পরমানু বিদ্যুত ও জীবনের নিরাপত্তা


লক্ষ লক্ষ মানুষকে চেরনবিলের আশপাশ থেকে সরাতে হয়েছে। ওই সরানোর কাজ সরকার কয়েক দিনের মধ্যে সেরে ফেলছিল। ফুকুসিমার পর জাপান সরকারও তাই করেছিল। আমি জানি না ভারতের কোনও পরমাণু কেন্দ্রে যদি কোনও দিন দুর্ঘটনা ঘটে ফুকুসিমা বা চেরনবিলের মতো, তাহলে স্থানীয় মানুষের কি দুর্দশা হবে। দুর্ঘটনা হলে তাকে মোকাবিলা করার কোনও ব্যবস্থা আমাদের দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে যেখানে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে তা সুনামি প্রবণ অঞ্চল। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কি রকম হতে পারে তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া পরমাণু কেন্দ্র থেকে বর্জ্য জল থেকে দূষণের ফলে সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহ করে যে সব মত্স্যজীবীরা বহুকাল থেকে জীবন ধারণ করছেন তাদের জীবিকা বিপর্যস্ত হবে।

কুড়ানকুলামে প্রস্তুাবিত পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের বিরোধিতায় নেমেছেন সাধারন মানুষ। নারী - পুরুষ নির্বিশেষে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। কতগুলি এন. জি. ও. -র স্বার্থ (বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য) চরিতার্থ করার জন্যই কী এই সাধারণ মানুষেরা আন্দোলন করছেন, নাকি বাস্তবিকই তারা নিজেদের সংকট বুঝতে পেরে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন?

কুড়ানকুলাম থেকে দুজন মহিলা আন্দোলনকারী এসেছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং ওই পরমাণু কেন্দ্র স্থাপিত হলে ওখানকার সাধারণ মানুষ, যাদের বেশীরভাগই মত্স্যজীবী তাঁরা, কিভাবে তাঁদের জীবন ও জীবিকা হারাবেন সে কথা জানাতে। হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ সেখানে অবস্থান করছেন মাসের পর মাস, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, পরমাণু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য জানাতে। কিন্তু এত বিরোধিতা কেন পরমাণু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ? যে আন্দোলন চলছে তার প্রধান কারণগুলি হল -

1) পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা
2) তেজস্ক্রিয় বিকিরণ
3) পরমাণু কেন্দ্রের বর্জ্যের সমস্যা
4) আয়ুশেষে পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ করার সমস্যা
5) পরমাণু কেন্দ্রের খরচ এবং
6) বিদ্যুতের এত প্রয়োজন।

যখন পরমাণু শক্তি প্রথম আহরিত হয় তখন ভাবা হয়েছিল যে এই শক্তি দূষণ মুক্ত, নিরাপদ এবং অফুরন্ত। আজ আমরা বুঝতে পারছি পরমাণু শক্তির বিপদ কী।

জীবনে নিরাপত্তার সমস্যা – প্রথম প্রশ্ন


সাম্প্রতিকালে জাপানের ফুকুসিমা দাইচির পরমাণু কেন্দ্রে ভূমিকম্প এবং সুনামির জন্য যে দুর্ঘটনা ঘটে গেল তা জাপানের মতো কোনদিন এত উন্নত প্রযুক্তির দেশে ঘটতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এই দুর্ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলাফল কি হবে তা এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা সম্ভব হয় না। যে সমস্ত কর্মীরা গলে যাওয়া চুল্লি বন্ধ করার কাজ করছিল তাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। জাপানের Nuclear and Industrial Safely Agency ( N. I. S. A. ) জানায় যে কেন্দ্রের বাইরেও তেজস্ক্রিয় সিজিয়াম এবং আয়োডিন পাওয়া গেছে। সরকারি আদেশে 20 কিলো মিটারের মধ্যে যারা বাস করে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যে ত্রিশ (30) কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারীদের সরিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে ফুকুসিমা দুর্ঘটনার পর ভাবতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর শ্রী কুমার ব্যানার্জী বিবৃতি দিয়েছিলেন যে ফুকুসুমার এমন কিছু বিপদ ঘটেনি। ফুকুসিমা বিদ্যুত কেন্দ্রে মালিক TEPCO -ও প্রথমে এই রকমই কথা বলেছিল।

1986 সালে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনবিলে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তার ফলাফল আমরা এখন জানতে পারছি। নিউইয়র্ক সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে চেরনবিল দুর্ঘটনায় প্রায় 9 লক্ষ 85 হাজার মানুষ মারা গিয়েছে। অথচ কয়েকমাস আগে ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ ব্যানার্জী কলকাতার বিড়লা মিউজিয়ামে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে চেরনবিল দুর্ঘটনায় মাত্র 30 জন লোক মারা গিয়েছে। এইরকম ডাহা মিথ্যে কথা একজন বিজ্ঞানী বিশেষ স্বার্থ ছাড়া কেমন করে বলতে পারেন ? চেরনবিল দুর্ঘটনার পর প্রায় 15 লক্ষ মানুষের থাইরয়েড গ্ল্যান্ড উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত। সোভিয়েত সরকার আদেশ দিয়েছিল যে চেরনবিলের 50 - 90 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যেন কোনও নারী গর্ভধারণ না করে। শুধু ইউক্রেনের 18 লক্ষ (18,00,000) মানুষ ওই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার মধ্যে আড়াই লক্ষ (2,50,000) শিশু। চেরনবিলের ত্রিশ (30) কিলোমিটার ব্যাসার্ধ অঞ্চল নিষিদ্ধ অঞ্চল বলে ঘোষিত হয়েছিল। প্রায় আড়াই থেকে চার লক্ষ (2,50,000 – 4,00,000) একর জমি বন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। প্রায় 25 লক্ষ (25,00,000) একর জমি মারাত্মকভাবে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত। 1987 সালের রিপোর্ট অনুসারে প্রায় দুই হাজার (2000) বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্ধ্যাত্বে পরিণত হবে। দশ হাজার (10,000) কুয়োর জল দূষিত। শাত শত ছিয়াশি (786) টি বস্তি থেকে মানুষকে সরাতে হয়েছে। পরিবেশে মিশেছে প্রায় সাতাত্তর (77) কেজি তেজস্ক্রিয় ভস্ম যা ছড়িয়ে পড়েছে এক হাজার (1000) মাইলের বেশি দূরত্বে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে চেরনবিলের আশপাশ থেকে সরাতে হয়েছে। ওই সরানোর কাজ সরকার কয়েক দিনের মধ্যে সেরে ফেলছিল। ফুকুসিমার পর জাপান সরকারও তাই করেছিল। আমি জানি না ভারতের কোনও পরমাণু কেন্দ্রে যদি কোনও দিন দুর্ঘটনা ঘটে ফুকুসিমা বা চেরনবিলের মতো, তাহলে স্থানীয় মানুষের কি দুর্দশা হবে। দুর্ঘটনা হলে তাকে মোকাবিলা করার কোনও ব্যবস্থা আমাদের দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে যেখানে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে তা সুনামি প্রবণ অঞ্চল। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কি রকম হতে পারে তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া পরমাণু কেন্দ্র থেকে বর্জ্য জল থেকে দূষণের ফলে সমুদ্র থেকে মাছ সংগ্রহ করে যে সব মত্স্যজীবীরা বহুকাল থেকে জীবন ধারণ করছেন তাদের জীবিকা বিপর্যস্ত হবে। যেরকমভাবে আতঙ্কবাদ পৃথিবীতে বাড়ছে তাতে যে কোনওদিন পরমাণু কেন্দ্র আক্রান্ত হতে পারে।

(জীবনের পরিবেশ, ১৬ই জুলাই ২০১২, গ্রীন সার্কল অফ ইন্ডিয়া, ৫২ / ডি / ৭ বাবু বাগান লেন কলিকাতা – ৩১)

Path Alias

/articles/paramaanau-baidayauta-o-jaibanaera-nairaapatataa

Post By: Hindi
×