পুকুর বাঁধা ধর্মস্বভাব


আজ সম্ভবত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কিন্তু তখন বড় বিদ্যাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তটি পুকুর তৈরীর প্রসঙ্গে বদলে যেতো| মধুবনী, দ্বারভাঙ্গা এলাকায় এই ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল বহুদিন| কোন পুকুরই একা নয়| সে ভরভরন্ত জল পরিবারের এক সদস্য| তাতে সকলের জল মিশে আছে ও তার জল মিশে আছে সকলের মধ্যে| এই কথা যাঁরা মে করেন তাঁরা সত্য সত্যই এরকমই এক পুকুর তৈরী করে দেখিয়ে দিয়েছেন| পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে বিন্দু সাগর| সমস্ত দেশের প্রবাহ, সমস্ত নদী এমনকী সাগরের জল পর্যন্ত এখানে মিলিত হয়েছে| দূর দূরান্ত থেকে পুরীতে আসেন যে সকল ভক্ত, তাঁরা নিজেদের এলাকার একটুখানি জল সঙ্গে করে নিয়ে এসে বিন্দু সাগরে অর্ঘ্য দেন| সমাজকে যা জীবন দান করে তাকে নির্জীব বলে কী করে স্বীকার করা সম্বভ? পুকুর, জলস্রোত-ই জীবন| আর মানুষ তো তার চারদিকেই জীবন রচনা করেছে| যার সঙ্গে সম্বন্ধ যত কাছের, যত স্নেহের, মন ততই তার নিত্য নতুন নাম রাখে| দেশের আলাদা আলাদা রাজ্যে, আলাদা আলাদা ভাষায়, চলিত কথায় পুকুরের অনেক নাম| চলিত কথার ভান্ডারে, ব্যাকারণে, পর্যায়ক্রমিক শব্দ তালিকাতে পুকুরের নামের এক ভর-ভরন্ত সংসার পাওয়া যায়| ডিঙ্গল ভাষার একটি ব্যাকরণ বই ‘হমির নাম মালা’-তে পুকুরের পর্যায়ক্রমিক নাম তো রয়েইছে, সঙ্গে তার স্বভাবের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ধর্মস্বভাব’ কথাটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে|

মানুষ ধর্মস্বভাবের সঙ্গে জুড়ে যায়, বাঁধা পড়ে যায়| প্রসঙ্গ যদি হয় সুখের, তাহলে পুকুর তৈরী হবে, প্রসঙ্গ যদি হয় দু:খের, তাহলেও পুকুর তৈরী হবে| জয়সলমের, বাড়মের-এর পরিবারগুলিতে সামর্থ কম থাকলে, নতুন পুকুর করার সুযোগ না থাকলে, সেই সীমিত সাধ্যে তাঁরা আগের তৈরী কোন পুকুরের পাড়ে মাটি দেওয়া, ছোটখাটো মেরামতি প্রভৃতি করতেন| কোন পরিবারে মৃত্যু না আসে? কিন্তু প্রতিটি পরিবার নিজের দু:খের প্রসঙ্গকে সমাজের সুখের জন্য পুকুরের সঙ্গে জুড়ে দিতেন|

পুরো সমাজের উপরই দু:খ এসেছে, দুর্ভিক্ষ এসেছে কিন্তু তবুও পুকুর তৈরী হয়েছে| মানুষের সাময়িক সাহায্য তো এতে হয়ই এবং জলের ব্যবস্থা হওয়ার ফলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দু:খকে সহ্য করার শক্তিও সমাজে গড়ে ওঠে| বিহারের মধুবনী এলাকায় ছয়ের দশকে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় পুরো এলাকার সব গ্রামগুলি মিলে তেষট্টিটা পুকুর খুঁড়েছিল|

এত বড় পরিকল্পনা পরিকল্পিত হওয়ার থেকে কাজে পরিণত হওয়া পর্যন্ত না জানি কত সংগঠন তৈরী করতে হয়েছিল – নতুন মানুষজন, নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থাগুলি সেটা একবার ভেবেও তো দেখতে পারে| মধুবনীতে পুকুরগুলি এখনও আছে এবং মানুষজন এখনও সে কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করে|

কোথাও পুরস্কার স্বরূপ পুকুর করে দেওয়া হতো তো কোথাও পুকুর করার জন্য পুরস্কৃত করা হতো| গোণ্ড রাজাদের সীমায় যেই পুকুর করুক তাঁকে তার নীজের জমির খাজনা দিতে হতো না| এই প্রথা বিশেষভাবে দেখা যায় সম্বলপুর এলাকায়|

দণ্ড বিধানেও পুকুর পাওয়া যায়| বুন্দেলখণ্ডে জাতীয় পাঞ্চায়েতে যখন নিজেদের কোন সদস্যকে ক্ষমাহীন কোন অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হতো, তখন সেই দণ্ডতে সাধারণত পুকুর কাটতে বলা হতো| এই ঐতিহ্য রাজস্থানেও আছে| আলোয়ার জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম গোপালপুরা, সেখানে যাঁরা পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত মানেননি দণ্ডস্বরূপ তাঁদের কিছু কিছু পয়সা গ্রাম কোষাগারে জমা করতে হয়| পরে সেই পয়সা দিয়ে ছোট ছোট দুটো পুকুর কাটানো হয়|পুঁতে রাখা সম্পত্তি কেউ পেলে নিজের জন্য নয়, ঐতিহ্য ছিলো পরোপকারে ব্যবহার করার| পরোপকার বলতে সাধারণভাবে মনে করা হতো পুকুর খোঁড়া বা পুরোনো পুকুরের সংস্কার করানো| বলা হয়, বুন্দেলখণ্ডের মহারাজা ছত্রসালের ছেলে জগতরাজ মাটিতে পুঁতে রাখা সম্পত্তির এক তালিকা পেয়েছিলেন| তালিকার নির্দেশ অনুসারে তিনি সে সম্পত্তি খুঁড়ে বার করেন| ছত্রসাল জানতে পেরে খুবই অসন্তুষ্ট হন| ছেলেকে বলেন – ‘মৃত চন্দেলকে কেন তুমি খুঁড়লে’? কিন্তু সম্পত্তি খুঁড়ে যখন বার করা হয়েই গেছে তখন তা যেন ভাল কাজে ব্যবহার হয়| তিনি পুত্রকে আদেশ দিলেন – ‘চন্দেলের তৈরী সমস্ত পুকুরগুলি মেরামত করা হোক ও নতুন পুকুর তৈরী করা হোক’ | সম্পত্তি ছিলো প্রচুর| পুরোনো পুকুরগুলি মোরামত করা হলো এবং নতুন খোঁড়াও শুরু হল| বংশ তালিকা দেখে বিক্রম সংবত ২৮৬ থেকে ১১৬২ পর্যন্ত বাইশ প্রজন্মের নামে বাইশটা পুকুর তৈরী করা হয়| বুন্দেলখণ্ডে গেলে আজও পুকুরগুলি দেখতে পাওয়া যাবে|মাটিতে খোঁড়া সম্পত্তি সকলে পায় না| কিম্তু সকলকে পুকুরের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার জন্য কিছু দৃষ্টান্ত সমাজে রয়েছে| অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা এই দিন দুটিকে ‘করাজ’ অর্থাত ভালো এবং সর্বজনীন কাজের দিন হিসাবে ঠিক করা হয়েছে| কৃষক এই দিন দুটিতে নিজের নিজের খেতে কাজ করত না, সেই সময়টা সে দিত নিজের নিজের এলাকার পুকুরের দেখাশোনা বা মেরামতিতে| সমাজে শ্রমও একটা পুঁজি| সেই পুঁজি লাগানো হতো সর্বজনীন মঙ্গলে|

শ্রমের সঙ্গে পুঁজিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে আলাদা করে| এই পুঁজির প্রয়োজন পড়বে শীতের পর পুকুরের জল কমে গেলে| তখন গ্রীষ্ম সামনে দাঁড়িয়ে, পুকুরে কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে, কোথাও ভেঙ্গে-টেঙ্গে গেছে তা দেখে নেওয়ার এটাই সবথেকে ভালো সময়| বছরের বারোটা পূর্ণিমা রাখা হয় শ্রমদানের জন্য কিন্তু পৌষের পূর্ণিমায় পুকুরগুলির তত্ত্বাবধান বা পুকুরের জন্য পয়সা জোগাড়ের চল রয়েছে| ছত্রিশগড়ে এই সময় পালিত হতো ছের-ছেরা উত্সব| ছের-ছেরা উত্সবে সকলে দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঘরে গিয়ে ধান জোগাড় করতো| সময়টাও ধান ওঠার সময়| প্রতিটি পরিবার ধান দান করতো নিজের সামর্থ অনুযায়ী| এইভাবে জোগাড় করা ধান রাখা হতো গ্রামকোষে| এই কোষ থেকেই আগামী দিনে পুকুর ও অন্যান্য সর্ব্বজনীন ক্ষেত্রের মেরামতি এবং নতুন কাজও করা হবে|

সর্ব্বজনীন পুকুরে তো সকলের শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন হতোই, ব্যক্তিগত পুকুরেও সর্ব্বজনিক স্পর্শ আবশ্যিক ছিল| পুকুর খোঁড়া হয়ে গেলে সেই এলাকার সব সর্ব্বজনিক স্থান থেকে একটু একটু করে মাটি এনে পুকুরে ফেলার প্রচলন আজও পাওয়া যায়| ছত্রিশগড়ে পুকুর হলেই তাতে ঘোড়াশাল, হাতিশাল, বাজার, মন্দির, শ্মশান, বেশ্যালয়, আখড়া ও স্কুলের মাটি এনে ফেলা হতো|

আজ সম্ভবত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কিন্তু তখন বড় বিদ্যাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তটি পুকুর তৈরীর প্রসঙ্গে বদলে যেতো| মধুবনী, দ্বারভাঙ্গা এলাকায় এই ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল বহুদিন|পুকুরেরও প্রাণ রয়েছে. তাই প্রাণপ্রতিষ্ঠা উত্সব পালিত হতো খুব ধুমধাম করে| পুকুরের নামকরণও হতো সেই দিনই| কোথাও কোথাও তাম্রফলক বা প্রস্তর ফলকে পুকুরের পুরো বিবরণ উত্কীর্ণ করা হতো|

কোথাও কোথাও বিয়ের পুরো নিয়মানুসারে বিয়ে দেওয়া হতো| ছত্রিশগড়ে এই প্রথা আজও রয়েছে| বিয়ের আগে পুকুরের জল ব্যবহার করা যাবে না| বিয়েতে পুরো গ্রাম জমা হয়| আশপাশের মন্দির থেকে মাটি আসে| গঙ্গাজল আসে| গঙ্গাজলের সঙ্গে পাঁচটা বা সাতটা কুয়ো অথবা পুকুরের জল মিশিয়ে বিয়ে শেষ হয়| কখনো কখনো প্রস্তুত কারকেরা সামর্থ অনুযায়ী পণের ব্যবস্থা করেন|

পুকুরে বিয়ের১ উত্সবের স্মৃতিতে পুকুরে স্তম্ভ বসানোর ঐতিহ্য তো রয়েইছে| কিন্তু পরে দ্বিতীয়বার যখন পুকুর পরিষ্কার বা খোঁড়া হতো সেই ঘটনার স্মরনেও স্তম্ভ লাগানোর ঐতিহ্য ছিলো|

বর্তমান পরিভাষায় বড় শহর পরিগণিত হয় জনসংখ্যার হিসেবে| অতীতে কিন্তু বড় গ্রাম বা শহরের পরিভাষায় পুকুর গোনা হতো| কত জলসংখ্যার গ্রাম বা শহর ? এ প্রশ্নের বদলে জিজ্ঞাসা কর হতো কত পুকুরের| ছত্রিশগড়ে প্রবাদে বড় গ্রামকে বলা হয়েছে ‘ছৈ আগর ছৈ কোরি’ অর্থাত ছয় কুড়ির থেকে ছয় বেশী পুকুর হওয়া চাই| বর্তমান বিলাসপুর জেলার মালহার এলাকায় যে ঈসা অতীতে স্থাপিত হয়েছিল, সেখানে একশো ছাব্বিশটি পুকুর ছিলো| ঐ এলাকারই রতনপুর (দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী), খরৌদি((সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী), রায়পুরের আরঙ্গ ও কুবরা এবং সরগুঞ্জা জেলার দীপডিপা প্রভৃতি গ্রামে আজও কোথাও বা একশো আবার কোথাও পুরো একশো কুড়িটি পুকুর গোণা যেতে পারে|

এই পুকুরগুলির দীর্ঘ জীবনের রহস্য ছিলো একটাই – মানুষের ভালোবাসা ও মমত্ব| এ শব্দটা আমার দেওয়া| এইসব দৃষ্টান্তের পর রক্ষণাবেক্ষণের মতো শব্দ বড় ছোট লাগে| ‘ভূজলিয়ার আট অঙ্গ যেমন জলে ডোবে’- এ গান গাইতে পারেন, এ কামনা২ করতে পারেন, এমন স্ত্রীলোকেরাও ছিলেন| আর এরকম স্ত্রীলোকেরা যদি থাকেন তাহলে তার পিছনে সেরকম সমাজও ছিলো, যাঁরা এই কামনাকে পূরণ করার মতো পরিবেশ তৈরী করাকে নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করতেন| ঘরগৈল, ঘরমৈল অর্থাত সব ঘরের মিলনেই পুকুরের কাজ হতো|

সকলের মিলনেই তীর্থ| যিনি তীর্থে যেতে পারেননি তিনি নিজের এলাকাতে পুকুর করিয়ে পুণ্য অর্জন করতে পারেন| যিনি পুকুর তৈরী করেন তিনি পুণ্যাত্মা| আর যাঁরা পুকুর বাঁচিয়ে রাখেন তারাও সমান সম্মানের অধিকারী| এইভাবে পুকুর এক তীর্থ| এখানে মেলা বসে| আর এই মেলায় জমা হওয়া সমাজ পুকুরকে নিজেদের নয়নে ও হৃদয়ে যায়গা দিয়েছেন|

পুকুর সমাজের মনে রয়েছে| আবার কোথাও শরীরেও| অনেক বনবাসী মানুষই পুকুর, বাউড়ির উল্কি করান| সহরিয়া সমাজ উল্কিতে পশু, পাখি, ফুল, মাছ... ইত্যাদির সাথে সীতা বাউড়ি বা সাধারণ বাউড়িও বানান| সহরিয়া নিজের শরীরকে পূর্ব পুরুষ মনে করে, সীতাজীর সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ আছে বলে ভাবে| তাই সহরিয়া খুব গর্বের সঙ্গে সীতা বাউড়ি উল্কিতে আঁকায়|

সীতা বাউড়ির বিশালতা প্রধান্য পেয়েছে ভেতরে ঢেউ| মাঝখানে একটি ছাট্ট বিন্দু, যা জীবনের প্রতীক| বিস্তারের বাইরে সিঁড়ি এবং চার কোণায় ফুল| ফুলে জীবনের সুবাস| এত কথা এক সহজ-সরল রেখাচিত্রে ফুটিয়ে তোলা খুব একটা সহজ নয়| কিন্তু যাঁরা উল্কি করেন সেই শিল্পীগণ এবং উল্কি করাতে চান যে নারী-পুরুষ তাঁদের সকলেরই হৃদয় – পুকুর, বাউড়িতে এতই বিহ্বল যে আট-দশটা রেখা, কয়েকটা ফুটকি শরীরে পুরো দৃশ্যটিকে সহজেই ফুটিয়ে তোলে| এই প্রথা তামিলনাড়ুর দক্ষিণে আরকাট জেলার কুঁরাও সমাজেও রয়েছে|

যাঁদের মনে পুকুর, শরীরে পুকুর, তাঁরা পুকুরকে শুধু একটা জলভরা গর্ত মনে করতে পারেন না| তাঁদের কাছে পুকুর এক জীবন্ত ঐতিহ্য, পরিবার ও অনেক সম্বন্ধ-সম্বন্ধী| কোন সময় কাকে স্মরণ করতে হয় সে সম্পর্কেও তাঁদের পূর্ণ চেতনা আছে| যেমন, যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে কতদূর প্রার্থনা পৌঁছতে হবে? ইন্দ্র হলেন বৃষ্টির দেবতা, কিন্তু সরাসরি তাঁকে ডাকা কঠিন, সম্ভবত ঠিকও নয়| তাঁর মেয়ে কাজল| কাজল মায়ের কাছ পর্যন্ত প্রার্থনা পৌঁছালে তিনি ভালোভাবে পিতার নজর এদিকে টানতে পারবেন| বীজ ফেলার পক্ষকালের মধ্যে বৃষ্টি না হলে কাজল মায়ের পূজা হবে| গোটা গ্রাম কাঁকড়বনি অর্থাত গ্রাম সীমার জঙ্গলে যে পুকুর, গান গাইতে গাইতে সেখানে জড়ো হবে| তারপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে সকলে প্রার্থনা জানাবে| দক্ষিণ থেকেই তো জল আসে|

পুকুর কানায় কানায় ভরে ওঠাও এক উত্সব| অপরা বইতে শুরু করেছে – সমাজের কাছে এর থেকে বড় আর কোন প্রসঙ্গ হতে পারে! ভুজ(কচ্ছ)-এর সব থেকে বড় পুকুর হমিরসর-এর ঘাটে হাতির এক মূর্তি অপরা বইতে শুরু করার সূচক| মূর্তি স্পর্শ করলেই খবর ছড়িয়ে পড়ত| শহর এসে উপস্থিত হত ঘাটে| কম বৃষ্টিপাতের এই এলাকা দিনটিকে উত্সবে স্মরণীয় করে তুলতো| ভুজের রাজা ঘাটে আসতেন ও সকলের উপস্থিতিতে পুকুরের পূজো করে ভরা পুকুরের আশির্বাদ নিয়ে ঘরে ফিরতেন| টলটলে ভরে ওঠা পুকুর শুধুই একটা ঘটনা নয়, আনন্দ ও মঙ্গলের সূচক| উত্সব, মহোত্সব রাজা-প্রজাকে ঘাট পর্যন্ত নিয়ে আসে|

এই দিনগুলিতে দেবতারাও ঘাটে আসেন. জলঝুলন উত্সবে মন্দিরগুলির চলমূর্তি৪ পুকুর পর্যন্ত আনা হয় এবং পূর্ণ শৃঙ্গারের সঙ্গে তাঁদের দোলনায় দোলানো হয়| ভগবানও শ্রাবণের ঝুলনে দোলার আনন্দ উপভোগ করেন|কোন পুকুরই একা নয়| সে ভরভরন্ত জল পরিবারের এক সদস্য| তাতে সকলের জল মিশে আছে ও তার জল মিশে আছে সকলের মধ্যে| এই কথা যাঁরা মনে করেন তাঁরা সত্য সত্যই এ রকমই এক পুকুর তৈরী করে দেখিয়ে দিয়েছেন| পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে বিন্দু সাগর| সমস্ত দেশের প্রবাহ, সমস্ত নদী এমনকী সাগরের জল পর্যন্ত এখানে মিলিত হয়েছে| দূর দূরান্ত থেকে পুরীতে আসেন যে সকল ভক্ত, তাঁরা নিজেদের এলাকার একটুখানি জল সঙ্গে করে নিয়ে এসে বিন্দু সাগরে অর্ঘ্য দেন|

এই মুহূর্তে যখন দেশের একতা প্রশ্নচিহ্নের মুখে তখন বিন্দু সাগরকে রাষ্ট্রীয় একতার সাগর বলা যেতে পারে| বিন্দু সাগর যেন অখণ্ড ভারতের প্রতীক|

ভবিষ্যত কাল কেমন হবে.. এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সব সময়ই শক্ত. কিন্তু এরও একটা মানদণ্ড ছিল – ‘পুকুর’ | নবরাত্রের পর অঙ্কুরিত যব বিসর্জন দেওয়া হয় পুকুরে| এই সময় রাজস্থানের মানুষ জড়ো হতেন পুকুরে| ভোপা অর্থাত পুরুত ঠাকুর যব বিসর্জনের পর পুকুরের জলস্তর দেখে আগত দিনের ভবিষ্যত বাণী করতেন| বর্ষা ততদিনে পেরিয়ে গেছে, পুকুরে যতটা জল আসার কথা, এসে গেছে| এখন এই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের পরিস্থিতি|আজকাল এই প্রথা প্রায় উঠেই গেছে| পুকুরের জলস্তর দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে আজ অনেক পুকুরের পাড়ে দাঁড়ানো ভোপাই বলবেন – ‘সময় খারাপ আসছে’ |

পষ্চিমবাংলাতেও পুকুরের বিয়ে এখনও প্রচলিত রয়েছে| যে পুকুরের মাঝে শাল কাঠের স্তম্ভ বা ছোট্ট মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, বুঝতে হবে সে পুকুরের বিয়ে হয়েছে| পুকুর প্রতিষ্ঠারও প্রচলন রয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠাতেও স্তম্ভ লাগানো হয়, তবে এক্ষেত্রে সাধারণত বেল কাঠ ব্যবহার করা হয়|

বাংলা বা বিহারের উত্সব – জিতাষ্টমী হা জিতিয়া| এই উত্সবের শেষে মেয়েরা পুকুর বা নদীর জলের তলায় দাঁড়িয়ে শসা জাতীয় ফল খেয়ে ব্রত বা উপবাস ভঙ্গ করেন| এই উপবাস হয় আশ্বিন মাসে| অর্থাত পুকুরের আগর তখন জলরাশিতে পরিপূর্ণ| এই উত্সবের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই সমাজের মহিলারা শুধু আট অঙ্গ ডোবার কামনাতেই তাদের ব্রত শেষ করতে চাননি, একেবারে ডুবে পরখ করে নিতে চেয়েছেন| লোককথা বলছে পুত্র লাভের কামনায় মহিলারা করেন এই ব্রত| আশ্বিনের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে সন্ধ্যায় ঘরের উঠোনে পুকুর কেটে শালিবাহন পুত্র জীমূতবাহনের পূজা করেন| লোককথা যাই বলুক, জীমূত মানে মেঘ, আর জীমূতবাহন অর্থাত মেঘযান – ইন্দ্র| তাই পুকুরের সঙ্গে, জলের সঙ্গে এই ব্রতের গভীর সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না|

বৃষ্ট হওয়া না হওয়ার অপেক্ষা না করেই বাংলায় জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ঘরে ঘরে পালিত হতো পূণ্যিপুকুর| এখন আর বাংলার মেয়েদের পূণ্যিপুকুর ব্রত করতে দেখা যায় না|

মন্দির থেকে যে বিগ্রহ বাইরে আনা যায় তা হলো চল মূর্তি|

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishra in Bengali
Path Alias

/articles/paukaura-baandhaa-dharamasababhaaba

Post By: Hindi
×