ফ্লোরাইড, ফ্লোরিন, ফ্লোরোসিস


ফ্লোরাইড


গরম আবহাওয়ায় জল বেশি খাওয়া হয় অতএব সেইরকম অঞ্চলে পানীয় জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা 1.5 মি. গ্রা,-এর কম থাকাই বাঞ্ছনীয়। ভারত সরকারের গৃহীত নীতিতে তাই জলে লিটার প্রতি 1.0 মি, গ্রা, কাম্য সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে । পরিবেশীয় আর্সেনিকের কথা বাংলায় আজ খানিকটা পরিচিত লাভ করলেও ফ্লোরাইড শব্দটির সঙ্গে আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকের কোনো পরিচিতিই নেই, তার দোষগুণের কথা ছেড়েই দিলাম। অথচ ফ্লোরাইড সর্বব্যাপী – জল, মাটি, বাতাস, খাদ্যদ্রব্য, উদ্ভিদ, প্রাণীদেহে সর্বত্র। যাঁরা কিছু কিছু ফ্লোরাইডের কথা শুনেছেন তাঁরাও এ ব্যাপারে মাথা থামানোর কোন প্রয়োজন বোধ করেন না। তার একটা বড়ো কারণ অনেক টুথপেস্টেই (যেমন – কলগেট, আগের দিনের বিনাকা, ক্রেস্ট ) কিছু ফ্লোরাইড যোগ করা থাকে। প্রচার করা হয়ে থাকে যে পরিমিত মাত্রায় ফ্লোরাইডে দাঁত শক্ত ও সুন্দর হয় এবং শিশুদের দাঁতের গর্ত ( ক্যাভিটি, যাকে সাধারণ ভাবে এবং ভুল ভাবে ‘পোকায় খাওয়া’ বলে ) প্রতিরোধ হয়। তাছাড়া বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ (who) স্পষ্ট করে বলেছেন যে পানীয় জলে লিটার প্রতি 1.5 মি. গ্রা. (মিলিগ্রাম) পর্যন্ত ফ্লোরাইড ক্ষতিকর নয়, বরং শিশুদের দাঁতের পক্ষে ভালো। তবে গরম আবহাওয়ায় জল বেশি খাওয়া হয় অতএব সেইরকম অঞ্চলে পানীয় জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা 1.5 মি. গ্রা,-এর কম থাকাই বাঞ্ছনীয়। ভারত সরকারের গৃহীত নীতিতে তাই জলে লিটার প্রতি 1.0 মি, গ্রা, কাম্য সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে পানীয় জলের বিকল্প ব্যবস্থার অভাব থাকলে 1.5 মি. গ্রা.- কেই সর্বোচ্চ মাত্রা ধরা হবে। আমেরিকার পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (EPA) পানীয় জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা লিটার প্রতি সর্বোচ্চ 4.0 মি. গ্রা. রাখবার নির্দেশ দিয়েছে। তবে মার্কিন দেশের কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ মাত্রাকে উঁচুতে বেঁধেই ক্ষান্ত হননি।

যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন যে দাঁতের সুরক্ষার স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পানীয় জলে পরিকল্পিতভাবে ফ্লোরাইড যোগ করা হয়ে থাকে। একে ফ্লোরিডেশন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারি পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) পানীয় জলে 0.7 থেকে 1.2 মি. গ্রা. ফ্লোরাইড রাখার সুপারিশ দিয়েছে। মার্কিন সরকারের প্রচার অনুযায়ী জলের ফ্লোরিডেশন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ 10টি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম। এ সবের পরে সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই, শিক্ষিত ও বিজ্ঞান জানা মানুষও যদি ফ্লোরাইড বিষণ (fluoride poisoning) নিয়ে উদাসীন থাকেন তবে তাদের কতটা দোষ দেওয়া যায়? তবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও সত বিজ্ঞানী মহল কিন্তু মার্কিন সরকার ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে একমত নয়। এখানে আমরা সেই আলোচনাই করবো। আসুন, দেখি।

ফ্লোরিন ও ফ্লোরাইড


ফ্লোরিন হল একটি রাসায়নিক মৌলিক পদার্থ যার পারমাণবিক সংকেত হল F আর আণবিক সংকেত হল F2 ক্লোরিন, ব্রোমিন, আয়োডিন -এর সঙ্গে এটিও হ্যালোজেন শ্রেণির অন্তর্গত। পৃথিবীর সাধারণ তাপমাত্রা ও চাপে এটির গ্যাস হিসেবে থাকার কথা। তবে মুক্ত গ্যাসীয় অবস্থায় ফ্লোরিনকে পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যায় না। কারণ, রাসায়নিকভাবে ফ্লোরিন এতটাই সক্রিয় যে তা অতি সহজে যে কোনো বস্তু থেকে একটা ইলেকট্রন টেনে নিয়ে ঋণাত্বক ফ্লোরাইড (রাসায়নিক সংকেত F) আয়নে পরিণত হয়ে যায়। অর্থাত ফ্লোরাইড বলতে বোঝায় ফ্লোরিনের ঋণাত্বক আয়ন। এই ফ্লোরাইড অসংখ্য অজৈব ও জৈব যৌগের মধ্যে থেকে পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজমান এবং তার জীবভূরাসায়নিক একটি চক্র (Biogeochemical cycle) আছে। সুপরিচিত পরিবেশীয় ফ্লোরাইডের মধ্যে হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড এবং সোডিয়াম, ক্যালশিয়াম, আয়রন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদির ফ্লোরাইড উল্লেখযোগ্য।

ফ্লোরিন আজকাল বহু শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক বহু অ্যাণ্টিবায়োটিক, টেফলন, সিএফসি (CFC) প্রভৃতি অসংখ্য দ্রব্যে ফ্লোরিন উপস্থিত। মৌলিক মুক্ত অবস্থায় ফ্লোরিনের অন্তরণ বা পৃথকীকরণ (isolation)-এর কৃতিত্ব ফরাসি রাসায়নবিদ অঁরি ময়সাঁ (Henri Moissan)-র। ইনি 1886 সালে ফ্লোরিনকে পৃথক করতে সক্ষম হন। এই কৃতিত্বের জন্য 1906 সালে তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।

মুক্ত অবস্থায় পাওয়ার অনেক আগেই বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে ফ্লোরিনের উপস্থিতি রসায়নবিদরা টের পেয়েছিলেন। তার ফ্লোরিন নামকরণও হয়ে গিয়েছিল তাকে আলাদা করতে পারার অনেক আগেই। ফ্লোরিনের রাসায়নিক যৌগগুলি থেকে মুক্ত অবস্থায় ফ্লোরিন প্রস্তুত করা ছিল অজৈব রাসায়নের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে সাড়া দিয়ে ফ্লোরিন বা তার যৌগগুলির মারাত্মক বিষক্রিয়ায় যেসব রসয়নবিদ হতাহত হয়েছিলেন তাদের ফ্লোরিন শহিদ বলা হয়। রাসায়নিকভাবে প্রবল সক্রিয় ফ্লোরিন প্রাণী শরীরের পক্ষে দারুণ বিষাক্ত। অসুস্থ হয়ে পড়েন গে-লুসাক (Gay-Lussac) 1810 সালে। 1815 সালে থেনার্ড (Thenard) ও ডেভি (Davy) উভয়েরই ফ্লোরিন গ্যাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ায় গুরুতর অসুস্থ হন। লুয়েত ও নিকেলস (Louyet & Nickels) ফ্লোরিন প্রস্তুতির পরীক্ষায় মারা যান। অবশেষে সাফল্য আসে প্যারিসে অঁরি ময়সাঁর গবেষণায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র 54 বছর। মৃত্যুকালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন ফ্লোরিন আমার জীবন থেকে দশটা বছর নিয়ে গেল’’।

কাচে দাগ কাটার জন্য ও ধাতুনিষ্কাশনে ফ্লোরাইডের ব্যবহার কয়েকশো বছরের। ফ্লোরস্পার বা ক্যালশিয়াম ফ্লোরাইট ধাতু নিষ্কাশন চুল্লিতে ব্যবহৃত হত। ল্যাটিন শব্দ ‘fluere’ কথাটির মানে হল ‘to flow’ তাই থেকে ফ্লোরিন নাম। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যত্পাতের মাধ্যমে ভূঅভ্যন্তর থেকে হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড ও অন্যান্য নানারকম ফ্লোরাইড বেরিয়ে এসে পরিবেশ দূষিত করে। উষ্ণ প্রস্রবনের জলেও ফ্লোরাইডের আধিক্য। ভারতবর্ষে নদীর জলে ফ্লোরাইড কম। সমুদ্রের জলে নদীর থেকে সামান্য বেশি। লিটার প্রতি জলে প্রায় 1 মি. গ্রা.। সেই ফ্লোরাইড সামুদ্রিক বালিতে ক্রমসঞ্চিত হয়। সম্ভবত তার ফলেই সমুদ্রপলি গঠিত দক্ষিণবঙ্গের মাটিতে ফ্লোরাইডের মাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই সেখানকার ভূগর্ভের জলে ফ্লোরাইড তুলনায় বেশি মাত্রায় আছে।

ফ্লোরোসিস


ফ্লোরাইড ঘটিত অসুখ বিসুখকে ফ্লোরোসিস বলে। গবেষক ও চিকিত্সকরা সাধারণত তিন ধরনের ফ্লোরোসিস চিহ্নিত করেন।
দাঁতের ফ্লোরোসিস (Dental Fluorosis)
হাড়ের তথা অস্থিপঞ্জরের ফ্লোরোসিস (Skeletal Fluorosis)
শরীরের অন্য অংশের ফ্লোরোসিস (Non - skeletal Fluorosis)
দাঁতে ফ্লোরোসিসের ফলে দাঁতের এনামেল ও গড়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দাঁতে ছোপ - ছোপ দাগ (mottled teeth) থেকে শুরু করে দাঁতের গঠন এলোমেলো ও দাঁতের সহজ ভঙ্গুরতা হয়ে থাকে।

হাড়ের ফ্লোরোসিসের ফলে হাড় ও জয়েণ্টগুলি তাদের নমনীয়তা হারায়। হাড়ের কঠিনতা (hardness) ও ভঙ্গুরতা (brittleness) দুইই বৃদ্ধি পায়। এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে গোটা অস্থিকাঠামোই বিপন্ন হয়ে পড়ে। শরীরের গাঁটে ভীষণ ব্যথা এবং সামান্য নড়াচড়া হয়ে ওঠে দারণ কষ্টকর।

হাড়ের ফ্লোরোসিসের সঙ্গে বা তার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগেই সূত্রপাত হতে পারে শরীরের অন্য অংশের ফ্লোরোসিসের। এর প্রভাবে ডিএনএ, রক্তকণিকা, স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্ক, মাংসপেশি, পরিপাকতন্ত্র প্রভৃতির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে এবং হামেশাই হয়ে থাকে। মানবদেহে ফ্লোরাইডের আর একটি অপক্রিয়া পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার বিনষ্টকরণ। ফ্লোরাইড পুরুষের শুক্রানুকে এমনভাবে বিকৃত বা বিনষ্ট দেয় যা প্রজননে ব্যর্থ।

ফ্লোরাইড বিষণের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার একটি ভয়াবহ দিক হল যে জলে, খাদ্যে, ওষুধে ফ্লোরাইড আছে কিনা তা বোঝবার কোনো উপায় নেই। কারণ জলে - খাদ্যে মিশে থাকা ফ্লোরাইডের না আছে বর্ণ, না আছে গন্ধ, না আছে বিশেষ কোনো স্বাদ, আর্সেনিকের মতোই।

ভারতে ফ্লোরোসিসের ব্যাপকতার (সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি) একটি প্রধান কারণ হল তার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। শুখা অঞ্চলে, যেখানে বৃষ্টিপাত কম, সেখানে ভূগর্ভস্থ জলে ফ্লোরাইডের মাত্রা বেশি। ভারতে সর্বাধিক ফ্লোরাইড - পীড়িত অঞ্চল হল রাজস্থান। অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতিতে ফ্লোরোসিস ব্যাপক। পশ্চিমবঙ্গে ফ্লোরোসিস অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির মধ্যে আছে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, দিনাজপুর, মালদহ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাও আছে। এইসব অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলেও ফ্লোরাইডের আধিক্য। স্পষ্টতই তার কারণ ওই সমস্ত অঞ্চলের ভিত্তিশিলার (basement rock) ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। গ্র্যানাইট ও অন্য কিছু শিলায় ফ্লোরিন যুক্ত আকরিক (যথা বায়োটাইট (biotite), অ্যাম্ফিবোল (amphibole), হর্নব্লেন্ড (hornblende), অ্যাপেটাইট (apatite), ফ্লোরাইট (fluorite), মাইকা (mica) থাকলে তার উপর দিয়ে প্রবাহিত ভূগর্ভস্থ জল কিছু ফ্লোরাইড দ্রবীভূত করে নেয়। সেই জল নলকূপ মারফত উঠিয়ে পান করে চললে ফ্লোরোসিস অনিবার্য।

তবে ভারতে ফ্লোরোসিসের ব্যাপকতার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। একটি হল দেশের মানুষের দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি, যা মানুষের রোগ - প্রতিরোধ ক্ষমতা দারুণভাবে কমিয়ে দেয়। অপরটি হল দূষণ ও দারিদ্র্য-অপুষ্টি মোকাবিলায় সরকারি ব্যর্থতা।

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।
Source: society for direct initiative for social and health action (disha) 20 / 4, Shil Lane, Kolkata – 7000 015, written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Path Alias

/articles/phalaoraaida-phalaoraina-phalaoraosaisa

Post By: Hindi
×