড়ে l সারা রাত এবং পরের দিন কুঁই বিশ্রাম নেবে l সব জায়গাতেই বালির নীচে খড়িয়া পাথরের স্তর নেই l তাই কুঁইও রাজস্থানের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না l চুরু, বিকানের, জয়সলমের এবং বাড়মেরের কিছু এলাকা দিয়ে এই স্তর চলে গিয়েছে, তাই এখানকার গ্রামে গ্রামে অসংখ্য কুঁই দেখা যায় l যেমন ‘খাড়েরোঁর ঢ়াণি’ l জয়সলমেরের একটি গ্রাম l এখানে একশো কুড়িটা কুঁই ছিল বলে লোকে নাম রেখেছিল, ‘ছহ-বিশি’ ( অর্থাত ছয়গুণ কুড়ি ) l কোথাও কোথাও একে ‘পার’-ও বলা হয় l জয়সলমের তথা বাড়মেরের অনেক গ্রামেই এই পারের ওপর নির্ভর করেই বসতি গড়ে উঠেছে l তাই এই গ্রামগুলির নামেও রয়েছে পার l যেমন, ‘জানরে আলো পার’, ‘সিরগু আলো পার’ l
এক এক স্থানে খড়িয়া পাথরেরও এক এক রকম নাম l কোথাও একে বলা হয় ‘চারোলি’, কোথাও ‘ধাধড়ো’, কোথাও এর নাম ‘বিট্টু রো বল্লিয়ো’ l কোথাও আবার শুধুই ‘খডি’ l
আর এই ‘খডি’ স্তরের ভরসাতেই নোনা জলের মাঝে মিষ্টি জল দেওয়ার সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়য়ে আছে অসংখ্য ‘কুঁই’ l
Path Alias
/articles/raajasathaanaera-rajatabainadau
Post By: Hindi