জলের কথা


এক লরি পাইপ ঢুকে যাবার পর আর এক লরি পাইপ এলো। পরে আরও এক লরি। ওমা, এতো লরির পর লরি পাইপ ঢুকে যাচ্ছে। কাজ শেষ হবে কবে? কদিন বাদে আবার সেই জিপটা ধূলো উড়িয়ে গ্রামে ঢুকলো। কয়েকজন ভদ্র সভ্য মানুষ নেমেই মিস্ত্রিগুলোর সঙ্গে বচসা শুরু করেছিল। ওরা নাকি সব ঠিকাদারের লোক। তাই মিস্ত্রিদের সঙ্গে গোলমালে আমরা আর নাক গালালাম না। শুধু ওদের তর্ক দেখে বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়তে লাগলাম।দক্ষিণবঙ্গে সাগরের কাছাকাছি আমাদের খুব ছোটো অখ্যাত একটা গ্রাম। সে গ্রামে পানীয় জলের কোন ব্যবস্থাই নেই। আমর মায়ের শ্রাদ্ধের দিন আমর মামাতো ভাই পিতু কলকাতা থেকে এসে গ্রামের পানীয় জলের ব্যবস্থা না থাকায় চোখ কপালে তুলে বলল – ‘বলিস কি বাবলু ? সব গ্রামে পানীয় জল পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচনী ইস্তাহারে ফলাও করে বলা থাকে, অথচ স্বাধীনতার ষাট বছর পরেও! তা আমাদের এই পান্ডব বর্জিত গ্রামে আছেটা কি ? একটি প্রাইমারি ইশকুল ছাড়া ? নেই ভাল একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নেই কর্ম সংস্থানের কোন ব্যবস্থা। নেই মাধ্যমিক স্তরের ইশকুল পর্যন্ত। এমন কি যে চাষবাস গ্রামের মূল ভিত, তাও তেমন নেই’।

জায়গাটা সাগরের কাছাকাছি হওয়ায় নোনা জল ও বালি মেশানো মাটিতে ফসল বলতে শুধু তরমুজ, কাঁকুড় জাতীয় ফসল আর হোগলা হয়। আর যুবকদের অর্থকরি ব্যবসা – হাঁস - মুরগি প্লোট্রি। আজকাল তো খুব শোনা যায় চিংড়ি চাষ। সেও পর্যন্ত আমাদের গ্রামে নেই। আমাদের গ্রামের দুটো গ্রাম পরে বেশ বড়ো একটা ভেড়ি আছে চিংড়ি চাষের। তাই আমরা এই নেই ব্যাপারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। দু’ একবার চেষ্টা - চরিত্র করেছিলাম পানীয় জলের জন্যে। পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে বেশ কয়েকবার ছোটাছুটি করেও বিশেষ কোন কাজ হয়নি। তবে গ্রামের অবস্থা দেখে পিতু পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে নয় খোদ সরকারের কাছে তদ্বির করার ব্যপারে নিজে দায়িত্ব নিল। ও মহাকরণে পুর্ত বিভাগের বেশ উঁচু লেবেলে চাকরি করে। তার ক্ষমতা আছে, সে তা কাজে লাগতেও পারে।

তা পিতুর তদ্বিরেই জন্যই হোক কিংবা এবারের পঞ্চায়েত প্রধান বিরোধী পক্ষের বলে তার জন্যই হোক, বছর খানেকের মাথায় তাপদগ্ধ এক দুপুরে একটা জিপ রাজ্যের ধূলো উড়িয়ে আমাদের গ্রামের সীমান্তে এসে দাঁড়ালো। আমাদের এই আদারে - পাদারে গ্রামে যেন স্বর্ণ রথ উড়ে এলো। নেহাত ঠেকায় না পড়লে কেউ বড়ো একটা পা রাখে না এই গ্রামে। দূষণ বাড়াতে কোনো গাড়ি ধোঁয়াও ছাড়ে না। বলা যায় আমাদের গ্রাম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সেই আদ্দি কালের ঘরানায়। সুতরাং গাড়ি দেখে বাচ্চারা খেলা ফেলে হুড়মুড় করে ছুটে এলো, শুধু তাই নয় পথ চলতি মহিলারা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন। আর আমরা বয়স্করা সব খবর পেয়ে এগিয়ে এলাম। এমনটা তো বড়ো একটা দেখা যায় না।

জিপ গাড়ি থেকে নামলেন কয়েকজন সুটেড - বুটেড অফিসার। জানা গেল পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্যই সরেজমিনে গ্রাম দেখতে এসেছেন সরকারি আমলার দল। দ্রুত খবরটা খুশির গন্ধ মেখে গ্রামের আমাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের বৌ মেয়েরা যারা মাইল খানেক পথ উজিয়ে নিত্যদিন কষ্ট করে ধুলো ঠেঙিয়ে পাশের গ্রামে জল আনতে যায় পানীয় জল, তারা সকলে খুব বেশি উত্ফুল্ল হলো এই খবরে। আর গ্রামের বুড়ো - হাবড়ারা যাদের শক্তিতে কুলায় না অতটা পথ ঠেঙিয়ে পরিশুদ্ধ জল আনার, তাঁরাও বিশুদ্ধ পানীয় জলের আশায় সত্যপীরকে সিন্নি চড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তবে এতো দেখা শোনার পরেও এক দিন দু-দিন করে কোটে গেল প্রায় বছরখানেক। কোথায় কি! কাকস্য পরিবেদনা। এরই মধ্যে পঞ্চায়েত প্রধান বুক ফুলিয়ে একদিন সর্বসমক্ষে বলল – এই যে সরকারি আমলারা সরেজমিনে দেখে গেলেন, সেও এই শর্মার দৌড়াদৌড়ির ফল। তবে ভাঁড়ার তো শাসক দলের হাতে কিনা! সবে তো এই সয়েল টেস্টের জন্যে মাটি গেছে। সরকারের গতি কে না জানে - শম্বুক গতি। আমি অবশ্য হাল ছাড়িনি, লেগে আছি। ফাইল ধামাচাপা হতে দেব না। জল কতদূর গড়ায় সেটাই দেখব। শেষ কথাটা পঞ্চায়েত প্রধানকে জোর দিয়ে উচ্চারণ করতে দেখে আশায় বুক বাঁধি। মনে মনে ভাবি একজন জোরদার মানুষ কাজটার পিছনে লেগে থাকার কারণে ব্যাপারটা ফলপ্রসু হবে। সরকারের টনক নড়েছে যখন। অবশেষে সময়ের সাথে সাথে সে আশাতেও মরচে পড়তে শুরু করল। মুখে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাইপ বোঝাই একটা লরি ঢুকল গ্রামে। আমাদের ঝিমিয়ে পড়া মনটা আবার নেচে উঠল।

পাইপের সঙ্গে কয়েকজন মিস্ত্রি নামল ধুপধাপ করে। তারা মুহূর্তের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে ‘হেইও জোয়ান হেইও, জোরসে মারো হেইও’ বলে নিজেদের কাজে লেগে গেল। কাজ আরম্ভ হতে শুধু বাচ্চাগুলো নয়, আমরা বড়রাও খুশি হলাম। অনেক মানুষ থাকে যারা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল গোছের, তারাও নিত্য খোঁজ খবর করে। আমি গ্রামের এক মাত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমাদের যেন অলিখিত অধিকার আছে পানীয় জলের ব্যাপারে কথা বলার। কেননা আমিই তো ছাত্রদের বোঝাই দূষণ মুক্ত পরিবেশ ও জলের কথা। ক্লাস না নিয়েও আমি স্বচ্ছন্দে এখানে বসে কাজকর্মের নজর রাখি। কবে যে গ্রামটা পানীয় জলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে ? সে ব্যাপারে নিজের মতামত নিয়ে জোর তর্ক জুড়ি। আমাদের গ্রামের পথের ধারের চায়ের দোকানটা শুধু ওই এক আলোচনায় সব সময় সরগম হয়ে থাকে।

একদিন দেখলাম গ্রামের বৌ মেয়েরাও জল আনতে যাওয়ার পথে মিস্ত্রির কাছে খোঁজখবর নিচ্ছে। ওরা জানতে আগ্রহী ওদের শ্রম লাঘব হতে আর কত দিনে ? অর্থাত গ্রামসুদ্ধ সবাই একটা আলোর দিকে তাকিয়ে আছে - খাবার পরিশুদ্ধ জল ? কিন্তু কোথায় জল! মাটি মেশানো বালিই তো শুধু উঠেছে। হেড মিস্ত্রি আশ্বাস দিল, ওপরে বালিমেশানো স্তর। তার নীচে নোনা জলের স্তর। সে সব ভেদ করে অনেক গভীরে মিষ্টি জলের স্তরে পাইপ নামাতে হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই। একটু বেশি সময় লাগালেও জল পাবেন - একবারে মিষ্টি জল।

আমাদের খুশিটা চলকে উঠল। সবুরে মেওয়া ফলে। এক লরি পাইপ ঢুকে যাবার পর আর এক লরি পাইপ এলো। পরে আরও এক লরি। ওমা, এতো লরির পর লরি পাইপ ঢুকে যাচ্ছে। কাজ শেষ হবে কবে ? কদিন বাদে আবার সেই জিপটা ধূলো উড়িয়ে গ্রামে ঢুকলো। কয়েকজন ভদ্র সভ্য মানুষ নেমেই মিস্ত্রিগুলোর সঙ্গে বচসা শুরু করেছিল। ওরা নাকি সব ঠিকাদারের লোক। তাই মিস্ত্রিদের সঙ্গে গোলমালে আমরা আর নাক গালালাম না। শুধু ওদের তর্ক দেখে বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়তে লাগলাম।

পরের দিন মিস্ত্রিগুলো তাঁবুর খুঁটি খুলে চলে যাবার উদ্দোগ নিতেই আমাদের টনক নড়ল। ওদের ঘিরে বৃত্তান্তটা জানতে চাই - মাটির ওপর হ্যান্ডেল দেয়া কলটি বসবে কবে ? সেটার হাতল ধরে চাপ দিলেই হজমি আর মিষ্টি জল হু হু করে বেরিয়ে আসবে - এসব কথা বলে এখন খুঁটি তুলে চলে যাচ্ছেন যে বড়ো ?

হেড মিস্ত্রি মিষ্টি হেসে মেলায়েম করে বলেন - হবে, হবে। তবে এখানে নয়, অন্য কোথাও। এখানে এত বালিতে কি পাম্প বসানো যায়, শুধু তো বালি উঠছে, মাটি কোথায় ?

আমরা ব্যাপারটা বুঝেও ঠিক বুঝতে পারছি না দেখে হেড মিস্ত্রি রাগ দেখাল, আমাদের ঠিকাদারের কত লোকসান হয়ে গেল জানেন! কত লাখ টাকার পাইপ মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। এরপর জায়গাটা পড়ে রইল কয়েকজন মিস্ত্রির পদচিহ্ন মেখে। জল-ই জীবন? জল, প্রচুর জল দেখতে আমরা অভ্যস্থ ? দু-পা এগুলোই সাগর ? কিন্তু যে মিষ্টি জল খেয়ে তৃপ্তি আসে, তেষ্টা মেটে সেই জল পেতে এখনও প্রতিক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.

Path Alias

/articles/jalaera-kathaa

Post By: Hindi
×