তাই মরুভূমিতে জ্যৈষ্ঠকে কেউ গালমন্দ করে না l পুরো শরীর ঢেকে রাখা হয়, শুধু মুখটুকু খোলা থাকে l জোরে বয়ে চলা দক্ষিণী হাওয়া বালি তুলে তুলে মুখে ছুঁড়ে মারতে থাকে l তবুও যারা পশু চরায় অথবা গোয়ালারা, তারা জ্যৈষ্ঠকে গান গেয়ে স্বাগত জানায় এবং জ্যৈষ্ঠকে পাঠানোর জন্য শুদ্ধ কবির-ই শৈলীতে প্রভুকে ধন্যবাদ দেয় l ‘জেঠ মহিনো ভঁলা আয়ো দক্ষণ বাজে বা (হাওয়া), কানোঁ রে তো কাঁকড় বাজে ওয়ারে সাঁই ওয়াহ’ l
মরুভূমিতে মেঘের এক টুকরো হালকা রেখা দেখা গিয়াছে কী যায়নি ছোটদের দল একটা বড় চাদর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে l আটটি ছোট ছোট হাত চাদরটাকে চার কোণায় মেলে ধরে থাকে l এবার দলটা ঘরে ঘরে যাবে সঙ্গে চলবে গান-ডেডরিয়ো করে ডরুঁ,ডরুঁ
পালর পানি ভরুঁ ভরুঁ
আধি রাত রি তলাই নেষ্টেই নেষ্টে…
প্রতিটি ঘর থেকেই চাদরে এক মুঠো করে গম দেওয়া হয় l কোথাও কোথাও বাজরার আটাও l পুরো পাড়া পরিক্রমা হতে হতে চাদরের ওজন বাড়তে থাকে এবং ছোট ছোট আটটি হাত ওজন তুলতে যথেষ্ট মনে হয় না l চাদর গুটিয়ে নেওয়া হয় l এবার এই দলটা কোথাও একটা জমা হবে l আনাজ সেদ্ধ করে তৈরি হবে গুগরি1 l কণা কণা সংগ্রহ এইভাবে বাচ্চাদের তৃপ্ত করে l
এবার বড়দের পালা- বিন্দু বিন্দু করে জল সংগ্রহ করে সারা বছর ধরে তৃপ্ত থাকার l কিন্তু রাজস্থানের জল সংগ্রহের ঐতিহ্যটিকে বোঝার আগে এই জায়গাটার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হওয়া প্রয়োজন l
কমপক্ষে জলের ব্যাপারে রাজস্থানের কুণ্ডলী শুভ l নিজেদের প্রচেষ্টা ও কৌশলে এটিকে মঙ্গলময় করে তোলা অবশ্য খুব একটা সহজ কাজ ছিল না l কাজটা আবশ্যই কঠিন আবার জায়গার বিস্তৃতিটাও কম নয় l ক্ষেত্রফলের হিসেবে বর্তমান রাজস্থান দেশের সব থেকে বড় রাজ্য l দেশের ক্ষেত্রফলের শতকরা এগারো ভাগ, প্রায় 3.42.215 বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তৃতি l এই হিসেব অনুযায়ী বলা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনাতেই ক্ষেত্রফলে বড় আমাদের এই রাজ্য l ইংল্যাণ্ডের থেকে তো দ্বিগুণই বলা যায় l
প্রথমে ছোট বড় মিলিয়ে একুশটা রিয়াসত ছিল, এখন একত্রিশটা জেলা l এর মধ্যে তেরোটা জেলা রয়েছে আরাবল্লী পর্বতমালার পশ্চিমে আর বাকিগুলো পূর্বে l পশ্চিম ভাগের তেরোটি জেলার নাম হল : জয়সলমের, বাড়মের, বিকানের, যোধপুর, জালৌর, পালি, নগৌর, চুরু, শ্রীগঙ্গানগর, সিকর, হনুমানগড়, সিরোহি ও ঝুঁঝনু l পূর্বে ও দক্ষিণে পড়ে – বাঁসওয়াড়া, ডুঙ্গারপুর, উদয়পুর, কাঁকরোলি চিতোরগড়, ভিলওয়াড়া, ঝালওয়াড়, কোটা, বারাঁ, বুঁদি, ঢোঁকা, সওয়াইমাধোপুর, ধৌলপুর, দৌসা, জয়পুর, অজমের, ভরতপুর ও অলওর জেলা l এই রাজ্যের সব থেকে বড় জেলা হল জয়সলমের l জয়সলমের বিস্তৃতি প্রায় 38.400 বর্গ কিলোমিটার। সব থেকে ছোট জেলা হল ধোলপুর, যা জয়সলমেরের দশ ভাগের এক ভাগ l
বর্তমান ভৌগোলিকেরা এই পুরো এলাকাটিকে চার ভাগে ভাগ করেছেন l মরুভূমিকে বলা হয় পশ্চিমের বালুকাময় ময়দান বা শুষ্ক ক্ষেত্র l এর সঙ্গে লাগোয়া অঞ্চলকে বলা হয় অর্ধশুষ্ক ক্ষেত্র l যার পুরোনো নাম ছিল ‘বাগড়’ l এছাড়া রয়েছে আরাবল্লী পর্বতমালা এবং মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতির সঙ্গে লাগোয়া রাজ্যের সংশ্লিষ্ট ভাগকে বলা হয় দক্ষিণ পূর্ব পাহাড়ী অঞ্চল l এই যে চারটি ভাগ, এর মধ্যে সব থেকে বড় অংশ হল পশ্চিমের বালুকাময় ময়দান বা মরুভূমি l যার পূর্ব প্রান্ত গিয়ে ঠেকেছে উদয়পুরের কাছে, উত্তর প্রান্ত পাঞ্জাব ছুঁয়ে যায়, দক্ষিণ প্রান্ত গুজরাত এবং পশ্চিমের সমস্ত অংশটিই জুড়ে রয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে l
মরুভূমি অবশ্য পুরোটাই মরুময় নয়; কিন্তু যতটা রয়েছে সেটাও কিছু কম নয় l এর মধ্যে পড়ে জয়সলমের বাড়মের, বিকানের, নাগৌর, চুরু ও শ্রীগঙ্গানগর জেলা l এখানেই রয়েছে বালির বড় বড় টিলা, যাকে স্থানীয় কথায় বলা হয় ‘ধোরে’ l গরমের দিনে তীব্র ঝড়ে বলির টিলাগুলো যেন পাখা মেলে এদিক থেকে ওদিকে উড়ে বেড়ায়2 l তখন অনেকবারই রেল লাইন, ছোট-বড় রাস্তা বা জাতীয় সড়কও বলির তলায় চাপা পড়ে যায় l এই অংশেই বর্ষা সব থেকে কম l ভৌমজল প্রচুর নীচে; প্রায় একশো থেকে তিনশো মিটার তাও আবার বেশির ভাগই নোনতা l
যে অংশটাকে অর্ধ শুষ্ক বলা হয় তা বিশাল মরুভূমি ও আরাবল্লী পর্বতমালার মাঝে উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে লম্বালম্বি বিস্তৃত রয়েছে l এখান থেকেই বর্ষা কিছুটা বাড়তে থাকে l তবুও সে পরিমাণটা পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ সেণ্টিমিটারের মধ্যেই ঘোরা-ফেরা করে l আর এই পরিমাণটা দেশের গড় বৃষ্টিপাতের অর্ধেকই দাঁড়ায় l অর্ধশুষ্ক অঞ্চলের কোথাও কোথাও দোয়াঁশ মাটি দেখতে পাওয়া গেলেও বাকি সমস্ত জায়গায় সেই চির পরিচিত বালি l মরুভূমির প্রসার আটকানোর সমস্ত রকম রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের পরিকল্পনাগুলিকে3 বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মরুঝড় আরাবল্লীর ‘দরো’4 থেকে বালি তুলে নিয়ে গিয়ে পূর্বদিকে ফেলে l এই ছোট ছোট দরোগুলো রয়েছে ব্যাবর, অজমের ও সিকরের কাছেই l
অর্ধশুষ্ক অঞ্চলেই রয়েছে ব্যাবর, অজমের, সিকর ও ঝুঁঝনু জেলা এবং বিপরীত দিকে নানৌর, যোধপুর, পালি, জালৌর ও চুরুর কিছু অংশ l ভৌমজলের গভীরতা এখানেও একশো থেকে তিনশো মিটার এবং স্বাদেও নোনতা l
এই অঞ্চলগুলির জল তো নোনতা বটেই, কিছু অংশে আরও এক বিচিত্র পরিস্থিতি দেখা যায়- মাটিও নোনতা l এরকম নোনা জায়গায় নীচু ভাগে নোনতা জলের ঝিল দেখতে পাওয়া যায় l সাম্ভর, ডোগানা, ডিডওয়ানা, পচপদরা, লুনকরনসর, বাপ, পোকরান ও কুচামন অঞ্চলের ঝিলে তো নিয়মমাফিক নুনের চাষ হয় l ঝিলের পাশে মাইলের পর মাইল জায়গা জুড়ে জমিতে নুন উঠে এসেছে l
এরই সঙ্গে পুরো রাজ্যটাকে তেরছাভাবে কেটে রেখেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম পর্বতমালাগুলির অন্যতম আরাবল্লী l এর উচ্চতা যদিও কম, বয়সে কিন্তু এটি হিমালয়ের থেকেও পুরোনো l একেবারে এর কোলেই অবস্থান করছে সিরোহি, ডুঙ্গারপুর, আবু, আজমের এবং আলওয়ার l উত্তর-পূর্বে আরাবল্লী পর্বতমালা দিল্লিকে ছুঁয়েছে এবং দক্ষিণ পশ্চিমে গুজরাতকে l মোট দৈর্ঘ্য সাতশো কিলোমিটার, তার মধ্যে পাঁচশো পঞ্চাশ কিলোমিটার রাজস্থানকে কেটে রেখেছে l রাজ্যের এই অংশটুকুকেই বর্ষার ক্ষেত্রে সম্পন্নতম এলাকা বলে মনে করা হয় l আরাবল্লী থেকে নেমে এসে উত্তরে, উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত আরও একটা ভাগ রয়েছে l যে ভাগে পড়ে উদয়পুর, দুঙ্গারপুরের কিছু অংশ এবং বাঁসওয়াড়া, ভিলওয়াড়া, বুন্দি, টোঁক, চিতোরগড়, জয়পুর এবং ভরতপুর জেলা l মরুনায়কজি অর্থাত্ শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান ব্রজভূমির সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে ভরতপুর l দক্ষিণ-পূর্বের মালভূমি অঞ্চল এখানে এসেই শেষ হয়েছে l এরই মধ্যে রয়েছে কোটা, বুঁদি, সওয়াইমাধোপুর এবং ধৌলপুর l ধৌলপুর থেকেই শুরু হয়ে গেল মধ্যপ্রদেশের বিহড় l ভূপৃষ্ঠে বা ধরিত্রীতে যেখানে যেভাবে মাটির স্বভাব পাল্টেছে, ঠিক সে ভাবেই ওপরে আকাশের স্বভাবও বদলাতে থাকে l
আমাদের দেশে বর্ষা আসে মৌসুমি বায়ুতে চড়ে l মে-জুন মাসে সারা দেশ তপ্ত হয়ে ওঠে l এই অতিরিক্ত তাপের ফলে বাতাসের চাপ ক্রমাগত কমতে থাকে l অন্য দিকে সমুদ্রের ভারী হাওয়া নিজের শরীরে সমুদ্রের সমস্ত আর্দ্রতাকে মেখে নিয়ে যেখানে বাতাসের চাপ কম সেইদিকে উড়ে চলে l এই হাওয়াকেই বলে মৌসুমি বায়ু l
রাজস্থানের আকাশে মৌসুমি বায়ু আসে দুই দিকে থেকে l প্রথমত, আরব সাগরের দিক থেকে, দ্বিতীয়ত বাংলার বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে l কিন্তু দু-দিক থেকে আসা মেঘেও এখানকার কোথাও কোথাও ততটা বৃষ্টি ঘটাতে পারে না, যতটা তারা বর্ষিত করে থাকে তাদের আসার পথের ওপর যে কোনো স্থানে l
সুদূর বঙ্গোপসাগরে যে মৌসুমি বায়ু প্রবাহের সূচনা, তা বিশাল গাঙ্গেয় সমভূমি পার হয়ে আসতে আসতে নিজের সমস্ত আর্দ্রতাই প্রায় হারিয়ে ফেলে l রাজস্থান পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার অঞ্জলিতে আর ততটা জল থাকে না, যে সে রাজস্থানকে পর্যাপ্ত জল দিতে পারবে l আর আরব সাগর থেকে উত্থিত মৌসুমিবায়ু যখন এখানকার তপ্ত এলাকায় পৌঁছায়, তখন প্রচণ্ড গরম তার অর্ধেক আর্দ্রতাই শুষে নেয় l পুরো রাজ্যকে আড়াআড়িভাবে কেটে রেখেছে যে আরাবল্লী এতে তারও ভূমিকা রয়েছে l
আরাবল্লী প্রসারিত রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে l মৌসুমিবায়ুও একই পথে প্রবাহিত হয় l তাই মৌসুমিবায়ু আরাবল্লী পার হয়ে পশ্চিমের মরুভূমিতে প্রবেশ করার পরিবর্তে আরাবল্লীর সমান্তরালে বয়ে চলে এবং চলার পথে বর্ষিত হতে হতে চলে l তাই সিরোহি ও আবুতে প্রচুর বৃষ্টি হয় l প্রায় একশো পঞ্চাশ সেণ্টিমিটার l পরিমাণটা রাজ্যের গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় তিনগুণ l এই অংশটি আবার আরাবল্লীর উচ্চতর অঞ্চল বলে মৌসুমিবায়ু এখানে ধাক্কা খেয়ে নিজের অবশিষ্ট জলীয় বাষ্প সবই বিতরণ করে যায় এবং মরুভূমিকে আরাবল্লীর পিছনে ফেলে রেখে শেষ হয় আজকের ভূগোলের সামর্থ্যও l
কিন্তু মাটি, বর্ষা ও তাপের এই যে নতুন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, মরুভূমির ‘সমাজের’ নিজস্ব ভাষা কিন্তু তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা l মরুভূমির সমাজে মাটি, বর্ষা ও তাপের তপস্যা যেন এক মূর্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে, সাধনায় পরিণত হয়েছে l যে সাধনার এক দিকে রয়েছে জীবনের তেজময়তা এবং অন্যদিকে শীতলতা l ফাল্গুন মাসের হোলিতে আবির-গুলালের সঙ্গে সঙ্গেই মরুনায়কজি মরুভূমিতে হলুদ বালি ওড়াতে আরম্ভ করেন l চৈত্র আসতে না আসতেই ধরিত্রী তপ্ত হতে থাকে l আধুনিক ভৌগোলিকেরা এখানকার যে সূর্যের তাপে ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, এখানে সেই সূর্যের আর এক নাম ‘পিথ’ l পিথ শব্দটির একটি অর্থ হল জল, কেননা সূর্যই তো পৃথিবীতে সমস্ত জলচক্রের তথা বর্ষার প্রভু l
আষাঢ়ের প্রারম্ভে সূর্যের চারিদিকে যে এক বিশেষ প্রভামণ্ডল দেখা যায়, তাকে বলা হয় ‘জলকুণ্ডো’ l জলকুণ্ডোকে বর্ষার ইঙ্গিত বলে মনে করা হয় l এই সময়ের উদিত সূর্যে যদি ‘মাছলো’ অর্থাত্ মাছের আকারের এক বিশেষ রশ্মি দেখা যায়, তাহলে অনতিবিলম্বেই বর্ষার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হয় l সমাজকে বর্ষার ইঙ্গিত দিতে চাঁদও অবশ্য পিছিয়ে থাকে না l আষাঢ়ে চন্দ্রকলা যদি লাঙলের মতো সোজা দাঁড়িয়ে থাকে এবং শ্রাবণে তার মুদ্রা হয় বিশ্রামের, অর্থাত্ যেন শুয়ে রয়েছে এমন তাহলে ঠিকঠাক বর্ষা হবে l ‘উভো ভলে আষাঢ়, সুতো ভলো সরাবন’ l এ জাতীয় জলকুণ্ডো, মাছলো এবং চাঁদের বিভিন্ন রূপক সংক্রান্ত আলোচনায় ভর্তি রয়েছে ভডলি পুরাণ l ‘ভডলি পুরাণ’ রচনা করেন ডঙ্ক নামক এক জ্যোতিষাচার্য l ভডলি তার স্ত্রী l কোন কোন জায়গায় দুজনকে একই সঙ্গে স্মরণ করার চল রয়েছে l সে সব জায়গায় এই পুরাণকে বলা হয় ডঙ্ক-ভডলি পুরাণ l
মেঘ এখানে সব থেকে কম আসে কিন্তু তবু যদি এখানে মেঘের সব থেকে বেশি নাম পাওয়া যায়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই l শুদ্ধ ভাষা ও চলিত ভাষাতে ‘ব’ এবং ‘ওয়’ -র পার্থক্যে, পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের পার্থক্যে বাদল হয়ে যায় ওয়াদল ওয়াদলি হয়ে যায় বাদলো বা বাদলি l সংস্কৃত থেকে এসেছে বর্ষা, জলহর জীমূত, জলধর, জলবাহ, জলধরণ, জলদ, ঘটা, ক্ষর (তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়), সারঙ্গ, ব্যোম, ব্যোমচর, মেঘ, মেঘাড়াম্বর, মেঘমালা, মুদির, মাহিমণ্ডল-এর মতো নামগুলি l আর চলিত ভাষায় তো নামের অঝোর ধারা - ভরণনদ, কালাহন, কারায়ন, কন্দ, হব্র, মৈমঁট, মেহাজল, মেঘাণ, মহাঘণ, রামইয়ো এবং সেহর l মেঘের এত প্রতিশব্দ এখানে পাওয়া যায় যে তার নিজেরই কম পড়ে যাওয়ার দশা l যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে তৈরী করা এই তালিকায় যে কোনো গো-পালক ইচ্ছে করলেই আরও দু-চারটে নাম জুড়ে দিতে পারে l
ভাষা এবং তার সঙ্গে বর্ষা সম্পর্কে সমাজের গভীর অনুভব শুধুমাত্র এই কিছু নামের সঙ্গেই শেষ হয় না l মেঘের আকার-প্রকার, চাল-চলন ও স্বভাবের ওপর ভিত্তি করেও করা হয়েছে শ্রেণী বিভাজন l বড় বড় মেঘগুলোকে বলা হয় ‘সিখর’, আর ছোট ছোট তরঙ্গায়িত মেঘগুলো ‘ছিতরি’ l যে দুই-এক টুকরো মেঘ, ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত মেঘদল থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেও উপেক্ষার পাত্র নয় l তারও একটা নাম আছে- ‘চুঁখো’ l দূর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে বর্ষার যে মেঘ উড়ে আসে, তাকে বলা হয় ‘কোলায়ণ’ l ঘন কালো মেঘের আগে আগে যেন সাদা পতাকা নিয়ে চলেছে যে এক খণ্ড মেঘ সে ‘কোরণ’ অথবা ‘কাগোলড়’ l আর শ্বেত পতাকা ছাড়াই ছুটে আসে যে মেঘপুঞ্জ তার নাম ‘কাঁঠল’ বা ‘কলায়ন’ l
এত ধরনের মেঘ রয়েছে আকাশে যে মাত্র চারটি দিকে কুলোয় না l তাই দিকও আবার আট প্রকার, এমনকী ষোলো প্রকারও l সমস্ত দিকগুলিরই আবার স্তর বিন্যাস রয়েছে l আর এক - একটা দিকের ওপরে, নীচে ও মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে সে মেঘগুলো তাদেরও আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে l হালকা ও উঁচুতে ভেসে থাকা মেঘ হল ‘কস’ বা ‘কসওয়াড়’ l নৈঋত কোণ থেকে ঈশান কোণের দিকে একটু নীচে জোরে বয়ে চলে যে মেঘ তার নাম ‘ঊঁব’ l সারাদিনই ঘন হয়ে রয়েছে যে মেঘটা আর ঝিরঝিরে অল্পস্বল্প বৃষ্টিও হচ্ছে, সে হল ‘সহাড়’ l পশ্চিমে দ্রুত উড়ে বেড়ানো মেঘ ‘লোঁরা’ এবং লোঁরার অবিরাম বৃষ্টির ধারা ‘লোঁরাঝড়’ l লোঁরাঝড় বর্ষার এক প্রকার গান-ও বটে l বর্ষা শেষ করে অর্থাত্ নিজের কর্তব্য সমাপন করে কোনো পাহাড়ের ওপর একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছে যে মেঘটা ? সে তো ‘রিঞ্ছি’ l
মেঘেরা কাজ শুরু করে, কাজ শেষ করে; শুধু তাই নয়, কাজের শেষে তাদের বিশ্রাম নেওয়া- পুরো পর্যায়টি গভীর অনুভবের দ্বারা অনুভব করতে পারে , বুঝতে পারে যে সমাজ, মেঘেদের এত ভালবাসে যে সমাজ, তারা তার প্রতিটি বিন্দুকে কতই না মঙ্গলময় মনে করে, তাই না?
এখন তো সূর্যই বর্ষণ করে চলেছে l জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী l এই দিন থেকে শুরু হয় ‘নৌতপা’ l এই তিথি কখনও বদলায় না l ক্যালেন্ডারের হিসেবে অবশ্য এই তিথি হয় মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার কখনওবা তৃতীয় সপ্তাহে l ‘নৌতপা’ অথবা ‘নওতপা’ অর্থাত্ ধরিত্রীর সব থেকে বেশি তপ্ত হওয়ার দিন l সূর্যের তাপে পৃথিবী যদি সম্পূর্ণ শুষ্ক না হয় তাহলে তো ভালো বর্ষা হবে না l এই তাপের তপস্যাতেই তো আসবে বৃষ্টির শীতলতা l
ওম - গোম,5 আকাশ এবং ধরিত্রীর, ব্রহ্ম এবং সৃষ্টির সম্বন্ধ, শাশ্বত l প্রখর রৌদ্রের আরও এক নাম ‘ঘাম’ l এই ঘাম শব্দ রাজস্থান ছাড়াও বিহার উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কিছু জায়গাতে প্রচলিত পাওয়া যায় l কিন্তু ‘ঔঘমো’ শব্দটি শুধুমাত্র রাজস্থানেই শোনা যায়, যার অর্থ- বর্ষার ঠিক আগেকার উত্তপ্ত সূর্য l এ সময় মরুভূমিতে ‘বলতি’ অর্থাত্ লু এবং বালির ঝড় বইতে থাকে l খবরের কাগজে শিরোনাম হয়- ‘মরুভূমির জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে’ l রেল লাইন, পাকা রাস্তা সবই বালির তলায় চলে যায় l তবুও এখানকার মানুষ এখনো পর্যন্ত এই ভয়ংকর ঝড়কে প্রকৃতির লীলারই এক অংশ বলে মনে করে l
তাই মরুভূমিতে জ্যৈষ্ঠকে কেউ গালমন্দ করে না l পুরো শরীর ঢেকে রাখা হয়, শুধু মুখটুকু খোলা থাকে l জোরে বয়ে চলা দক্ষিণী হাওয়া বালি তুলে তুলে মুখে ছুঁড়ে মারতে থাকে l তবুও যারা পশু চরায় অথবা গোয়ালারা, তারা জ্যৈষ্ঠকে গান গেয়ে স্বাগত জানায় এবং জ্যৈষ্ঠকে পাঠানোর জন্য শুদ্ধ কবির-ই শৈলীতে প্রভুকে ধন্যবাদ দেয় l ‘জেঠ মহিনো ভঁলা আয়ো দক্ষণ বাজে বা (হাওয়া), কানোঁ রে তো কাঁকড় বাজে ওয়ারে সাঁই ওয়াহ’ l
এ রকম গল্পও পাওয়া যায়- বারো মাস এক সঙ্গে বসে কথা বলছে, প্রতিটি মাসই নিজেকে প্রকৃতির যোগ্য পুত্র বলে পরিচয় দিচ্ছ l প্রতিযোগিতায় কিন্তু বাজি জেতে জ্যৈষ্ঠই l সে- ই ‘জ্যৈষ্ঠ’ অর্থাত্ সব থেকে বড় ভাই বলে স্বীকৃতি পায় l জ্যৈষ্ঠ যদি তাপ না দেয়, বালির ঝড় যদি না ওঠে তাহলে তো ‘জমানো’ ভালো হবে না l জমানো, অর্থাত্ বর্ষাকাল l বর্ষাকাল- চাষবাস ও ঘাসচারার জন্য ঠিক সময় l এই সময়ই পিথ অর্থাত্ সূর্য নিজের অর্থ পাল্টে জলের রূপ ধারণ করে l
আওগাল6 থেকে শুরু বর্ষা আগমনের সংকেত l পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা বেরোবে চাদর ছড়িয়ে ‘ডেডরিয়ো’ খেলতে, আর বড়রা বেরোবে ‘চাদরগুলো’ পরিষ্কার করতে l যে যে জায়গা থেকে বর্ষার জল সংগ্রহ করা হবে, সেখানের আঙিনা ছাত ও কুণ্ডিগুলোর ‘আগৌর’7 পরিষ্কার করা হবে l জ্যৈষ্ঠ শেষ হতে চলেছে, আষাঢ় এসে পড়ল, তবু এখনও বর্ষার দেরি আছে l আষাঢ়ের শুক্লা একাদশী থেকে শুরু হবে ‘বরসালি’ বা ‘চৌমাসা’8 l এখানে বর্ষা কম, কম দিনই বৃষ্টি পড়ে, কিন্তু সমাজ বর্ষার অভ্যর্থনায় অপেক্ষা করে থাকে পুরো চারটি মাস l
যে সমাজের হৃদয় এই অল্প একটু মেঘকেই এত নামে স্মরণ করে থাকে, তারা তার রূপোর মতো জলবিন্দুগুলিকে কতই না রূপে দেখেছে, কত নামেই না ডেকেছে l এখানেও তাই নামের ধারা পাওয়া যাবে l
বৃষ্টিবিন্দুর প্রথম প্রতিশব্দই হল ‘হরি’, দ্বিতীয় নাম ‘মেঘপুহুপ’ l বৃষ্টি শব্দিটি থেকে চলিত ভাষায় এসেছে ‘বিরখা’ ও ‘ব্রখা’ l ধনসম্পদের তথা মেঘের সার হল ‘ধানসার’ এবং আরও এক নাম ‘মেওলিয়ো’ l বৃষ্টি বিন্দুরই এত নাম, যে নামের মালা গাঁথা যেতে পারে l ‘বুলা’ ও ‘সিকর’ শব্দের অর্থ হল জলকণা l ‘ফুহার’ ও ‘ছিঁটা’ শব্দ সব জায়গাতেই পাওয়া যায় এবং তার থেকেই এসেছে ‘ছাঁটো’, ‘ছাঁটা’-‘ছড়কো’, ‘ছছোহো’ প্রভৃতি l আবার আকাশ থেকে টপকানো অর্থাত্ ঝরে পড়ার জন্য ‘টপকা’, ‘টপকো’ এবং ‘টিপো’ জাতীয় শব্দগুলির উদ্ভব l দুই-এক ফোঁটা বৃষ্টি হল, ‘ঝরমর’ l একই অর্থেই আবার পাওয়া যায় ‘পুণঙ্গ’ ও ‘জিখা’ জাতীয় শব্দ l দুই - এক ফোঁটার থেকে একটু বেশি অর্থাত্ ঝিরঝিরে বর্ষা হল ‘রিঠ’ ও ‘ভোট’ l আর এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি ক্রমাগত চলতে থাকলে তা হল ‘ঝড়মন্ডল’ l
বর্ষার চার মাস এবং প্রতিটি আলাদা আলাদা মাসে যে বৃষ্টি হয় তারও আলাদা আলাদা নাম রয়েছে l ঝিরঝিরে বৃষ্টি হল ‘হলুর’, তবে তা শ্রাবণ ভাদ্রের বৃষ্টি l ঠান্ডায় যে ছিটে-ফোঁটা বৃষ্টি হয় তা হল ‘রোহাড়’ l বর্ষাওলি থেকে শুদ্ধ ভাষায় এসেছে বরখাওয়ল শব্দ, অর্থ অবশ্য সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি l ‘মেহাণ্ঝড়’- অর্থাত্ বৃষ্টির গতি বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে সময়ও l ‘ঝাপটো’ বৃষ্টিতে কেবল গতিই বাড়ে কিন্তু সময় কমে যায়, অর্থাত্ এক ঝটকায় যেন সমস্ত জল ঝরে যায় l
মুসলধারা বৃষ্টির জন্য যে শব্দ ব্যবহৃত হয় তা হল ‘ত্রাট’ ‘ত্রমঝড়’, ‘ত্রাটকনো’ এবং ‘ধরহরনো’ l ‘ছোল’ শব্দে এই ধরণের বৃষ্টিই বোঝায় তবে তার পরিধির মধ্যে আনন্দের অর্থও ঢুকে পড়ে l এই ছোল, এই আনন্দ অবশ্যই শহরে জল সরবরাহ নলের শোঁ-শোঁ শব্দের নয় l এইরকম তীব্র বর্ষার সঙ্গে বয়ে আসে যে শব্দ তাকে বলে ‘সোক’ বা ‘সোকড়’ l বর্ষণ কখনো কখনো তীব্র, সশব্দে এবং এত দ্রুত হয়ে যায় যে মেঘ ও মাটির দীর্ঘ দূরত্ব ক্ষণিকের মধ্যে মাপা হয়ে যেতে পারে l তথন মেঘ থেকে মাটি স্পর্শ করে যে জলধারা তাকে বলা হয় ‘ধারোলি’ l
বর্ষা এবং তার প্রতিশব্দের বৈচিত্র্য এখানেই কিন্তু শেষ হয় না l ‘ধারোলি’ বৃষ্টির ছাঁট যখন বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে এসে পড়ে তখন তাকে বলা হয় ‘বাছাড়’ l আর বাছাড়ের আর্দ্রতায় নেতিয়ে নরম ও স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাওয়া ভিজে কাপড়ের বিশেষণ হল - ‘বাছাড়বায়ো’ l ধারোলির সঙ্গে যে শব্দ শোনা যায় তাকে বলা হয় ‘ধমক’ l এই শব্দটি পুংলিঙ্গ এবং ওজনেও যথেষ্ট ভারী l ধমককে সঙ্গে নিয়ে প্রচণ্ড বেগে যে হাওয়া প্রবাহিত হয়, তার নাম ‘ওয়াবল’ l
ধীরে ধীরে ওয়াবল -এর গতি কম আসে, ধমক শান্ত হয়ে যায়, কিছুক্ষণ আগেই যে ধারোলি মাটি স্পর্শ করেছিল তাও আবার মেঘের ভিতর মিলিয়ে যায় l বৃষ্টি থেমে যায় l তার পরও কিন্তু কিছু মেঘ আকাশে থাকে যায় l অস্তগামী সূর্য সেখান থেকে উঁকি দেয় l অস্ত সূর্যের সে কিরণকে বলে ‘মোঘ’ এবং এও বর্ষার এক ইঙ্গিত l মোঘ দেখা গেলে রাত্রে আবার বৃষ্টি হবে l যে রাত্র খুব বৃষ্টি হয় তা সাধারণ রৈন নয় তা হল ‘মহারৈন’ l
বৃষ্টি হওয়া সংক্রান্ত ক্রিয়ার নামে ‘তুঠনো’ এবং তা কমে আসা ‘ওবরেলো’ l ততদিনে চৌমাসা পেরিয়ে যায় l বর্ষা আরম্ভ হওয়া থেকে কমে আসা পর্যন্ত প্রতিটি গ্রাম প্রতিটি শহর ঘরের ছাতে, উঠোনে, খেতে, চৌরাস্তায় এমনকী নির্জন প্রান্তরেও জল কণাগুলিকে সংগ্রহ করে রাখার জন্য যেন চাদর বিছিয়ে রাখে l
‘পালর’ অর্থাত্ বর্ষার জল সংগ্রহ করে রাখার জন্যও এখানে বৃষ্টির প্রতিশব্দের মতোই যেন অসংখ্য নিয়ম রয়েছে l বিন্দু - বিন্দু জল জমে কলস ও সমুদ্র- দুইই ভরে ওঠে- এই ধরণের প্রবাদ প্রবচন কোনো পাঠ্য বইতে নয়, আমাদের সমাজের যৌথ স্মৃতির গভীরেই পাওয়া সম্ভব l এই স্মৃতি থেকেই তৈরি হয় শ্রুতি l এই শ্রুতি সমাজ স্মরণে রেখেছে, পরবর্তী প্রজন্মকে শুনিয়েছে এবং জল সংগ্রহের এই বিশাল ঐতিহ্যসম্পন্ন কাজকে কখন যেন একটু একটু করে ক্রমশ ব্যবহারিক ও যথেষ্ট প্রণালীবদ্ধ করে এমন এক পরিকাঠামো তৈরি করেছে যে সমস্ত সমাজ সেখানে এক প্রাণ হয়ে উঠেছে l এই পরিকাঠামোর আকার এত বড় যে তা রাজ্যের প্রায় তিরিশ হাজার গ্রাম এবং তিনশো শহর ও মফস্বলের সকল মানুষের ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক নিরাকার রূপ নিয়েছে l
এই নিরাকার সংগঠনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখানকার জনসমাজ, না রাজ্য না সরকারের হাতে দিয়েছে, না আধুনিক পরিভাষা অনুসারে যাকে ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনস্থ বলে চিহ্নিত করা হয়- সেইরকম কারো হাতে l পুরোনো পরিভাষায় যাকে বলে ‘নিজের হাতে রাখা’, সমাজ এ ব্যবস্থাকে সেরকম ভাবেই রেখেছে l প্রতিটি ঘর প্রতিটি গ্রাম থেকে মানুষ এই পরিকাঠামোকে বাস্তব রূপ দিয়েছে, বাঁচিয়ে রেখেছে এবং উন্নত রূপ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে l
‘পিঁডওড়ি’ শব্দের অর্থ নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম এবং সেই পরিশ্রম দিয়ে অন্যকে সহায়তা করা l বর্ষার প্রতিটি জলবিন্দু সংগ্রহ করে রাখার জন্য সকলে মিলে পরিশ্রম করেছে, ঝরে পড়েছে কর্মক্লান্ত ঘাম বিন্দু l
Path Alias
/articles/maatai-jala-o-taapaera-tapasayaa
Post By: Hindi