তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যানসারের মহামারী ডেকে আনতে পারে –
খনি থেকে ইউরোনিয়াম তোলা থেকে শুরু করে একটি পরমাণু কেন্দ্রকে অকেজো (decommission) করে ফেলা পর্যন্ত পুরো জ্বালানি চক্রে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ চলতে থাকে। তাই মধ্য ইউরোপের হার্জ পার্বত্য অঞ্চলে যারা ইউরেনিয়াম খনিতে কাজ করত তাদের অনেকেই মারা গিয়েছে মারাত্মক ক্যানসারে। গ্যাসীয় রেডন খনিতে ও খনির বাইরে বাতাসে ভেসে থাকার ফলেই ফুসফুসের ক্যানসার হয়। ইউরেনিয়ামের আকরিক শোধন করার পর যখন ঝড়তি পড়তি অংশ টেলিং পন্ডে ( tailing pond ) রাখা হয় তখন দুটি তেজস্ক্রিয় মৌল থোরিয়াম Th230 এবং রেডিয়াম Ra225 থেকে যায়। 500 রেম তেজস্ক্রিয়তা কোনও মানুষ পেলে মৃত্যু অবধারিত। ভারতের ঝাড়খন্ডের যাদুগোড়ায় যে ইউরেনিয়াম খনি আছে সেখানে টেলিং পন্ডের আশপাশে গ্রামের মানুষ থাকে, তারা যাতায়াত করে এবং শিশুরা খেলাধূলা করে। ট্রাকে করে যে খনিজ নিয়ে যাওয়া হয় তাতে খনিজের ধুলো বাতাসে ওড়ে, তাই খনির আশপাশের গ্রামে বিকলাঙ্গ ও পঙ্গু শিশু জন্মাচ্ছে। এদের ছবি ও ভি. ডি. ও. বর্তমান লেখকের কাছে আছে। আমেরিকার পাবলিক হেলথ সার্ভিস (P. H. S.) হিসেব করেছে যে আমেরিকার ইউরেনিয়াম খনিতে এখন যে ছয় হাজার আট শত (6800) মানুষ কাজ করছে তাদের মধ্যে ছয় শত থেকে এক হাজার (600 – 1000) মানুষ ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যাবে। দুঃখের বিষয় ভারতে এই রকম কোনও সমীক্ষা করা হয় না। যাদুগোড়া ও রাজস্থানের রাওতাভাট্টার ইউরেনিয়াম খনির আশপাশের গ্রামের মধ্যে যে বিকলাঙ্গ শিশু ও পঙ্গু শিশু জন্মাচ্ছে তা যাঁরা পরমাণু কেন্দ্র চালান তাঁরা স্বীকার করেন না।
বিল ক্লিণ্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট ছিলেন, তখন আমেরিকার চোদ্দ (14) -টি পরমাণু অস্ত্র কারখানায় সমীক্ষা হয়। সেই সমীক্ষা জানিয়েছিল যে ‘‘Cancer was found among weapons production since the start of World War II. They range from leukemia and Hodgkin’s lymphomza to cancer of prostrate, kidney, salivary gland and lung,’’ আমেরিকার তদানীন্তন এনার্জি সেক্রেটারি বিল রিচার্ডসন একটি সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিল ‘‘This is the first time that the government is acknowledging that people got cancer from radiation.’’
ইংল্যান্ডের ডিপার্টমেণ্ট অব হেলথ (Department of Health) সমীক্ষায় জানিয়েছে যে ইংল্যান্ডে, আয়ারল্যান্ডে, স্কটল্যান্ডে এবং ওয়েলসের শিশুদের দাঁতে প্লুটোনিয়াম পাওয়া যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে এবং ফ্রান্সে যে প্লুটোনিয়াম রিপ্রসেসিং প্ল্যাণ্ট আছে সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে, ইংল্যান্ডের সেলিফিল্ড এবং ফ্রান্সের লাহাগের রিপ্রসেসিং প্ল্যাণ্ট থেকে লক্ষ লক্ষ লিটার তরল বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয়।
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের নিরাপদ মাত্রা আজও অজানা -
আজ আর বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোনও নিরাপদ মাত্রা স্বীকার করেন না। কিছু সরকারি বিজ্ঞানী, যাঁরা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেন, তাঁরা বলেন যে পরমাণু কেন্দ্র থেকে যে বিকিরণ বেরোয় তা সাধারণ বিকিরণের মাত্রার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু যদি বিকিরণের মাত্রা (Background Radiation Level) সাধারণ বিকিরণ মাত্রার চেয়ে কমও হয় তাতেও ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। 1991 সালে ইণ্টারন্যাশনাল কমিশন অন রেডিয়েশন প্রটেকশন ( I. C. P. R. ) ‘Linear-no-threshold’ মডেলের প্রস্তাব দেয়। জাপানের পারমাণবিক বোমা বিস্ফারণের পর যারা বেঁচে আছে, যারা পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করে এবং যে সব শিশুরা এক্সরের মতো যন্ত্র থেকে বিকিরণ পেয়েছে তাদের ওপর সমীক্ষা হয়েছে। এইসব সমীক্ষা থেকে উপরোক্ত তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে। I. C. P. R. সুপারিশ করেছে যে যারা পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করে তাদের জন্য বিকিরণ মাত্রা পঞ্চাশ (50) মিলিসিভার্ট থেকে কমিয়ে কুড়ি (20) মিলিসিভার্ট করা হোক। এবং সাধারণ মানুষের জন্য ওই মাত্রা পাঁচ (5) মিলিসিভার্ট থেকে এক (1) মিলিসিভার্ট করা হোক। উপরোক্ত সুপারিশকে গ্রহণ করেছে United Nations Scientific Committee on the Effect of Atomic Radiation, International Atomic Energy Agency (I. A. E. A. ), World Health Organisation (W. H. O.), বৃটেনের National Radiological Protection Board এবং European Union. 1970 সালে অক্সফোর্ডের Alice Stewart তাঁর দিগদর্শী কাজে দেখান যে গর্ভের শিশু যদি দশ (10) থেকে কুড়ি (20) মিলিসিভার্ট বিকিরণ পায় তাহলে তার ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা দেখা যায়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বাস্তুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সমস্ত জীবজগতকে আক্রান্ত করে। তার ক্রিয়া তাত্ক্ষণিক নয়। তা কাজ করে ধীরে ধীরে এবং তা জমতে জমতে বিপজ্জনক মাত্রা ছড়িয়ে যায়। এই তেজস্ক্রিয়তা মানুষের দেহে কাজ করে বহুদিন ধরে, যার ফলে দশ (10) থেকে কুড়ি (20) বছর পরেও ক্যান্সার এবং জীনগত রোগ বংশ পরম্পরায় বাহিত হতে পারে।
বহু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ তাঁদের বিবেককে বিক্রি করে দেন ক্ষমতা বা আর্থিক সুবিধার জন্য। এক বিজ্ঞানী বাজারি পত্রিকায় লেখেন যে সিগরেট খেলে বা গাড়ি অথবা প্লেনে চাপলেও দুর্ঘটনা ঘটে, লোক মারা যায়, তাই বলে কি আমরা সিগারেট খাওয়া বা গাড়িতে চড়া বন্ধ করে দিয়েছি? উনি পরমাণু শক্তির বিপদ কি জানেন না, তা আমি বিশ্বাস করি না। এইসব বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই পারমাণবিক ও সামরিক শিল্প দ্বারা নিয়োজিত হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। তাই তাঁরা পারমাণবিক শক্তির যে বিরাট বিপদ সে সম্বন্ধে সত্যি কথা মানুষকে জানান না।
( জীবনের পরিবেশ, ১৬ই জুলাই ২০১২, গ্রীন সার্কল অফ ইন্ডিয়া, ৫২ / ডি / ৭ বাবু বাগান লেন কলিকাতা – ৩১)
Path Alias
/articles/paramaanau-baidayautaera-taejasakaraiya-baikairana
Post By: Hindi