জলসঙ্কট


ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার ফলে জলের যে সঞ্চয় কমছে, সেটা কিন্তু সমপরিমাণে পূরণ হচ্ছে না, কেননা মাটির উপরের জল নানাভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে যেসব জলাশয়, হ্রদ বা প্রস্রবণ ভূগর্ভস্থ জল পায়, সেগুলো ক্রমশঃ শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী 15 বছরে, ভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা এবং প্রয়োজনের তফাত হবে 50 শতাংশ অর্থাত প্রয়োজনের অর্ধেকই মাত্র ভূগর্ভস্থ জল পাওয়া যাবে মাটির তলা থেকে ।

আবহমান কাল ধরেই আমরা জলকে জীবন বলে আসছি, কারণ জল ছাড়া কোন প্রাণীই বাঁচতে পারে না। জল যখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, তখন আমরা জলকে কোনোভাবেই হেলাফেলা বা অবহেলা করতে পারি না বা করা উচিত নয়। আমাদের এই ভারত মোটামুটিভাবে গড়পড়তা উপযুক্ত জল সম্পদে সমৃদ্ধ, যদিও শুষ্ক অঞ্চলও কিছু কিছু আছে, যেমন - রাজস্থানের মরু অঞ্চল, কিংবা গুজরাটের কচ্ছ এলাকা, এসব স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। বৃষ্টি কম হয় বলে যুগ যুগ ধরে মৃত্তিকায় চিড় ধরে ফুটিফাটা হয়ে যায়, কিংবা মরু অঞ্চলে বালিতে পরিপূর্ণ থাকে।

আমাদের এই দুই বাংলা (পূর্ব ও পশ্চিম) নদী মাতৃক হওয়াতে আমরা জলাভাব তেমনভাবে অনুভব করি না, কেন না, নদী, নালা,খাল, বিল, পুষ্করিণীর সংখ্যা সর্বত্রই বিপুল পরিমাণে রয়েছে। প্রবাদ বচনে যেমন বলা হয় - দাঁত থাকতে লোকে দাঁতের মর্ম বোঝে না, তেমনি আমরাও, জল আছে বলে প্রচুর জল অপচয় করতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের এই বাংলাতেই এমন কিছু কিছু স্থান আছে, যেখানে জল পর্যাপ্ত নেই। অনেক কষ্ট করে আনেক দূর থেকে জল সংগ্রহ করতে হয়। পশ্চিম বাঁকুড়া, পুরুলিয়া কিংবা বীরভূমের বেশ কিছু স্থানে সারা বছর জল থাকে এমন পুকুর, খালবিল ত নেই-ই, তার ওপর দারুণ গ্রীষ্মের দাবদাহে কুয়োর জলও শুকিয়ে যায়। তখন বহু গ্রামের মানুষ দূর দুরান্তে গিয়ে জল সংগ্রহ করে আনে। মেয়েরা দল বেঁধে কয়েক ক্রোশ উত্তপ্ত মৃত্তিকা দিয়ে হেঁটে এবং মস্তকের উপর বেশ কয়েকটি কলসি ধারণ করে চলে যায় এমন স্থানে যেখানে মাটি খুঁড়ে বেশ কয়েক হাত নীচে জল পাওয়া যায়। এভাবে বছরের পর বছর তারা জলকষ্ট ভোগ করে চলেছে। তাদের কথা ভাবার লোক নোই, কেউ ভাবে না। বড়ো বড়ো শহরে মানুষের প্রতিদিন নানা সুযোগ বাড়ে, কিন্তু এই সমস্ত গ্রামগুলি যে তিমিরের, সেই তিমিরেই পড়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, আমাদের এই পৃথিবীতে মোট জল সম্পদের 97 শতাংশ লবণাক্ত ও অপেয়, আর 2 শতাংশ হচ্ছে তুষার হয়ে জমাট বাধা অবস্থায় আছে। মাত্র 1 শতাংশ জল সম্পদ আমরা সারা পৃথিবীর অধিবাসী নানাভাবে ব্যবহার করি। বৃষ্টিপাত এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্যান্য উত্স (যেমন – নদী, নালা, খাল, বিল ইত্যাদি) থেকে আমরা যে জল পাই তার প্রায় 70 শতাংশ জলই ভারতে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। এরপর আছে কল, কারখানায় ব্যবহৃত জল কতকগুলি শিল্পে অনেক বেশি জলের প্রয়োজন হয়, যেমন বিদ্যুত উত্পাদনের জন্য কিংবা কাগজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি এসব স্থানে জলের অপচয় হয় অনেক বেশি। অতএব মানুষের গৃহস্থালীর প্রয়োজনে যে পরিশ্রুত জল এসে পৌঁছয়, তার পরিমাণ অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। আমেরিকার প্রতিটি নাগরিক প্রতিদিন মাথা পিছু প্রায় 560 লিটার পরিশ্রুত জল ব্যবহার করার সুযোগ পায়। সেখানে ভারতে এর পরিনাণ প্রতিটি নাগরিক মাথা পিছু পায় প্রায় 50 লিটার মাত্র। সারা পৃথিবীতে 100 কোটি মানুষের কাছে পরিশ্রুত বিশুদ্ধ জল পৌঁছয় না, ফলে বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতো প্রতিদিন প্রায় 3900 দূষিত জল বাহিত রোগে ভুগে মারা যায়।

ভূগর্ভের থেকে আমরা যে জল পাই, সেই সঞ্চয় ক্রমশ কমে আসছে অতি দ্রুত, কেননা নগরায়ণ ও শিল্পায়নের স্বার্থে বড়ো বড়ো পাম্প বসিয়ে ক্রমশ বেশি বেশি পরিমাণ জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে কৃষিকাজেও ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণে জল টেনে নিয়ে খাদ্যের উত্পাদন বাড়ান হচ্ছে, কারণ ক্রমবর্ধমান মানুষের জন্য বেশি বেশি শস্যের প্রয়োজন।

প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার ফলে জলের যে সঞ্চয় কমছে, সেটা কিন্তু সমপরিমাণে পূরণ হচ্ছে না, কেননা মাটির উপরের জল নানাভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে। যেসব জলাশয়, হ্রদ বা প্রস্রবণ ভূগর্ভস্থ জল পায়, সেগুলো ক্রমশঃ শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী 15 বছরে, ভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা এবং প্রয়োজনের তফাত হবে 50 শতাংশ অর্থাত প্রয়োজনের অর্ধেকই মাত্র ভূগর্ভস্থ জল পাওয়া যাবে মাটির তলা থেকে।

আরেকটি বিপদ হচ্ছে, জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিবর্তন। সরকারি সংস্থা ।. P. C. C. (Inter-governmental Panel on Climate Change) বলেছে যে আগামী 2100 সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহগুলি 45 % গলে যাবে, যদি পৃথিবীপৃষ্ঠের উত্তাপ ঐ সময়ের মধ্যে 1 / 8 সেলসিয়াস বেড়ে যায়। এর ভয়াবহ পরিমাণ দু প্রকার হতে পারে। 1) প্রথমদিকে বিপুল পরিমাণ বরফগলা জলে হড়কা বান এসে ধ্বংসলীলা চালাবে। 2) পরবর্তী পর্যায়ে জল না পেয়ে হিমালয়ে উদ্ভূত নদীগুলি সব শুকিয়ে যাবে। অর্থাত, অবহমান কালের গঙ্গা নদী যদি শুকিয়ে যায়, তবে উত্তর ভারতের পরিণামের কথা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়।

অতএব আগামী দিনে এই সমস্ত জল সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্য যে সব পন্থা চিন্তা করা হয়েছে, তা এইরকম :

কৃষিতে যেখানে যেখানে জলের অত্যধিক প্রয়োজন নেই, যেমন ইক্ষু চাষ কিংবা কলা চাষ, সেই সব স্থানে জলের নিয়ন্ত্রণ চালু করা প্রয়োজন। তাছাড়া, Israel ইত্যাদি শুষ্ক দেশে বেশ কিছুদিন থেকেই Micro-Irrigation কিংবা Drip Irrigation প্রবর্তিত হয়েছে, অর্থাত চারা গাছের গোড়ায় ফোঁটা ফোঁটা জল সিঞ্চন। এতে জলের পরিমাণ অনেক কম লাগে, জল অপচয় বন্ধ হয়। ফলে গম ইত্যাদির ফলন অনেক বাড়ান যায়। সারা বছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা ধরণের দানাশস্য চাষ করা যায়।

যেসব শিল্পে জলের অত্যধিক প্রয়োজন ( বিদ্যুত উত্পাদন কিংবা কাগজ শিল্পে ) সেখানে জলের অপচয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও ব্যবহৃত জলকে পরিশোধন করে পুনরায় কাজে লাগাতে হবে। এতে জলের পরিমাণ অনেকটাই বাঁচান সম্ভব হবে।

ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ক্ষেত্রে গৃহস্থালীতে জল অপচয় নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায় হচ্ছে প্রতিটি পরিবারের জন্য জল মাপবার মিটার বসান। সবাইকেই বুঝতে হবে যে বিশাল জল সঙ্কট এগিয়ে আসছে, পূর্বের মতো দরাজভাবে জল ব্যবহার করার দিন এখন শেষ হয়েছে। এতএব নূন্যতম উপায়ে জল খরচ করতে হবে। এখানে নগরীর যাবতীয় গৃহস্থালীর ব্যবহৃত জলকে একত্র করে পরিশোধন করা যেতে পারে এবং পুনরায় সেই জল কৃষিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

শেষমেষ যে কাজটি যৌথভাবে সামাজিক উপায়ে করতে হবে, সেটি হচ্ছে জল সঞ্চয়। আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার পদ্ধতি চালু আছে। সেটিই সুপরিকল্পিতভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সবাইকে করতে হবে। বড়ো বড়ো পুকুর কেটে কিংবা বাঁধ তৈরি করে বৃষ্টির জল ধরে রাখতে হবে। সারা বছরের জন্য। যত্ন করে নজরদারি বজায় রাখলে বিশুদ্ধতা রক্ষা করা যায় এবং প্রয়োজনে গ্রামবাসীরা সেই জল পান করতে পারেন, কারণ ভূগর্ভস্থ জল সর্বত্র নিরাপদ নয়। কোনো কোনো স্থানে জলের সঙ্গে ক্ষতিকারক আর্সেনিক থাকে এবং তাতে চর্ম রোগ বা আরও বিভিন্ন প্রকার রোগ দেখা দেয়।

মোদ্দা কথা, আগামী দিনে জল সঙ্কটের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধভাবে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। জল সংরক্ষণই যে আমাদের হাতিয়ার সেটা বুঝতে হবে, আর সেটা বুঝতে পারলেই আমরা সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।

Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.

Path Alias

/articles/jalasanakata

Post By: Hindi
×