সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণীদেহে প্রচুর আর্সেনিক যৌগ পাওয়া যায়। এদের বেশিরভাগই নির্দোষ ও নির্বিষ আর্সেনিক। যথা আর্সেনোবিটেন, আর্সেনোগার ইত্যাদি। আর্সেনোবিটেনের প্রাচুর্যই সর্বাধিক পরিবেশে রাসায়নিক, ভৌতিক ও জীবসমূহের প্রাণ রাসায়নিক ক্রিয়া -বিক্রিয়ায় আর্সেনিকের বহু প্রজাতি সমূহের নিয়ত রূপান্তর ঘটে চলে। যৌগে আর্সেনিকের জারণ স্তর, প্রজাতির রাসায়নিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে তার সঞ্চরণশীলতা, জীব লভ্যতা, জীবদেহে বিষক্রিয়া প্রভৃতির। প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক রসায়নের প্রতিষ্ঠিত সূত্রাবলী থেকে পরিবেশের বাস্তব অবস্থায় কী ধরনের আর্সেনিক প্রজাতি উত্পন্ন হওয়ার বেশি সম্ভাবনা, বিশেষ করে তার জারণস্তর, অর্থাত As(III), না As(V) কোনটি সমধিক সুস্থিত থাকবে।
pE ও pH স্কেল
পরিবেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে যে সব কারণগুলি জারণ - বিজারণ বিক্রিয়া সমূহে সক্রিয় তারা জটিল ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। প্রথাগত রসায়ন বিজ্ঞানের অতি সরলীকৃত অবস্থা বিবেচনা করে তাপগতিবিদ্যালব্ধ আদর্শ সূত্রাবলির প্রয়োগে সর্বত্র সঠিক চিত্র বা বিক্রিয়ার সঠিক দিশা মেলে না। কারণ As(V) / As(III), এমনকী Fe(III) / Fe(II) –এর মতো সিস্টেমেও জলীয় মাধ্যমের অম্লতা – ক্ষারকীয়তা ( যা pH দিয়ে মাপা হয় ), জটিল যৌগ সৃষ্টির নানান লিগ্যান্ডের উপস্থিতি, অধঃক্ষেপন বা পরিশোষণ প্রভৃতি হিসাবের মধ্যে আনতে হলে রসায়ন বিজ্ঞানের আদর্শ সমীকরণের ( যথা- নার্নস্টসমীকরণ ) প্রয়োগে সঠিক তথ্য, বিক্রিয়ার পরিসর, এমনকী দিশা পর্যন্তও সঠিকভাবে সর্বত্র পাওয়া যায় না। তাই পরিবেশে বিজ্ঞান, ভূরসায়ন ইত্যাদি উপবিজ্ঞানে দ্বি -মাত্রিক pE-pH লেখচিত্র বহু ব্যবহৃত। এই ধরনের চিত্র থেকে এক নজরে পরিবেশের বিশেষ বাস্তব অবস্থায় আর্সেনিকের কোন রাসায়নিক প্রজাতি সুস্থিত, তা সহজে বোঝা যায়।
আর্সেনিক প্রজাতি সমূহের জীব রাসায়নিক রূপান্তর
জীবমন্ডলে জীব জীবাণুসমূহে আর্সেনিকের রাসায়নিক প্রজাতি সমূহের নানাবিধ রূপান্তর নিয়ত ঘটে চলে নানারকম প্রাণরাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় জারণ, বিজারণ, মিথাইল সংযোজনে আর্সেনিক - কার্বন রাসায়নিক বন্ধনের অণু - উত্পাদন ও নানরকম আর্সেনিক যৌগের জীব সংশ্লেষ ( biosynthesis ) সংঘটিত হয়। স্থল ভাগের মৃত্তিকা, জলাশয়ের সেডিমেণ্ট, উদ্ভিদ, প্রাণী, জীবাণু এবং সমুদ্রের জৈব সক্রিয় অঞ্চল সমূহে আর্সেনিকের জীবরাসায়নিক নানাবিধ রূপান্তর ঘটে। উত্পন্ন প্রজাতি সমূহের প্রকৃতি নির্ভর করে মাধ্যমের জারণ ক্ষমতা, অম্লতা – ক্ষারকীয়তা, ধাতব সালফাইড, আয়রনের ঘনত্ব, মাধ্যমের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা এবং জীব প্রজাতি সমূহের প্রকৃতি ও বিস্তারন।
জারণ - বিজারণ
As(V) মাটিতে As(III) –তে রূপান্তরিত হয়, আবার বিপরীত ক্রমও ঘটে। সামান্য বিজারক পরিবেশে As(III) -এর আধিক্য। অত্যধিক বিজারক পরিবেশে আর্সাইন [(As(III)] -এর উত্পত্তি। আবার অপেক্ষাকৃত বায়বীয় পরিবেশে As(III) -এর প্রাধান্য।
জারণ
জীবদেহে As(III) -এর বিষক্রিয়া As(V) -এর চেয়ে বেশি। তাই জীবজগতে সর্বত্রই প্রায় দেখা যায় প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ায় As(III) জারিত হয়ে As(V) –এ পরিণত হয়।
5 টি প্রজাতির 15 টি জাতের আর্সেনাইট জারক জীবাণু সনাক্ত হয়েছে।
3 টি সিউডোমেনাস ( Pseudomonas )
1টি জ্যান্থোমোনাস ( Xanthomonas )
1টি অ্যাক্রোমোব্যাকটর ( Achromobactor )
এইগুলিতে জারণ লব্ধ শক্তি জীবাণুর পুষ্টিতে কাজে লাগে না। এছাড়া 34 টি বিভিন্ন প্রজাতির আর্সেনাইট জারণকারী সিউডোমোনাড জীবাণু পয়ঃপ্রণালীর ময়লা থেকে পাওয়া গেছে। এরা দুটি জাতের।
Pseudomonas fluorescens – arsenoxydans ও Pseudomonas acedovorans.
Alcaligens প্রজাতির একটি জাত Achromobactor মাটি থেকে পাওয়া গেছে যারা As(III) কে As(V) -এ জারিত করে।
আর্সেনিকের স্বাভাবিক আকরিক অরপিমেণ্ট (As2S3) Ferrobacillus ferroxidans দ্বারা জারিত হয়ে আর্সেনেটে পরিণত হয়। আর্সেনোপাইরাইট (FeAsS), এনার্জাইট (Cu3AsS4) ও জীবাণু দ্বারা জারিত হয়ে As(V) -এ পরিণত হয়।
বিজারণ
সাধারণ জলীয় Pseudomonas fluorescens As(III) কে As(III) -তে বিজারিত করে।
রয়ঃপ্রণালীর ময়লা কাদার অবায়ুজীবী জীবাণু As(V) -কে As(III) -তে পরিণত করে। মদের ঈস্ট ইঁদুরের ও অন্যান্য জীবজন্তুর পাকস্থলির জীবাণুসমূহ As(V) কে As(III) -তে বিজারিত করে।
আর্সাইন উত্পাদন MexAsH3-X ( X = 0 – 3 )
অবায়বীয় পরিবেশে মাটি থেকে সংগৃহীত Pseudomonas এবং Alcaligens bacteria As(III) থেকে আর্সাইন As(III) উত্পন্ন করে। আর্সেনিকের বিজারণ ও মিথাইল সংযোজন এক সঙ্গেই হয়। আর্সেনিক ঘটিত পদার্থ থেকে আর্সাইন উত্পাদনচ্যালেঞ্জার আর্সেনিকের ওপর ছত্রাকের ক্রিয়া নিয়ে সারা জীবন প্রচুর গবেষণা করেন। 1945 সালের তাঁর রিভিউটি (Chem Revs 1945) বহু নির্দেশিত। তিনি চার জাতের ছত্রাক (Scopulariopsis brevicaulis) নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা করে দেখান যে ছত্রাকের বিক্রিয়ায় আর্সাইন গ্যাসসমূহের [AsH3-X] অন্তত কয়েকটি ছিল গোসিও গ্যাস (Gosio Gas) নীচে চ্যালেঞ্জারের ও তার পরবর্তী কাজ থেকে সংগৃহীত কিছু তথ্য পরিবেশন করা হল।
পরীক্ষা মাধ্যম ( বা মিডিয়াম ) ছিল রুটি, তরল গ্লুকোজ বা অন্যান্য বিশেষ মাধ্যম।
আর্সেনিক ঘটিত পদার্থ | উত্পন্ন আর্সাইন |
As2O3, Na2HAsO4, MeAsO(ONa)2 | Me3As গ্যাস |
EtAsO(ONa)2 | EtMe2As |
BuAsO(OH)2 | BuMe2As |
HOOC CH2(CH3)AsO(OH)2 | Me3As |
(MeAsO)3 | Me3As,MeAsH2,Me2AsO(OH)2 |
এইরকম আরো বিস্তর পরীক্ষাবদ্ধ তথ্য বিজ্ঞানসাহিত্যে আছে।
এই থেকেই আর্সেনিক শনাক্তকরণের ছত্রাক পরীক্ষা (Mycological test for Arsenic) উদ্ভাবিত হয়েছে। S. brevicaulis আর্সাইন (AsH3) উত্পন্ন করে না। এই ছত্রাকটি As(V) ও As(III) উভয়েই মিথাইল সংযোজন করতে পারে। অ্যালকিল আর্সেনিক ও ডাই অ্যালকিল আর্সেনিক অ্যাসিড থেকে যথাযথ (appropriate) মিথাইল আর্সাইন উত্পন্ন হয়। যথা – Rme2As, RR’MeAs. অন্যান্য কিছু ছত্রাক ও ঈস্ট আর্সেনিকে মিথাইল করতে পারে দৃষ্টান্ত
ক্যান্ডাইডা হিউমিকোলা (Candida humicola)
গ্লায়োক্লোডিয়াম রোজিয়াম (Gliocladium roseum)
একজাতের পেনিসিলিয়াম (Penicillium)
এ সবই কাঁচা ময়লা (raw sewage) থেকে সংগৃহীত হয়।
উত্পন্ন গ্যাসসমূহকে গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি দ্বারা পৃথক করে মাস স্পেকট্রোফটোমিটারে সনাক্ত হয়েছে।
Me3AsO থেকে ছত্রাক দ্রুত Me3As উত্পন্ন করে।
আর্সেনিকে ব্যাকটেরিয়ার মিথাইল সংযোজন
আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত মানুষের নিশ্বাসে রসুনের গন্ধ ইঙ্গিত দেয় মানুষের অন্ত্রের কিছু জীবাণু আর্সেনিকে মিথাইল সংযোজন করে আর্সাইনে পরিণত করে।
1971 সালে পওয়া গেছে মিথানোব্যাকটেরিয়ার MOH জাতটি অবতায়িত পরিবেশে রসুনের বিশ্রী গন্ধের আর্সাইন গ্যাস বিমুক্ত করে। গ্যাসটি সম্ভবত Me2AsH। মিথানোব্যাকটেরিয়াম থার্মোঅটোট্রফিকাম (Methanobacterium thermoautotrophicum) উত্পন্ন করে Me3As, Me2AsH। ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক মিথাইল সংযোজনের আরো বিস্তর তথ্য পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয়েছে।
জলাভূমি বা বন্যা প্লাবিত ভূমিতে, বিশেষ করে যদি সেখানে বিয়োজিত জৈব পদার্থ থাকে, সেখানে As(V) As(III) তে বিজারিত হয়। প্রচুর আর্সাইন গ্যাসও উত্পন্ন হয়ে মাটিতে আর্সেনিকভাবে লাঘব করে। প্রতি বছর প্রায় 21,000 টন আর্সেনিক এইভাবে মাটি থেকে বাতাসে যায়। খনি নিষ্কাশিত ময়লা জলে, বায়বীয় উভয়বিধ পরিবেশেই মিথাইল সংযোজিত আর্সেনিক জৈব যৌগ উত্পন্ন হয়।
আর্সেনিক দূষিত পরিবেশের Cyanobacteria Phormidum sp As(V) কে As(III) তে পরিণত করে। শৈবাল কণা, ডায়াটম, ডিনোফ্ল্যাজেলেটস (dinoflagelletes) প্রভৃতিরা জীবমিথাইলেশন করে।
সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণীদেহে প্রচুর আর্সেনিক যৌগ পাওয়া যায়। এদের বেশিরভাগই নির্দোষ ও নির্বিষ আর্সেনিক। যথা আর্সেনোবিটেন, আর্সেনোগার ইত্যাদি। আর্সেনোবিটেনের প্রাচুর্যই সর্বাধিক। এর আবিষ্কার সাম্প্রতিক, 1977 সালে পাথুরে চিংড়িতে (rock lobster) সবরকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেই এর আণবিক গঠন সুনির্দিষ্ট হয়েছে। আর্সেনোসুগার বিপাকীয় ক্রিয়ায় আর্সেনোবিটেনে পরিণত হয়। চিংড়ি থেকে শামুক, ঝিনুক, নানারকম সামুদ্রিক মাছে জৈব রাসায়নিকের আধিত্য। পৃথিবীতে রেকর্ড পরিমানে আর্সেনিক সঞ্চয় পাওয়া গেছে Thanyx marione নামে একটি polychaete worm-এ তার শুকনো দেহে আর্সেনিক মাত্রা 2000 পিপিএম। আর তার একটি অঙ্গে (palps) আর্সেনিকমাত্রা 6000 থেকে 13, 000 পিপিএম। এর বেশিটাই জৈব আর্সেনিক। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাহিত্যভান্ডারে জীবমন্ডলের সর্বত্র আর্সেনিক যৌগসমূহের উপস্থিতি মাত্রা, রাসায়নিক প্রকৃতি ও রসায়নিক ক্রিয়াবিধির বিপুল তথ্য ছড়িয়ে আছে।
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Path Alias
/articles/paraibaesae-parajaataisamauuhaera-sausathaitai-o-rauupaanatara
Post By: Hindi