মার্কো পোলোর একটি অদ্ভূত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যাপার অবশ্য আজও অস্পষ্ট থেকে গেছে। ইরানের পূর্ব সীমান্তে কেরমানের কাছে উপজাতীয় কিছু লোকেদের মধ্যে মার্কো পোলো জঙ্গি মেজাজ ও কলহপ্রিয়তার (bellicosity) অভাব লক্ষ্য করেন। সেখানকার মাটির বৈশিষ্ট্য এর কারণ বলে মনে করে মার্কোলোলো অন্য জায়গা থেকে মাটি আমদানি করে উপজাতিদের তাঁবুর চারপাশে দেবার ব্যবস্থা করেন। এর পর ওই মানুষদের ভিতর জঙ্গি মেজাজ লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে এটাই সম্ভবত প্রথম সফল পরীক্ষা।মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই নানাবিধ রোগব্যাধি ছিল তার নিত্য সহযাত্রী। রোগমুক্তির চেষ্টায় মানুষকে সেই আদিম কাল থেকেই অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। এই সংগ্রামে সাফল্য ও ব্যর্থতা, দুইই মানুষের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এসব বিষয়ে চিকিত্সাবিদ্যার ইতিহাসে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এ ও সত্যি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের আগে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক চিকিত্সাবিদ্যা গড়ে ওঠেনি। লুই পাস্তুর, রবাট কক, রোনাল্ড রস প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা কলেরা, টাইফয়েড, প্লেগ, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ভয়ংকর ভয়ংকর রোগ - ব্যাধির প্রকৃত কারণ জীবাণুসমূহ আবিষ্কার করে চিকিত্সা বিদ্যাকে বিজ্ঞানের স্তরে উন্নীত করে মানব সভ্যতাকে সুস্বাস্থ্য ও সুন্দরতর জীবনের পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। এই অসাধারণ সাফল্য সমূহের আত্মসন্তুষ্টিতে মগ্ন মানুষ অস্বাস্থ্য ও অসুখ - বিসুখের অন্যান্য উত্স সম্বন্ধে দীর্ঘদিন উদাসীন থেকে গিয়েছিল। তারপর ক্রমশ ভূতত্ত্ব, রসায়ন, প্রাণরসায়নের অগ্রগতি মানুষকে সুস্বাস্থ্য ও উন্নতির পথে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। এইসব বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার অন্যতম সুফল হল আজকের স্বাস্থ্য - ভূতত্ত্ব বা মেডিক্যাল জিওলজি। বিগত চল্লিশ - পঞ্চাশ বছর ধরে এটা তৈরি হয়ে চলেছে।
বিগত শত সহস্র বছর ধরে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই কোনো না কোনোভাবে বুঝে এসেছে যে পৃথিবীর সব জায়গা সমান স্বাস্থ্যকর নয়। কোনো কোনো জায়গা বেশি স্বাস্থ্যকর আবার কোনো কোনো জায়গা কম স্বাস্থ্যকর। কোনো স্থানের জলবায়ু, অর্থাত তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা ইত্যাদিই শুধু নয়, সেখানকার জল, খাদ্য, মশা - মাছি পোকামাকড়ের উপদ্রব প্রভৃতিও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্য চিকিত্সা বিদ্যার জনক প্রাচীন গ্রিক মনীষী হিপোক্রাটিস (আনুমানিক 460 - 370 খ্রিষ্ট পূর্বাদ্দ) তাঁর বাতাস, জল ও স্থান গ্রন্থে বলে গেছেন -
চিকিত্সাবিদ্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে এই ভাবে অগ্রসর হতে হবে ...
আমাদের জল সমূহের গুণগত মানও বিচার করতে হবে। কারণ জল সমূহ যে শুধু স্বাদে ও ওজনে একে অপরের থেকে ভিন্ন হয় তাই নয়, তাদের গুণাবলির দিক থেকেও তারা আলাদা হয়।
হিপোক্রাটিস আরও বলেছেন যে কোনো কোনো অবস্থায় মাটি থেকে উষ্ণ জল ওঠে। এই জলে থাকতে পারে লোহা, তামা, রুপো, সোনা, গন্ধক, ফিটকিরি, আলকাতরা বা সোরা। এইসব জল সবসময়েই খারাপ।
ইটালিয়ান পর্যটক মার্কোপোলো ও তাঁর খুড়ো নিকোলো ইটালি থেকে চিনের মহান সম্রাট কুবলাই খানের দরবারে যাওয়ার পথে (1270 -এর দশকে) বিরাট লপ মরুভূমির দক্ষিণ - পূর্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। মার্কোপোলো লিখে গেছেন —
দশদিন পরে তাঁরা সু-চাও প্রদেশে পৌঁছোলেন। ওই পার্বত্য পথে যাতায়াতকারী ভ্রমণকারীরা অন্য অঞ্চলের নয়, ওই অঞ্চলের ঘোড়াতে যাওয়াই প্রশস্ত বিবেচনা করেন। এর কারণ ওই পার্বত্য অঞ্চলে এক ধরনের বিষাক্ত গুল্ম হয়। ওই অঞ্চলে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ঘোড়াগুলি ওইসব গুল্মগুলিকে চেনে এবং সেগুলিকে সযত্নে পরিহার করে চলে। অন্য অঞ্চলের ঘোড়াগুলি তা করে না এবং ওইসব বিষাক্ত গুল্ম খায়। এর ফলে অনিবার্যভাবে তাদের খুর নষ্ট হয়ে যায়।
মার্কো পোলো যা জানতেন না তা স্বাস্থ্য - ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে আজ জানা গেছে। চিনের যে অঞ্চলের কথা আলোচনা করা হয়েছে সেসব অঞ্চলের মাটিতে প্রচুর সেলেনিয়াম আছে। মার্কো পোলো ঘোড়ার ব্যাধির যে লক্ষণগুলির বর্ণনা করেছেন সেগুলি সেলেনিয়াম বিষণেরই লক্ষণ। মার্কো পোলোর বর্ণনা সম্ভবত সেলেনিয়াম বিষণের প্রথম বিবরণ। ( তবে সেলেনিয়াম শুধু ক্ষতিই করে না। প্রাণী দেহে সেলেনিয়ামের অত্যাবশকতা 1960 - এর দশকে আবিষ্কৃত হয়। সামান্য পরিমানে সেলেনিয়াম গ্লুটাথায়োন এনজাইমে অত্যাবশ্যক। এই এনজাইমটি দেহকোষে উদ্ভূত হাইড্রোজেন পারোক্সাইডকে নষ্ট করে দেহকে রক্ষা করে। এবং হৃদপিণ্ডের সংবহনতন্ত্রীয় অসুখ - বিসুখের প্রতিরোধ করে)।
মার্কোপোলো মরুদ্যান শহর ইয়ারকান্ড (বর্তমান নাম শাচে, অবস্থান চিনের সিনজিয়ান প্রদেশে) অঞ্চলে গলগণ্ড রোগের প্রকোপ লক্ষ করেন এবং এর জন্য অঞ্চলের জলকেই দায়ী করেন। আজ জানা গেছে যে প্রাচীন চিন, গ্রিস, মিশরে এবং পেরুর ইনকা দেশে ব্যাপক গলগণ্ড রোগ হত, আবার এইসব নিরাময় - নিবারণের জন্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ (কেল্প)-এর ব্যবহারও আবিষ্কৃত হয়েছিল। আজ আমারা কেমিস্ট্রির বই থেকে জানি, কেল্পের মতো সামুদ্রিক উদ্ভিদ আয়োডিনের ভালো উত্স ও গলগণ্ড রোগের কারণ হল দেহে আয়োডিনের ঘাটতি।
বর্তমানে ভারত ও নেপালের তরাই অঞ্চলে গলগণ্ড রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। স্পষ্টতই তার কারণ জল ও খাদ্যবস্তুতে আয়োডিনের ঘাটতি। যার কারণ আবার আঞ্চলিক ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাত অঞ্চলের ভূত্বকে আয়োডিন কম। আয়োডিনের অভাবে শরীরে থাইয়েড হরমোন উত্পাদন ব্যাহত হয়। থাইরয়েড হরমোন বৃদ্ধির প্রয়াসে থাইরয়েড গ্রন্থিটি স্ফীত হয়ে চলে। এটা গলগণ্ড রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। রোগ ও রোগের কারণ বোঝা গেলে তার বিজ্ঞানসম্মত চিকিত্সা করা সম্ভব। যেমন আজকাল, ভারত সরকারের নির্দেশে লবণে আয়োডিন যোগ (আয়োডাইজ) করা হয়।
মার্কো পোলোর একটি অদ্ভূত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যাপার অবশ্য আজও অস্পষ্ট থেকে গেছে। ইরানের পূর্ব সীমান্তে কেরমানের কাছে উপজাতীয় কিছু লোকেদের মধ্যে মার্কো পোলো জঙ্গি মেজাজ ও কলহপ্রিয়তার (bellicosity) অভাব লক্ষ্য করেন। সেখানকার মাটির বৈশিষ্ট্য এর কারণ বলে মনে করে মার্কোলোলো অন্য জায়গা থেকে মাটি আমদানি করে উপজাতিদের তাঁবুর চারপাশে দেবার ব্যবস্থা করেন। এর পর ওই মানুষদের ভিতর জঙ্গি মেজাজ লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে এটাই সম্ভবত প্রথম সফল পরীক্ষা।
বর্তমানে আমেরিকায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, আর সব বিষয়ে এক হওয়া সত্ত্বেও সব জায়গার ক্যানসারের হার সমান নয়। এর কারণ হিসেবে আঞ্চলিক ভূতত্ত্ব ও জলের বৈশিষ্টের ভূমীকা অনুমান করা হচ্ছে।
মাটিতে অজৈব মৌলিক পদার্থের উপস্থিতির আধিক্য বা স্বল্পতার দরুন উদ্ভিদ, পশু ও মানুষের শরীরে যে সব নানা রকমের অশুখ - বিসুখ হয় তার বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক নাম ছিল। যেমন, মধ্য ইংল্যাণ্ডের মিডল্যান্ড অঞ্চলে আয়েডিনের অভাব জনিত গলগণ্ড রোগের নাম ছিল ‘ডার্বিশায়ার নেক’। এই নামের উত্পত্তি মিডল্যান্ড এলাকার ডার্বিশায়ার কাউণ্টির নামে। আবার দক্ষিণ - পশ্চিম ইংল্যান্ডে বডমিন মুর নামক অসুখের কারণ হল এই অঞ্চলের গ্র্যানাইট শিলায় কোবাল্টের স্বল্পতা। নামের উত্পত্তি ‘বডমিন মুর’ এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরের নামক অসুখের কারণ হল এই অঞ্চলের গ্র্যানাইট শিলায় কোবাল্টের স্বল্পতা। নামের উত্পত্তি বডমিন মুর নামক এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে। এই প্রান্তরে যে ভেড়ারা চরত তারা শুকিয়ে নির্জীব হয়ে পড়ত ও শেষ পর্যন্ত মারা যেত। কোবাল্টের স্বল্পতা জনিত ভেড়াদের এই রোগকে ইংল্যান্ডে Pining বা ‘শুকিয়ে যাওয়া’ রোগও বলা হত। নিউজিল্যাণ্ডে প্রতিপালিত ভেড়া ও অন্যান্য পশুদের মধ্যে এই রোগকে বলা হত ‘বুশ সিকনেস বা মর্টন মেইনস’ ডিজিজ। কেনিয়াতে এই অসুখের নাম ছিল ‘নাকুরুয়াইটিস’ (Nakuruitis); ডেনমার্কে ভস্ক বা ভস্কহেড (Vosk Voskhed); জার্মানিতে হিনশ (Hinsch) এইসব রোগ সৃষ্টির কারণ যে কোবাল্ট ঘাটতি তা 1935 সালে আবিষ্কার করেন ডঃ এপিক আন্ডারউড। ওই সব অঞ্চলের মাটিতে কোবাল্ট কম থাকার ফলে, ওই অঞ্চলের তৃণভোজী পশুদের অন্ত্রের উদ্ভিদ কণাসমূহ (microflora) জীব শরীরে অত্যাবশ্যক কোবাল্ট যৌগ কোবালামিন বা ভিটামিন বি -12 সংশ্লেষ করতে পারে না। কারণ জানার ফলে এইসব রোগের নিরাময় সহজসাধ্য হল। কোবাল্ট ক্লোরাইড খাওয়ানোর ব্যবস্থা হল।
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: society for direct initiative for social and health action (disha) 20 / 4, Shil Lane, Kolkata – 7000 015, written by Prof. Manindra Narayan Majumder
Path Alias
/articles/maedaikayaala-jaiolajai-baa-sabaasathaya-bhauutatataba
Post By: Hindi