জলের ধারাপাত


এখন, জল, পানি, ওয়াটার তেমন আমল পাচ্ছে না। পাদ দোকের কাল আগেই গেছে। এখন চলছে অ্যাকোয়া আর (কারণ) বারি। বোতল সর্বস্ব। মল কালচার -এর কালে অমল হওয়ার মহা সুযোগ। মুক্ত যুগের নর - নারী পান করে আনন্দে। মুক্তি খোঁজে খাদ্যে, পোশাকে আর খিচুড়ি মুখের ভাষায়।

জল সদা চঞ্চল। জল ভাসে, ভাসায়। জল ডোবায়। জল পড়ে, পাতা নড়ে। জল - তৃষ্ণার সলিল, তীর্থের নীর, শান্তির বারি। জল প্রাণীর সঞ্জীবনী সুধা। শক্তির উত্স্য বিনাশের হেতু জল - কাঁদায়।

জলে জন্মালে বলে - জলজ। জলে ডুবলে - জলমগ্ন। আর জলে ফেলে দিলে। ফেলে দিলে ? দিতেই পারে। সাঁতার জানা থাকলে - ঠিক আছে। না জানাও ঠিক আছে। হ্যাঁ, ডুবুরি আসবে, নামবে।

মানুষ জলে জন্মায় না, মানুষ ডাঙার জীব। ব্যাঙের মতো উভচর জীব তো নয়। আর জন্মাবার পর, সময় মতো মুখে ভাত বা অন্নপ্রাশন হয়। যারা শিশুর মুখে ভাত দেয় না, যদি কট্টর ইংলিশ মিডিয়াম পন্থী হয়, তারা কেক, কফি দেয় কিনা আমার জানা নেই। জলের সঙ্গে মানুষের, আর শুধু মানুষের কেন, জলের সঙ্গে সকল জীবের সম্বন্ধ এক্কেবারে প্রাণের সম্বন্ধ। তাই বলে, হামাগুড়ির বয়স থেকেই শিশুকে সাঁতার শিখতে হবে না কি ? এ আবার কোন দেশি কথা ? তবে, মানুষ ডাঙার জীব হলেও, জলে পড়ে। জীবনে জলে পড়েনি এমন মানুষ কমই আছে – এ কথা হলফ করে বলা যায়। জলে পাঁক থাকলে, থাকতে পারে, আর পাঁকে পড়লে বাপরে, দু - চার ঢোক গিলে ফেললে - ভাবাই যায় না। কেউকেটা হলে তো রক্ষে নেই, মিডিয়ার ঘোড় দৌড় শুরু হবে।

জলের অনেক নাম - অপ, অম্বু, উদক, নীর, পয়ঃ, বারি, সলিল। নামাবলি ঝড়লে আরও অনেক অনেক পাওয়া যাবে। এখন থাক। সেই সঙ্গে জানা আছে, পানি আর ওয়াটার। এদেশে এক সময় একটা প্রথা চালু ছিল। স্ত্রী যে স্বামীগত প্রাণা, সতী - সাধ্বী, তার প্রমাণ স্বরূপ স্বামীর পায়ের বুড়ো আঙুল চোবানো এক বাটি জল, সকালে স্ত্রীকে খেতে হত। আর তারও আগে অবশ্যই স্বামীকে গড় হয়ে প্রণামটি সেরে ফেলতে হত। স্বামীর পায়ের বুড়ো আঙুল চোবানো এক বাটি জল খেলে, বিরাট পুণ্যি অর্জন আর সংসারের ব্যাপক মঙ্গল হত। এ নির্দেশ আসলে মনু না আরও কোন শাস্ত্রকারের, তা তো জানা নেই। তবে পা ধোয়া জলই যে আসলে পাদদোক, এটা ঠিক।

এখন, জল, পানি, ওয়াটার তেমন আমল পাচ্ছে না। পাদোদকের কাল আগেই গেছে। এখন চলছে অ্যাকোয়া আর ( কারণ ) বারি। বোতল সর্বস্ব। মল কালচার -এর কালে অমল হওয়ার মহা সুযোগ। মুক্ত যুগের নর - নারী পান করে আনন্দে। মুক্তি খোঁজে খাদ্যে, পোশাকে আর খিচুড়ি মুখের ভাষায়।

জল তরল পদার্থ - গন্ধ, বর্ণ, আকারহীন - কত কথা। তা হলে প্রথম বৃষ্টির টাপুর - টুপুর শব্দে জানলা খুলে খুশিতে হাত বাড়িয়ে যে ছোঁয়াটুকু তার সুবাস টুকুন, সোহাগ টুকুন কি কিছুই নয়। তা হলে, গৈরিক বর্ণ ধারণ করে যে গঙ্গা, ওই জলই তো পবিত্রতম জ্ঞানে কয়েক ফোটা তুলসি পাতা সহযোগে মুখে দিতে হয় হিন্দুর অন্তিম অবস্থায়, পরপারে যাবার পরম লগ্নে। কালো বরণ নয় যমুনার জল ! শ্রীরাধার মনের কথা, অন্তরের ব্যথা যমুনার ওই জলই না বুঝত। কালো বরণই তো শ্রীরাধার অন্তরের আলোয় রাধা শ্যাম।

‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল ’
পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে -
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল।
( ‘বধু’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রচনা ১২৯৫ বঙ্গাব্দে)

একদিকে খোলামেলা গ্রামের জীবন - বাপের বাড়ি, প্রকৃতির উদারতা, আর অপর দিকে শহুরে শ্বাসরুদ্ধ জীবন, সঙ্গে হৃদয় হীনতার মধ্যে দিন যাপন। বধুর বারংবার মনে পড়ে যায় ওই রেখে আসা দিনের কথা। সে খোঁজে, দহন জ্বালা জুড়াতে, - কোথা সে জল। যে জলের সঙ্গে বুক ডোবানো অন্তরঙ্গতা, সেই জলেই নারী খোঁজে তার অন্তিম গতি। জীবন এমনই রহস্যময় ! এ চিত্র অনেকটা পাল্টে গেছে। তাই ধূসর। তবে, বাংলা - ঝাড়খণ্ড সীমান্তে তথাকথিত শূদ্র রমণীদের কণ্ঠে শোনা যায় —‘আমপাতা চিরি চিরি লৌকা বনাব লো। / এত বড়ো সবনরেখা হেলকে পাইবার গো’। সুবর্ণরেখা নদী পার হয়ে আসলেই বাপের বাড়ি সেখানে আসার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আসা যায় না। তখন বধুর বুক ফেটে বেরিয়ে আসে রোদনের ভাষা, অশ্রু নীরে প্রাণের আকুতি। ( দ্রষ্টব্য - রোদনের ভাষা - নলিনী বেরা - একুশ শতক )।

তীর্থবারি - জলের আর এক পরিচয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে কিছু জায়গায় জল মানুষের কাছে বড় পবিত্র হয়ে ওঠে। ওই জলের আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। শ্রান্তিহীন, ক্লান্তিহীন, আশঙ্কাহীন মানুষেরা যাত্রা চলে অর্ধ কিংবা পূর্ণকুম্ভে, অথবা সাগর তীর্থের গঙ্গাসাগর মেলায়। কিংবা চেনা বা অচেনা নদী সঙ্গমের তীর্থবারির উদ্দেশ্যে। এই আকর্ষণ শুধুমাত্র আবেগ নয়, এ সুপ্রাচীন এক মহান জীতির অন্তলোকের পরিচয়। এ নিছক ধর্ম নয়, এ ভারতীয় দর্শন। এ যে কত সহস্র বছরের সাধনার ধন।

জল অমৃত সমান। কিন্তু আজ দূষণ গরল করে তুলছে জলাধার। সুদূর কুমেরু অঞ্চলে সাদার্ন সাগরের জলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। শুধু মানুষ নয়, জগতের জীবন রক্ষায় চাই জল। পানীয় জলের অভাব শুধু গরিব দেশেই নয়, পানীয় জলের অভাব ভারতেও রয়েছে। এখানে গ্রামাঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ পানীয় জল পান না। দূষণের দাপট বাড়ছে জলে - স্থলে - অন্তরীক্ষে। তবুও, ওই কুমেরু অঞ্চলে যাত্রী পর্যটনের আয়োজন চালাচ্ছে কোন কোন দেশ। এভারেস্ট শৃঙ্গ গলতে শুরু করছে। কুমেরুতে আগের তুলনায় এখন কম হারে তুষার জমছে। আবহ পরিমণ্ডলে সংকট ঘনাচ্ছে। 2015 খ্রিষ্টাব্দটি উষ্ণতম বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দ্বারা। কখনও -কখনও সংবাদপত্রে লেখা ছাপা হচ্ছে যে, কলকাতা জলের তলে - তলিয়ে যেতে পারে একদিন। জলোচ্ছ্বাস ঘটতে পারে সাগরে জলস্তর বৃদ্ধির দরুণ। এক কথায়, আশঙ্কা প্রতি দিন ক্রমশ ঘণীভূত হচ্ছে।

সৃষ্টি অনাসৃষ্টির কবলে পড়েছে। অভিশাপ ডেকে এনেছে মানুষ, এখন এই বিপদ থেকে আসান মানুষকেই করতে হবে। সংশোধনের আশু প্রয়োজন। ওই কাজ এক যোগে চালাতে হবে দ্রুত তালে। এখন আর রেষারেষি নয়, চাই পরস্পরের সহযোগিতা। ভোগবাদ সংযত করার দিন এসে গেছে। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই বিষ। এর জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরের বিশেষজ্ঞদের সমবেত প্রচেষ্টা। আশু কর্তব্য তৃষ্ণার্ত মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করা। পরিস্রুত জলের ব্যবস্থা করা। দিন দিন এই সমস্যা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। পৃথিবী এখন বড়ই উত্তপ্ত। সমাধান কিন্তু মোটেই জলবত্ তরলং নয়। এখন চাই শান্তির বারি।

Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.

Path Alias

/articles/jalaera-dhaaraapaata

Post By: Hindi
×