সারা পুরুলিয়া জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর জোড়| এক একটি গ্রামের অবস্থান দেখে মনে হয় কোন এক সময় পাশে বয়ে চলা জোড়টিকে ভিত্তি করেই গ্রামটি গড়ে উঠেছিলো|
বেঁচে থাকার জন্য জলের বিকল্প নেই| বিকল্পহীন এই জলের প্রয়োজন পড়ে দু’ভাবে – প্রতিদিনের ব্যবহারের জল, চাষের জল(শিল্পের জলের চাহিদাটা আমরা পুরুলিয়ার ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত বাদ রাখতে পারি)|এ বছর পুরুলিয়ার চাষিরা ফসল ঘরে তুলতে পারেনি, কারণ এ বছর পুরুলিয়াতে বৃষ্টি খুবই কম| চাষের জন্য এখনও পুরুলিয়াকে বৃষ্টির ওপরই নির্ভর করতে হয়| পুরুলিয়ায় বৃষ্টির গড় পরিমাণ কিন্তু কম নয়, বরং বলা যায় পর্যাপ্তই| বছরে ১০৫০-১৪৫০ মিলিমিটার. সমস্যা ঋতু ভিত্তিক বর্ষণের বিন্যাস| তাহলে বলতেই হয় চাষের জল পাওয়ার মতো Management আমাদের নেই| এক কথায় অবশ্য এর সমাধান টানা যায় না| দেখে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বৃষ্টি ছাড়াও আর কি কি ভাবে আমরা চাষের জল পেতে পারি- দিঘী-পুকুর, ক্যানেল, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি থেকেও| বর্তমানে অবশ্য সব থেকে বেশি জনপ্রিয় বা বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ জল তুলে সেচ| এই ব্যবস্থাটি পুরুলিয়ায় কাজে লাগছে না তার কারণ এর ভূপ্রকৃতি|
পুরুলিয়া ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ| পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে যে ধরনের পলি ও নুড়ি জাতীয় জল ধারক পাওয়া যায় পুরুলিয়ায় তা পাওয়া যায় না| পুরুলিয়ার মাটির তলায় রয়েছে কঠিন শিলাস্তর| কোথাও কোথাও অবশ্য শিষ্টজাতীয় অভ্রময় কম কঠিন পাথরও পাওয়া যায়| তবে তা কম| এই কঠিন শিলাস্তরের যতই গভীরে যাওয়া হোক কোন জল ধারক বা বালুকাস্তর পাওয়া যায় না| ওপরের মাটির স্তর সাধারণত দু’মিটারের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়| এর তলায় রয়েছে পচা পাথর বা জীর্ণ শিলাস্তর| এ স্তরটিও ৫/৬ মিটারের বেশি নয়| কোথাও কোথাও আরও কম| এর নীচেই কঠিন শিলাস্তর, যাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম শ্রেণীভুক্ত বলা হচ্ছে| যতই গভীরে যাওয়া যাবে এই শিলাস্তর আরও কঠিন ও ঘনতর হতে থাকে| তবে ওপরের দিকে ছোট বড় বিভিন্ন পাথর এই শিলাস্তরকে বিভক্ত করে রেখেছে| জল যেখানেই থাকুক, থাকতে গেলে একটা ধারক দরকার| পলি অঞ্চলের বালুকাস্তর বালুকণা দিয়ে গঠিত বলে ছোট ছোট বালুকণাগুলির মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলিতে সহজেই জল থাকতে পারে এবং সমষ্টিগতভাবে সমগ্র বালুকাস্তরটি একটি বড় জল ধারকের কাজ করে| ফলে যথেষ্ট পরিমানে ভৌম জল পাওয়ার সুযোগ থেকে যায়| তাই পুরুলিয়ার মাটির এই গঠনে চাষের জল মাটির তলা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়| তার ওপর রয়েছে উঁচু নীচু জমির অবস্থান|
দীঘি-পুকুর, পাতকুয়ো, ক্যানেল বা অন্যান্য যে সেচ ব্যবস্থা পুরুলিয়াতে রয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যাক| Directorate of Agriculture, Govt of West Bengal বলছে পুরুলিয়াতে Net cropped area 311.69 thousand hectares Area irrigated by different sources in the district of Purulia.
(in thousand hect.) | |||||
Year | Govt.Canals | Area irrigated | 0ther source | total | |
1 | 2 | Tanks 3 | Wells 4 | 5 | 6 |
1996-97 | 29.00 | 32.00 | 10.00 | 7.00 | 78.00 |
1997-98 | 30.32 | 23.27 | 6.56 | 3.18 | 63.33 |
1999-2000 | 28.38 | 32.09 | 11.17 | 13.19 | 84.83 |
2000-2001 | 29.45 | 28.95 | 5.16 | 18.47 | 82.03 |
2001-2002 | 27.33 | 27.81 | 1.02 | 14.10 | 70.26 |
এই পরিসংখ্যান থেকে এটা বোঝাই যাচ্ছে যে এখনও আমরা সব মিলিয়ে মাত্র ২৫ শতাংশ এরিয়াও সেচের আওতায় আনতে পারিনি| যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সেই পূর্ব পুরুষের তৈরী পুকুর বা পাতকুয়ো| কেননা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের পুকুর নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই নেই| আর ক্যানেল থেকে যে মাত্র ১০-১২ শতাংশ এরিয়ায় সেচের ব্যাবস্থা রয়েছে তার জন্য সরকার কত খরচা করেছে বা প্রতি মাসে করে চলেছে তার হিসেব আমরা কেউ জানি না| তবুও দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই সেচ এরিয়া কমে যাচ্ছে|
এবার আসা যাক ব্যবহার্য জলের কথায়| পুরুলিয়ায় তো অবশ্যই, ভারতীয় সংস্কৃতিতেও ব্যবহার্য জলের চাহিদা পূরণের জন্য কুয়ো, পুকুর, বাউড়ি, সায়রেরই প্রাধান্য দেখা গেছে| পানীয় জলের চাহিদাও পূরণ হয়েছে কুয়ো-পুকুর থেকেই| এখনও এগুলির অনেকগুলিই টিকে রয়েছ| তবে এগুলি রক্ষণা-বেক্ষণের লোক কমে গিয়েছে| এই সমাজকে চালাতো যে নিয়ম, গত ইংরেজ শাসনের দুশো বছরের বিপর্যয়ে তা প্রায় ঙেঙ্গে পড়ে, আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল আমরা স্বাধীন ভারতবাসীরা সেটুকুও শেষ করতে সমর্থ হয়েছি| পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল কিন্তু তার বদলে নতুন কোন শক্তপোক্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠল না বরং একথা বলাই যায় যে জল সমস্যার যে সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থা বা Management গড়ে উঠল, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সেগুলি কম-বেশি সব জায়গাতেই অসফল| অর্থের দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষভাবে বিচার্য| (কংসাবতী নদী থেকে জল তুলে শুধুমাত্র পানীয় জলটুকু দিতে পুরুলিয়া পৌরসভাকে মাসে ১৩লক্ষ টাকা খরচা করতে হয়| তার মধ্যে ইলেকট্রিক বিলই লাগে ৭লক্ষ টাকার বেশি)|
জলের ব্যবস্থা যখন সমাজের হাত থেকে সরকারের হাতে এলো তখন থেকেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল| পাল্টাতে লাগলো ছবিটা) পরিবর্তন ঘটল গ্রাম (রুরাল) ও শহর (আর্বান) সব জায়গাতেই|
‘আশাবরী’ গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের সঙ্গে নিয়ে বাঁধটির সংস্কার করে| বাঁধ সংস্কারের মাটিত্ই তৈরী হল বাঁধের পাড় ও ধান নিয়ে যাতায়াত করার গরুরগাড়ির রাস্তা. এরপর শুর হল মাছের চাষ| ছেলে-মেয়ের পাতে মাছের টুকরোর সাথে প্রতি বছরই ঘরে উঠে আসছে কিছু না কিছু টাকা|
১৮৮৩সালে মানভূমের সদর দপ্তর মানবাজার থেকে পুরুলিয়ায় স্থানান্তরিত হল| মানভূম গেজেটিয়ারে আমরা পাচ্ছি সাহেব বাঁধের কাজ শেষ হচ্ছে ১৮৪৬সালে| পুরুলিয়ায় প্রথম পাইপ লাইন বসেছে ১৯৬৫সালে| এই ১৮৪৬ সাল থেকে ১৯৬৫সাল পর্যন্ত পুরুলিয়ায় সর্ব বৃহত, নির্ভর যোগ্য ও বলা যায় একমাত্র পানীয় জলের উত্সটি ছিল সাহেব বাঁধ| (অবশ্যই কিছুটা প্রয়োজন মেটাতো সর্বজনিক কুয়োগুলি|)১৮৮৩সালে পুরুলিয়া ২/৩ হাজার জন সংখ্যার ছোট্ট একটি গ্রাম| গেজেটিয়ার বলছে ১৯০১ সালে জনসংখ্যা ছিলো ২ (দুই) হাজার|১৯৬৫সালে পুরুলিয়ায় প্রথম শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে বয়ে চলা কংসাবতী নদী থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে জল তুলে বয়ে নিয়ে এসে পানীয় জল বিতরেণর ব্যবস্থা হলো ১৯৭২-৭৩ পর্যন্ত ব্যক্তিগত বা ঘরে সংযোগ দেওয়া হলো ৬০০ মতো| আর সাধারণের জন্য বা সর্বজনিক লাইন দেওয়া হলো ১৪০- টি| এসবকিছু করার পরও কিন্তু গ্রীষ্মকালে যখন জলের প্রয়োজন থাকে সব থেকে বেশি, সে প্রয়োজন কংসাবতী পূরণ করতে পারলো না| এই চাহিদা মোটালো সেই সাহেব বাঁধ| ১৯১১-র গেজেটিয়ারে সাহেববাঁধের আয়তন বলা হচ্ছে পঞ্চাশ একর| এখনও সাহেববাঁধের যে জল ধারণ ক্ষমতা তাতে প্রতিদিন ৩০লক্ষ লিটার জলও যদি সাহেববাঁধ থেকে তোলা হয় তাহলেও সাহেববাঁধের মি্ষ্টি জলে পুরুলিয়ার তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব| ২০০৩সাল পর্যন্ত প্রতিটি গ্রীষ্মেরই ভরসা ছিল এই সাহেব বাঁধই| আর ১৯৬৫-র আগে শহরে যেটুকু পাইপ লাইনের ব্যবস্থা ছিলো(সদর হাসপাতালে জল দেওয়ার ব্যবস্থা) তাও ছিলো সাহেব বাঁধ নির্ভর| আজও পুরুলিয়ার বহু দোকানে হোটেলে বিশেষভাবে বাসস্ট্যান্ড হসপিটাল এলাকায় সাহেব বাঁধের জলই পানীয় ও ব্যবহার্য| সাহেব বাঁধের অবস্থানটিও শহরের মাঝ খানটিতে| যদি আপনি সি.এস.১-২-৩-৪ ম্যাপ খুলে বসেন দেখবেন ৬১টি বাঁধ ছিলো পুরুলিয়ার বুকে| আর অবস্থানগুলি এমনই যে পুরো শহরের প্রয়োজন মিটতে পারে তাতে| এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম- রাজা বাঁধ, পোকা বাঁধ, নাজির বাঁধ, দশের বাঁধ, বিবির বাঁধ, দুলমি বাঁধ...( এর মধ্যে নাজির বাঁধ, দশের বাঁধ বুজিয়ে ফেলা হয়েছে, বিবির বাঁধও বোজার মুখে)|
সারা দেশ জুড়েই এমন বহু বাঁধ বা পুকুর (সাধারণভাবে পুরুলিয়াতে বাঁধেরই প্রচলন রয়েছে কেননা মালভূমির অন্তর্গত হওয়ার ফলে মাটির ঢালগুলি এমনভাবে রয়েছে যে একটি পাড় বেধেঁ দিলেই সুন্দর একটি পুকুরের আকার নেয়)রয়েছে যা উল্লেখের দাবি রাখে| বিশেষভাবে যে জায়গাগুলি আতীতে সমৃদ্ধ ছিল সেখানকার পুকুর বা বাঁধগুলি| যেমন- বেড়োতে বেড়োর বাঁধ, জয়পুরে রাণী বাঁধ, কাশীপুরের বাঁধ...| এগুলির ইতিহাস সাহেব বাঁধের থেকেও পুরোনো| এইসব গ্রামগুলিতে কিন্তু টিউবওয়েলের মতো আধুনিক প্রযুক্তি গ্রীষ্মে জলের জোগান দিতে পারছে না| তবুও শুধু পুরুলিয়াই নয় যদি আমরা সারা ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাবো বিগত ২৫০শ বছরে সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য পুকুর কোথাও তৈরী হয়নি| জল তো আমরা পেতে পারি দু’ভাবে – ১)বৃষ্টির জল ও ২) ভৌমজল. বৃষ্টির জলকেই আমরা ধরে রাখি পুকুর, ঝিল, সায়র, বাঁধ, কুয়ো (যদিও এগুলির সঙ্গে ভৌম জলেরও একটা সম্পর্ক রয়েছে) প্রভৃতিতে| আগেই বলেছি পুরুলিয়ায় বৃ্ষ্টি কিন্তু যথেষ্ট পরিমানে হয়, অন্যদিকে পুরুলিয়ার পুকুরের সংস্কৃতিটিও বড় কম দিনের নয়| ইতিহাসের পাতা খুললে আমরা দেখতে পাই ৯৬২খ্রীঃ কীর্তীনাথ শেখর তাঁর পূর্ব রাজধানী পাড়া ছেড়ে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে| সমুদ্রতল থেকে ১৬০০ ফিট উচুতে অবস্থিত এই রাজধানীতে ৩২জন রাজা রাজত্ব করেন| এই রাজধানীর জলের ইতিহাসকে চিনিয়ে দিতে এখনও চিহ্নস্বরূপ টিকে আছে দুয়ার বাঁধ এবং দুয়ার বাঁধের ওপর তৈরী তোরণটি| পাহাড়ের মাঝামাঝিও পাওয়া গেছে বিরাট এক পুকুরের অস্তিত্বের চিহ্ন| এছাড়া সম্পূর্ণ গড়টি ছিল বড় বড় পরিখা দিয়ে ঘেরা| যাঁরা এইগুলি তৈরী করেছিলেন, যাঁরা করিয়েছিলেন তাঁরা আজ আর নেই, তবুও নেই নেই করেও এমন দু-চারজনকে পাওয়া যাবে যাঁরা এই ঐতিহ্যকে চেনেন বা আমাদেরকেও চেনাতে পারেন| তবে এঁরাও বোধহয় কালের গতিতে বয়ে চলে যাবেন, পুরুলিয়ায় বর্ষিত পর্যাপ্ত বৃষ্টির জলের মতোই|
এই প্রসঙ্গে এখানে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন| সারা পুরুলিয়া জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর জোড়| এক একটি গ্রামের অবস্থান দেখে মনে হয় কোন এক সময় পাশে বয়ে চলা জোড়টিকে ভিত্তি করেই গ্রামটি গড়ে উঠেছিলো| গ্রীষ্মে যখন টিউওয়েলগুলো কাজ করে না তখম গ্রামের মানুষ নিজেরাই এই জোড়গুলির বুক চিরে ৭/৮ ফিট গভীর থেকে জল তুলে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়| অথচ বৃষ্টির জলের এক তৃতীয়াংশই উচু-নীচু জমি গড়িয়ে নদী-নালা বেয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বয়ে যায়| আর যেটুকু জল মাটির তলায় যেতে পারে তা গিয়ে জার্ণ পাথরের স্তরগুলির মধ্যে স্থান করে নেয়| কিন্তু তাও এই মাটির প্রকৃতির জন্য স্থির থাকতে পারে না| খানিকটা ঐ একই দিকে গড়িয়ে যায়, কিছুটা গিয়ে লুকিয়ে পড়ে কঠিন পাথরের ফাটলের মধ্যে|
১৯৬৫সালে পুরুলিয়ার কংসাবতী নদী থেকে যে প্ররিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা শুরু হয় ২০০৩সালে সেটিকে উন্নত করার জন্য ৫কোটি টাকা খরচ করা হলো| ওভারহেড ট্যাঙ্কগুলি পরিষ্কার করার ফলে দেখা গেল সেগুলির ২০-৩০ গ্যালন জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ল, কিন্তু তাতেও প্রয়োজনীয় জলের চাহিদা মিটল না| এদিকে ১৯৭২-৭৩সাল পর্যন্ত যে ৬০০শ বা তার কিছু বেশি হাউস কানেকশান দেওয়া হলো, তারপর বেশকিছুদিন কানেকশান দেওয়া বন্ধ থাকলো. ১৯৭৮-৭৯সালে আরও প্রায় দু’শোর মতো নতুন কানেকশান দেওয়া হলো| এরপর আর হাউস কানেকশান দেওয়া সম্ভব হয়নি| এদিকে বসতি, লোকলংখ্যা ও জলের চাহিদা বেড়েই চলেছে, তাই সর্বজনিক সংযোগগুলি পুরোপুরি বন্ধ রাখা গেল না| ১৪০টি পয়েন্ট দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে সর্বজনিক পয়েন্ট প্রায় ১০০০-এর কাছাকছি|
জলের চাহিদা বাড়লে যোগানও বাড়াতে হবে| কিন্তু কিভাবে? একমাত্র ভরসার উত্স সাহেববাঁধ রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে বর্তমানে পানের অযোগ্য চাহিদা মেটাতে খোঁড়ানো হলো ডিপ টিউওয়েল| টিউওয়েল খনন প্রভৃতি এককালিন খরচ যদি বাদও দেওয়া যায়, মাসিক জল সরবরাহের খরচ দাঁড়ালো ১২লক্ষ টাকা| তাহলে এই আলোচনায় আসতেই হয় – এই খরচ যোগাবে কে? এতো গেল শুধু পানীয় জলটুকুর কথা, ব্যবহার্য জলের হবে কি? ব্যবহার্য জলের অভাব দেখা দিয়েছে সমস্ত শ্রেনীর মানুষের ক্ষেত্রেই| কুয়োর জলে টান পড়েছে জল স্তর নেমে যাওয়ায়, আবার বেশিরভাগ জায়গাতেই টিউওয়েল সম্ভব নয় কঠিন শিলাস্তেরর জন্য(যদিও এতে জলস্তর নামবেই), পুকুরের ব্যবহারও বন্ধ হতে চলেছে কেননা এেকর পর এক পুকুর বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে, তাছাড়াও আধুনিক ধারণা বলছে পুকুরের জল পরিশ্রুত নয়| প্ররিশ্রুত করার ব্যবস্থাও তেমনভাবে গ্রহণ করা হয়নি| তাহলে জলের ব্যবস্থা হবে কিভাবে? যদি বা ধরে নেওয়া যায়, হল.| তাহলে এই পরিস্থিতিতে তার খরচ কত পড়বে? কোথা থেকে আসবে এই টাকা? যদি সাধারণ মানুষকে নিজেদের খরচা করে জলের চাহিদা মেটাতে হয় তাহলে কত জন পারবেন খরচ বহন করতে? যারা পারবেন না তাদের ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
গ্রামের ক্ষেত্রেও অবস্থা দুর্ভীগ্যজনকই| গ্রামে এখন পানীয় জলের একমাত্র উত্স বলা যায় টিউওয়েলগুলি| কুয়ো বা ইন্দারার ব্যবস্থা খুবই অল্প| যগিওবা কিছু জায়গায় রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গী আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলি ব্যবহারয়োগ্য নেই| আগে বহু গ্রামে পানীয় জলের উত্স ছিল জোড়গুলি| এখন সেগুলির প্রায় সবগুলিই নাব্যতা হরিয়েছে| সবজায়গায় টিউওয়েলগুলিতে গ্রীশ্মে জল পাওয়া যায় না, খারাপ হলে সারানোর সমস্যা, এই পরিচিত সমস্যাগুলি বাদ দিলেও ভয়ানক এক সমস্যার মুখে পড়্ছে গ্রামীন পানীয় জল ব্যবস্থা| বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আর্সেনিক না হলেও আন্য একটি গুরুতর দূষক, ফ্লোরিন রয়েছে এখানে|
এই আলোচনা থেকে আমরা একথাই বলতে পারি যে যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রাকৃতিক ও চিরাচরিত উত্সগুলিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছ, সেগুলির কথা নতুন করে ভাবা হচ্ছে ততক্ষণ সমাধান সম্ভব নয়| আর এই সম্ভাবনার যাত্রা সফল করতে আমাদের অন্য একটি দিকেও নজর দিতে হবে| আজ আমরা কেটে ছেঁটে আমিতে স্থির| সর্বত্রই আজ এই আমির প্রাধান্য| জল সমস্যার সমাধান কখনই এই আমি দিয়ে সম্ভব নয়| যে কাজটি সমস্ত সমাজের কাজ, সকলে মিলে করার কাজ, সেটি সকলে মিলেই করতে হবে|
এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে. যদিও উদাহরণটি পুরুলিয়া জেলার নয়, কিন্তু সেখানের অবস্থা পুরুলিয়ার তুলনায় কোন অংশেই ভাল ছিল না| বরং বলা চলে বহুলাংশে খারাপই ছিল-
এই পরিচিত সমস্যাগুলি বাদ দিলেও ভয়ানক এক সমস্যার মুখে পড়্ছে গ্রামীন পানীয় জল ব্যবস্থা. বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আর্সেনিক না হলেও আন্য একটি গুরুতর দূষক, ফ্লোরিন রয়েছে এখানে
রাজস্থানের জয়পুর জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম লাপোডিয়া| কয়েকবছর আগে লাপোডিয়া প্রায় তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসেছিলো| খেতে ফসল নেই, গোচারণভূমি শুকিয়ে কাঠ, পাড় ভেঙ্গে দুটো পুকুরও নষ্ট হয়ে গেছে| গ্রাম ছেড়ে সকলে জয়পুরে পালিয়ে যেতে লাগল, কিছু মানুষ ভিন্ন রাজ্যেও চলে গেল| যাদের পালানোর উপায় থাকলো না তারা সকলে মিলে প্রথমে ভেঙ্গে পড়া পুকুরগুলো ঠিক করল| তার মধ্যে একটা প্রথম বর্ষাতেই ভেঙ্গে গেল, আবার ঠিক করানো হলো| পুকুরে জল ভরে ওঠায় নীচের জমিগুলোতে ঘাস আসতে শুরু করল| শোনা যায় একসময় লাপোডিয়ায় এত গাছ ছিলো যে ছেলেরা এগাছ থেকে ওগাছে যেতে পারতো| যাইহোক এবার চেষ্টা চলল গোচারণভূমির তৃষ্ণা নিবারণের| বর্ষিত জল মাটির তলায় পাঠানোর চেষ্টা করা হল| এতে ভূগর্ভস্থ জলস্তর তো বাড়লাই, মাটির তলায় ঘুমিয়ে থাকা গাছগুলি মাথা তুলে জেগে উঠতে লাগলো| জেগে উঠল গোচারণভূমি, চাষবাসও শুরু হল আবার| একে একে প্রায় সবাই গ্রামে ফিরে এলো| শুরু হল পশুপালন(এটাই ছিল তাদের নিজস্ব জীবিকা)|এখন লাপোড়িয়াতে প্রতিদিন ১৬০০লিটার দুধ উত্পাদন হচ্ছে| জয়পুর ডেয়ারি প্রতিদিন আড়াইলাখ টাকার দুধ কেনে| ঘর, পরিবার, গ্রামের সকলের প্রয়োজন মিটিয়ে লাপোডিয়া দুধ থেকে বছরে রোজগার করে ৩০লাখ টাকা| জলের জন্য কোন প্রজেক্ট তৈরী হয়নি, দূর নদী থেকে পাইপে করে বয়ে আনা হয়নি, মাটির তলার জল তুলে নেওয়া হয়নি, যা কিছু হয়েছে বৃষ্টির জলকে কাজে লাগিয়ে| তাই আমাদের ফিরে আসতে হবে প্রাকৃতিক উত্সগুলির কাছেই, আধুনিক প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে (বিস্তারিতভাবে বিষযটি জানতে পড়তে পারেন ‘আশাবরী’ থেকে প্রকাশিত অনুপম মিশ্র লিখিত ছোট্ট একটি বই ‘লাপোডিয়া’, বইটির দাম ১০টাকা.)
উদাহরণ রয়েছে ঘরের জেলাতেও- জেলা পুরুলিয়া, পাড়া বল্ক, গ্রাম রামকৃষ্ণপুর| গ্রামে বিরাট একটি পুকুর ছিল| নাম ময়রাবাধঁ| এমনই এই পুকুরের আয়তন যে একসময় কুমির ছিল পুকুরটিতে| কাশিপুরের রাজা শিকারমঞ্চ বেঁধে সারা রাত ধরে কুমির শিকার করেছিলেন| দীর্ঘ অবহেলায় পুকুরটি আভিজাত্যই শুধু হারায়নি প্রায় ডোবার আকার নিয়েছিল| শুধু বাঁধের পিরস্থিই নয়, খারাপ হয়েছিল গ্রামের পরিস্থিতিটিও| বাঁধের মালিকদের পরিবারগুলির মধ্যে বন্ধ ছিল কথাবার্তা| পুরুলিয়ার একটি সংস্থা ‘আশাবরী’ গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের সঙ্গে নিয়ে বাঁধটির সংস্কার করে| বাঁধ সংস্কারের মাটিত্ই তৈরী হল বাঁধের পাড় ও ধান নিয়ে যাতায়াত করার গরুরগাড়ির রাস্তা. এরপর শুর হল মাছের চাষ| ছেলে-মেয়ের পাতে মাছের টুকরোর সাথে প্রতি বছরই ঘরে উঠে আসছে কিছু না কিছু টাকা| শুধু তাই নয় খরার জেলা পুরুলিয়াতেও বাঁধের নীচের জমিগুলিতে হচ্ছে বোরো চাষ| শুধুমাত্র একটি বাঁধই পাল্টে দিতে পারে গ্রামের পিরস্থিতি| আর পুরুলিয়ার ভূ-প্রাকৃতিক গঠনটি এমনই যে একটি দিকে একটি আল দিয়েই করা যেতে পারে সুন্দর একটি পুরুর|
/articles/pauraulaiyaara-jala-bayahasathaara-baiparayaya