বৃষ্টিই যে ধরণীর সকল মিঠে জলের উৎস আর সেই বৃষ্টিজল ধরে রাখবার বেসুমার কৌশল জানা ছিল বলেই এদেশের সভ্যতা হাজার হাজার বছর এমন সজল সুফল- এসব কথা এখন সবাই জানে। জানে বটে কিন্তু সর্বদা মনে রাখতে পারে না। ফলে জলস্থলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কখনো রাজায় প্রজায়, কখনো রাজায় রাজায় আর কখনো বা এমনকি প্রজায় প্রজায়ও বেশ মতবিরোধ দেখা যায়। সমুদ্রের ভাগ, নদীর ভাগ বড়ো ব্যাপার, জলাশয়ের ভাগ নিয়েও মতবিরোধ হয়।
জলাশয়ের তীব্র প্রয়োজন প্রতিটি সুখার সময়ে, প্রত্যেকটি মৃত নদীর দেশে, প্রত্যেক নির্জল পাম্পের অসহায়তার ক্রমশ স্পষ্ট ভাবে দেখা দিচ্ছে। তবু কখনো কখনো অন্য কোন আপাত প্রয়োজনকে জলের চেয়ে বড়ো প্রয়োজন বলে মনে করা হয়। আর তখনই বিরোধ বাধে- যাঁরা জলাশয়ের কিনারে বাস করা মানুষ, তাঁদের সঙ্গে যাঁরা দূরে বসে অন্য কোন প্রয়োজনীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দেন, তাঁদের মধ্যে। এর উদাহরণ, কাছে দূরে, অনেক।
মনিপুরের ২৮৭ বর্গ কিমি লোকতাক হ্রদ কেবল ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মিষ্টিজলের হ্রদই নয়, পূর্ব হিমালয়ের আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক জলা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমগ্র প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়ামক। মানিপুর নদী ছাড়াও চারদিক ঘেরা পাহাড় থেকে প্রায় ত্রিশটি ছোটবড় ধারা নেমে এসে লোকতাককে জল যোগাত। মনিপুরের আর্থিক, পরিবেশগত, সর্বোপরি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, এ হ্রদের গুরুত্ব কতোখানি, তা দূরবর্তী জনেদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বহু স্থানীয় পরিবার এই বিশাল জলরাশিকে সযত্ন দক্ষতায় ব্যবহার করে নিজেদের জীবিকা অর্জন করতেন। শুধু তাই নয়, গাঙ্গেয় অঞ্চলে গঙ্গার মতই উত্তরপূর্ব ভারতের মানসে ও সংস্কৃতিতে- চিত্রে, কাব্যে, গাথায়, এমনকি ফিল্মেও, লোকতাকের এক ঐতিহ্যময় জায়গা ছিল।
তৎকালীন সরকারের মনে হয় ওখানে অমন বিশাল এক জলক্ষেত্র ‘শুধু শুধু পড়ে আছে’, ওটাকে ‘কাজে লাগানো’র ব্যবস্থা করার কথা। হ্রদের মাঝবরাবর মাটি ফেলে তৈরি হল পাকা রাস্তা। ১৯৯৯ সালে তাকমু ওয়াটার স্পোর্টস একাডেমি-র উদ্বোধন করে এশিয় জলক্রীড়া প্রতিযোগিতার সমারোহ অনুষ্ঠিত হল। এরপর চলতেই রইল দূর থেকে আসা লোকেদের বিনোদন ব্যবস্থা। কিন্তু যে উঙামেল চ্যানেল শীত ও গ্রীষ্মে ওই বিশাল কিন্তু অগভীর জলের প্রাণচক্র বজায় রাখত, ওয়াটার স্পোর্টসের প্রয়োজনে অতিরিক্ত জল জমিয়ে ্রাখার দরুন তা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেল। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী কমে গেল খুব। ওই পাহাড় এলাকার এক বড় সংখ্যক লোকের জীবিকা ছিল এই মাছ-আমাছা, জলজ শাক, অন্য জলজ উদ্ভিদ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা। সেই লোকেরা বেকার হয় গেলেন। তারপর এল এই হ্রদে জল বয়ে আনা ইম্ফল ও অন্য নদীগুলোর ওপর , শেষে লোকতাকের মুখে, বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুত তৈরির কালো গল্প। জীবিকা হারানো, বাসস্থান হারানো নিরুপায় মানুষরা বাধ্য হলেন আশপাশের পাহাড়ের গাছ কেটে কাছের হাটে বিক্রি করতে। হ্রদে ভাসমান আশ্চর্য উদ্ভিদ্গুচ্ছ ‘ফুংদি’র ওপর অনেকে বাস করতে। সারাদিন ক্ষুদ্রতম মাছের আশায় জল প্রায় ছাকনি দিয়ে ঘেঁটে ফেলতে।
আজকে লোকতাক এক দুর্গন্ধময় নষ্ট জলাশয়ের নাম।তার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে।
পৃথিবীর বৃহত্তম মিষ্টিজলের হ্রদ ছিল রাশিয়ার উরাল, যাকে বলা হত উরাল সাগর। রুশবিপ্লবের পর দেশের পরিচালকবৃন্দ চাইলেন দেশের খাদ্যসমস্যার সমাধান করতে। এর চেয়ে ভালো ভাবনা সদ্য শোষণমুক্ত জনতার পক্ষে আর কিছুই হতে পারে না। এবং তাঁরা ভাবলেন, দেশের উচ্চকোটির মানুষরা যা খান, একমাত্র সেই গমই সকলের খাদ্য হওয়ার উপযুক্ত। সুতরাং শুরু হল অন্যান্য স্থানীয় ফসল বাদ দিয়ে গমের চাষ বাড়ানো। দেশ দেশে প্রচারিত হল প্রকৃতির ওপর মানুষের বিজয়লাভের সেই কাহিনী- সাইবেরিয়ায় গম ফলানো হচ্ছে বিপুল সেচ দিয়ে।টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস সহ যে সব নদী ওই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উরাল হ্রদে এসে মিশত, প্রচন্ড পরিশ্রমে খাল কেটে তাদের থেকে জল চালিয়ে দেওয়া হল গম ক্ষেতে।কিন্তু কতোদিন? ১৯৩৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভেঙে পড়ল সেই সেচব্যবস্থা। উরালে জল এনে ঢালত যে নদীকুল, তারা হৃতধারা হয়েছিল সেচ দেবার চাপে। ১৯৮৭সালে ঘোষণা করতে হল যে অনুদ্ধারণীয় ভাবে শুকিয়ে গিয়েছে উরাল হ্রদ। নদীদের স্বাভাবিক ধারা শুকোতে শুকোতে ক্রমশ টাইগ্রিসের মৃত্যু হয়েছে। ইউফ্রেতিসের ন্যূনতম ধারা বাঁচিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রুশবিপ্লবের আগে থেকে, জারশাসনের আগে থেকে, কে জানে কতোকাল- হয়ত যতোদিন থেকে ঐ বিশাল জলক্ষেত্রের পাশে জনবসতি গড়ে উঠেছিল ততোদিন ধরেই, এই হ্রদের আশপাশে কয়েক লক্ষ মানুষ মাছধরা ও চাষ দিয়ে দিন গুজরান করতেন। হ্রদের সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষরাও চলে গেলেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’এর খাতায়। আর আজ, ওই বিপুল পরিমাণ মিঠেজলের ভান্ডারটি শুকিয়ে যাবার পরিবেশগত ফলাফল জানতে পারছে ওই ভূখন্ডের প্রাণজগত।
অতোদূরের অতো বড় হ্রদের কথা বাদ দিলেও, আমাদের কাছাকাছি মধ্যপ্রদেশের ভূপাল হ্রদ আধ-শুকনো রাস্তা আর নগরায়ণের চাপে। শহরের বাসস্ট্যান্ড, পোস্টাফিস, আরও নানা কাজে সে হ্রদের এক-চতুর্থাংশেরও কম বেঁচে আছে শুষ্ককন্ঠ ভূপাল।
ঘরের কাছে সাঁতরাগাছির বিশাল বিল। রেলস্টেশান করার বিকল্প কোন ফাঁকা জায়গাও ছিল না, মেনে নেওয়া গেল। স্টেশানের অনুষঙ্গী বাসস্ট্যান্ড, চওড়া রাস্তা, দোকান পসার- প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটাই, কোন সন্দেহ নেই। এবং এসব জায়গায় কিন্তু ভরাট হয়নি জলা, কেবল তার অস্তিত্বের পক্ষে অসুবিধাজনক ভাবে পালটে গিয়েছে তার আশপাশ। কিংবা অন্য কাজে লাগান হয়েছে তার জল। এবং এ সবই হয়েছে দশজনের ভালো হবে, শাসকপক্ষের এই ভাবনা থেকে। কিন্তু, একদিকে অবহেলিত হয়েছে একটি বহুকাল ধরে তৈরি হয়ে ওঠা জলক্ষেত্রের গুরুত্বের ভাবনা। প্রায় মনে রাখা হয়নি এ কথা যে নদীর মতই, বৃহৎ জলক্ষেত্রগুলির গড়ে ওঠা ও স্থায়ী হবার পিছনে প্রকৃতির কিছু অমোঘ নিয়ম আছে। জলের পথ ও জলের গতি সম্পর্কিত সে নিয়ম মানুষের পছন্দমত বদলানো যায় না। বদল ঘটালে তার ফল মঙ্গলজনক হয় না। অন্যদিকে এসকল ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, যদি তা কেবলমাত্র বেশি ক্ষতিপূরণ বিষয়ক না হয়। কারণ, সেই মানুষরা স্থানীয় প্রাকৃতিক শৃংখলা মেনে নিজেদের জীবিকা অর্জনের নিয়মে অভ্যস্ত হয়েছেন, তা নষ্ট না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। একই কথা মনে হয় ভাবাদীঘিসহ অন্যান্য জলক্ষেত্র সম্পর্কেই। জল যে জীবন সে কথা এখন প্রমাণের দরকার করে না। প্রতিটি জলাশয় প্রকৃতির আশীর্বাদ। তাকে সযত্নে রাখতে হবে।
যেকোন বৃহৎ জলাশয় সম্পর্কে একথা সব জায়গায় সত্য।
বিশেষত, যে রাজ্যে বৃষ্টির জল সংরক্ষনের ওপর সরকারি তরফ থেকে অনেকখানি জোর দেওয়া হয়, সেখানে সঞ্চিত জল সর্বদাই অগ্রাধিকার পাবে, এরকমই আশা থাকে।
বিতৃষ্ণাজনক খারাপ লাগে তখন, যখন দেখা যায় এরকম ক্ষেত্রে সাময়িক কোন মতান্তর ঘটলে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে প্রশাসনের সরাসরি আলচনার মাধ্যমে পরস্পরের বোঝাপড়া স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টার বদলে নানা রাজনৈতিক দল নিজেদের ‘ভোটে’র সংকীর্ণ স্বার্থ মাথায় রেখে গোলমাল জীইয়ে রাখার, বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যান।
মানুষের জীবন অথবা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা,কোন বিষয়েই তাঁদের বিন্দুমাত্র কোন দায়িত্ববোধ থাকে না।
রাজনীতি বললে যে কখনো একটি বিশ্বদৃষ্টি বোঝাত, সে কথা মনে রাখবার কোন উপায় নেই আর।
ঘরের কাছে সাঁতরাগাছির বিল। রেলস্টেশান বসাবার জায়গা নিতান্তই দরকার ছিল
Path Alias
/articles/jalaera-unanayana-caesataa
Post By: Hindi