নগরায়ণ আর বসত তাগিদে জলাভূমি বিপন্ন – এ সত্য দীর্ঘকাল ধরে জানলেও, জলাশয় বাঁচানোর জন্য কতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয় ? জলাভূমি যদি সভ্যতার ফুসফুস হয়ে থাকে, তবে তাকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর দায় সভ্যতারই এই মুহূর্তে এ রাজ্যের বিপন্ন জলাভূমিগুলির সংরক্ষণ - সম্ভাবনা ও তার প্রতিবন্ধকতাগুলিকে নিয়ে আলোচনা করলেন
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ও আমাদের দেশে জলাভূমিতে মাটি, বর্জ্য, ছাই, সিন্ডার প্রভৃতি ফেলে বুঝিয়ে দিয়ে মার্কেট, হাইজিং কমপ্লেক্স, কারখানা, হোটেল ও বিলাসবহুল বাড়ি গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে কিন্তু আঞ্চলিক পুলিশ-প্রসাশন কখনও নিষ্ক্রিয়, কখন সক্রিয়ভাবে সহযোগী। সরকার বড়ো বড়ো, কথা বলে, কিন্তু কার্যত অনাগ্রহী। বিক্রমগড়ে ঝিল বুজিয়ে গড়ে উঠেছে হোটেল। আর আজও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চল রামসার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রায় দশ বছর পরেও এই জলাভূমির বিভিন্ন অংশে জলা ভরাটের কাজ অব্যাহত। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, এবং হাওড়া ও হুগলি জেলায়, অজস্র জলাভূমি আক্রান্ত প্রতিদিন বুঝিয়ে ফেলার কাজ চলছে, এইসব কাজে যুক্ত জমির দালাল, জমি ভরাটকারী সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট পুঁজির অশুভ চক্র এদের হাতে অনেক অর্থ, গুন্ডা, মস্তান, আগ্নেয়াস্ত্র।
জলাশয় বাঁচানো সম্ভব যদি রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী মহোদয়-মহোদয়াদের শুভ ইচ্ছা থাকে। সামান্যই নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষদের উপর। পরিবেশ হচ্ছে সকল উন্নয়নের, সকল আর্থিক উন্নতির প্রথম শিকার। দ্রুত বড় হওয়া ও আর্থিক মুনাফার জন্য প্রায় প্রতিদিনই পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুসংহত উন্নয়ন এখন আলংকারিক শব্দ। জলাশয়গুলি হচ্ছে এইসব ধ্বংসাত্মক সক্রিয়তার অন্যতম শিকার।জলাভূমি শব্দটি এখন সুপরিচিত। সারা পৃথিবী জুড়ে জলাভূমির সংজ্ঞা ও সংজ্ঞার্থ নিয়ে নানান সুক্ষ্ম জটিলতা আছে। তবে কাজ চালানোর জন্য সে সব জটিলতা ভেদ করে একটা মোটামুটি ধারণাতে আসা যাক। কোথাও ভূপৃষ্ঠ নিখুঁত সমতল নয়। প্রাকৃতিক কারণে কিংবা মানুষের কর্মকান্ডের ফলে কিছু অপেক্ষাকৃত নীচু ও উঁচু জায়গা তৈরি হয়েছে। জলের গতিপথে বাধা না থাকলে নীচু জায়গাগুলিতে জল জমে। এই জলের পরিমাণ খুব বেশি হলে সারা বছরই কিছু জল থাকতে পারে। আবার অনেকক্ষেত্রে শুখা মরশুমে জল থাকে না। বছরের অন্তত কিছু সময় জল জমে থাকে না, তখনও এখানকার মাটি হয় অপেক্ষাকৃতভাবে ভেজা। এখানে গজিয়ে ওঠে শর ও হোগলা জাতীয় উদ্ভিদ। জলার ধারেও পাওয়া যায় নানা ধরনের উদ্ভিদ। সারা বছর জল থাকলে অনেক সময়ে জলার জলে থাকে প্রচুর মাছ। মাছ ধরে খায় এমন প্রাণীদের মধ্যে চোখে পড়ে মাছরাঙা ও বাঘরোল। জলা অঞ্চলে বাসা বাঁধে বহু স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি। উদ্ভিদ, প্রাণী ও পোকা নিয়ে তৈরি হয় জলার বিশেষ ধরনের ইকোলজি।
নীচু জমিতে গড়ে ওঠা, ঝিল, বিল বা প্রাকৃতিক সরোবর ছাড়াও, জলাভূমির মধ্যে পড়ে মানুষের তৈরি করা দিঘি, পুকুর, প্রভৃতি। জলাভূমি বিষয়ক আন্তর্জাতিক রামসার সমঝোতাতে নদী, খাল ও উপকূলীয় সমুদ্রাঞ্চলকেও জলাভূমির সংজ্ঞার মধ্যে আনা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে, জলাভূমির আলোচনাতে আসে জলা, বিল, ঝিল, পুকুর, দিঘি প্রভৃতির প্রসঙ্গ।
সারা ভারতে সব মিলিয়ে 26টা আন্তর্জাতিক রামসার অঞ্চল রয়েছে। সেখানে কলকাতাতে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জলাভূমির উপকারিতা ও গুরুত্ব নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক - যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মাটির তলার জল রিচার্জ করার ক্ষেত্রে, মাটির উপরিতলের জলের আধার হিসাবে, অসাধারণ জীববৈচিত্রের আধার ও জিনব্যাংক হিসাবে, বায়ুমণ্ডলের কার্বন শুষে নেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এবং আরও নানান ভূমিকায় জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া মিষ্টি জলের জলাভূমি আশেপাশের নোনতা জল প্রবেশ করতে বাধা দিয়ে থাকে।
দুর্যোগের সময়ে ইদানীংকালে ম্যানগ্রোভ ওয়েটল্যান্ড ভারত ও বাংলাদেশে প্রতিরোধের পাঁচিল হিসেবে কাজ করেছে, এছাড়া জলাভূমিতে মাছ চাষের অবকাশ আছে, যা সাধারণ মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এবং পরিযায়ী ও লুপ্তপ্রায় পাখি ও সারস, বক, কাদাখোঁচার প্রভৃতির আবাসস্থল হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। জলাভূমি বিনোদনমূলক অঞ্চল হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
এখন সেই জলাভূমি, ভূমিরাক্ষসদের দ্বারা আক্রান্ত এবং দারুণভাবে বিপন্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ও আমাদের দেশে জলাভূমিতে মাটি, বর্জ্য, ছাই, সিন্ডার প্রভৃতি ফেলে বুঝিয়ে দিয়ে মার্কেট, হাইজিং কমপ্লেক্স, কারখানা, হোটেল ও বিলাসবহুল বাড়ি গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে কিন্তু আঞ্চলিক পুলিশ-প্রসাশন কখনও নিষ্ক্রিয়, কখন সক্রিয়ভাবে সহযোগী। সরকার বড়ো বড়ো, কথা বলে, কিন্তু কার্যত অনাগ্রহী। বিক্রমগড়ে ঝিল বুজিয়ে গড়ে উঠেছে হোটেল। আর আজও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চল রামসার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রায় দশ বছর পরেও এই জলাভূমির বিভিন্ন অংশে জলা ভরাটের কাজ অব্যাহত। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, এবং হাওড়া ও হুগলি জেলায়, অজস্র জলাভূমি আক্রান্ত। প্রতিদিন বুঝিয়ে ফেলার কাজ চলছে, এইসব কাজে যুক্ত জমির দালাল, জমি ভরাটকারী সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট পুঁজির অশুভ চক্র। এদের হাতে অনেক অর্থ, গুন্ডা, মস্তান, আগ্নেয়াস্ত্র।
তাই প্রতিবাদ করতে মানুষ ভয় পায়। প্রতিরোধ করতে গেলে খুন হয়ে যেতে হয়। বালি-জগাছা ব্লকের সীমানার মধ্যে এই জলাকেই সাধারণভাবে জয়পুর বিল বলা হয়ে থাকে। আনমোল সাউথ সিটি নামে একটি প্রোমোশনাল সংস্থা সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে জলাভূমিটিকে কয়েক বছর ধরে ভরাট করে চলেছে। এই বিশাল জলাভূমিকে বাচানোর জন্য আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা তপন দত্ত খুন হয়ে গেলেন। এখনও খুনের কোনও সুরাহা হয়নি। নেতা, নেত্রী ও পরিবেশ দপ্তর জলা বাঁচানোর বিষয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেন, কিন্তু বোঝা যায় যে, ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতেই জলাগুলি বোঝানো হচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসের নাকের ডগায় জলা বুঝিয়ে রাস্তা তৈরি করছে। উদ্দেশ্য, হিন্দ মোটরের প্রস্তাবিত টাউনশিপকে দিল্লি রোডের সঙ্গে যুক্ত করা।
সিন্ডিকেট তৈরি হয়। ভরাটের কাজ করছে আঞ্চলিক সিন্ডিকেটগুলি। বর্তমান সরকার এই সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কড়া কড়া ঘোষণা করে থাকেন। কিন্তু কার্যত তাঁদের অবস্থান এইসব ঘোষণার 180 ডিগ্রি বিপরীতে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ডানকুনি কোল কমপ্লেক্সের কাছে, সেইল-এর বিপরীতে, কোকাকোলা ফ্যাক্টরির পাশে বিশাল জলাভূমি। এখানে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আস্তানা। এখনও বিভিন্ন আঞ্চলিক পাখি, পরিযায়ী পাখিরা আসে। কিছু কিছু মানুষ ছোট ছোট ডিঙিতে মাছ ধরেন। এই জলাভূমি কিছু ধনী মানুষের লোভের শিকার। উন্নয়ন গ্রুপ -এর মতো কিছু সংস্থা এই বিস্তীর্ণ জলাভূমিটি ভরাট করে চলেছে। জলাভূমি বুজিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা, যেমন বায়ো ক্যাপস ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। সিন্ডার ও ছাইগাদা দিয়ে ভরাট করে, ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে ও রাস্তা তৈরি করে ‘উন্নয়ন’ নামে এক দুঃস্বপ্নের কাহিনি রচনা করে চলেছে। বলা বাহুল্য, এই উন্নয়ন-এর সঙ্গে যথার্থ কল্যাণের কোনও সম্পর্ক নেই। যদিও আমাদের কাছে এই সব জলাশয় বাঁচানোর জন্য অনেক আইনি ব্যবস্থা আছে যেমন - বেঙ্গল ওয়াটার হায়াসিন্থ অ্যাক্ট (1935), বেঙ্গল ট্যাঙ্ক ইম্প্রুভমেণ্ট অ্যাক্ট (1939)। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট (1993)। সেটারও অ্যামেন্ডমেণ্ট হয় 2008 সালে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ভূগর্ভস্থ জল সম্ভাবনা ও পরিচালনা অ্যাক্ট (2005), ওয়েস্ট বেঙ্গল ভূমি সংস্কার অ্যাক্ট (2005), ওয়েস্ট বেঙ্গল বৃক্ষ সংরক্ষণ অ্যাক্ট (2006), ইস্ট কলকাতা জলাশয় সংরক্ষণ অ্যাক্ট (2006)।
তবুও জলাশয়গুলি ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে সকলের চোখের সামনে। এমতাবস্থায় 2010 সালে দিশা, ফিলার, গণউদ্যোগের মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কলকাতা হাইর্কোটে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে এবং 2012 সালে প্রধান বিচারপতি স্টেট গর্ভমেণ্টকে একটি হাইপাওয়ার কমিটি গঠন করতে আদেশ দেন – যেন তাঁরা জলাশয় সম্পর্কিত একটি নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনও রকম জলাশয় ভরাট সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ না থাকে।
গঠিত হাইপাওয়ার কমিটি অগস্ট 2012-তে বেশ কিছু স্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে কার্যকরী সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেন, যা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সদিচ্ছার ওপর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার একটি অংশও কার্যকর হয়নি। ডানকুনির কাছাকাছি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসেওয়ের পাশের মুল্লার ভেড়িতে জমি ভরাটের গতি অব্যাহত। দিশা, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ, লিগাল ও ইকোলজিকাল রাইটস ও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে যে জনস্বার্থ মামলা হাইকোর্টে করা হয়েছিলো, তার উপর গত 17 মে 2013 তারিখে প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায় দিয়েছেন যে, জলাভূমির চরিত্র বদলানো যাবে না, অপরিবর্তিত অবস্থায় যেমন ছিল তা পুরায় এনে দিতে হবে।
এখন দেখা যাক, রাজনৈতিক সদিচ্ছা কীভাবে ভূমিরাক্ষস ও অপউন্নয়নের হাত থেকে জলাভূমিকে বাঁচাতে পারে। তবে আমাদের সতর্ক আন্দোলন ও প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না।
ডঃ অরুণকান্তি, প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী)
‘Ekdin’ Kolkata, 14th June 2013, Vol:Vii, Issue: 6
/articles/raajanaaitaika-sadaicachaa-thaakalae-jalaasaya-baancaanao-samabhaba