জলেই জীবন জলেই মরণ


হয়তো সরস্বতী নদীর মতো একদিন অনেক নদী হারিয়ে যাবে এই মাটির বুক থেকে। পুরনো মানচিত্রে রয়ে যাবে সেই নদীর স্মৃতিরেখা। অথচ প্রাচীন বড় বড় জনপদ, সভ্যতা, বাণিজ্যকেন্দ্র এই নদীরই দান। আজ প্রায় সমস্ত বড়ো নদীগুলো, তীরবর্তী সভ্য শহরের অগণিত মানুষের বর্জ্য বহন করতে করতে তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এই সমস্ত নদীগুলো বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলে বর্ষার জলরাশি নিয়ে। যা অনিবার্যভাবে প্রান্তবাসী গরিব মানুষদেরকে আরও দুঃখের স্রোতে ভাষায়। যে নদীগুলি ধর্মীয় আচারের আবেগে মিশে আছে, বিশেষ করে যাকে মা গঙ্গা বলি। যে কিনা এই ভূখণ্ডের সব পাপ ধুয়ে নিতে, পূর্ব পুরুষকে প্রেতযোনি থেকে মুক্ত করতে প্রবাহিত হয়েছিলেন আজ তিনি আমাদের বিজ্ঞান - সভ্যতার পাপ বহন করতে করতে দূষণ মাত্রার বিপদ সীমার অনেক ওপর দিয়ে বয়ে চলেছেন। এই একই অবস্থা মা নর্মদার। এই নদীর ওপর বাঁধ আজও দুই রাজ্যের সম্পর্কে অবনতির কারণ। এই তথাকথিত সভ্যতার আধিপত্যবাদের করাল গ্রাসে অনেক নদীর উত্স এবং স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে নদীমাতৃক দেশ। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন নদ - নদীকে মাতৃজ্ঞানে পূজার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জনমানসে প্রবাহিত যে ধর্মীয় আবেগ ছিল, আজ সেই ধর্মীয় আবেগ বিভিন্ন নদীর ক্ষীণ স্রোতধারার মতোই ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। নদীমাতৃক এই দেশে বিশেষ করে আমাদের এই বাংলার সমস্ত প্রিয় নদ - নদীগুলির স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় বর্তমানে এসেছে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি মূল নদী যেগুলিকে কেন্দ্র করে যে জনপদ গড়ে উঠেছে, তার স্বার্থেই। দক্ষিণ বাংলার ভাগীরথী বা গঙ্গা, অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, রূপনারায়ণ এই সমস্ত নদীগুলির কী সৃষ্টির সেই রূপ, সেই স্বাস্থ্য আছে ? দীর্ঘকাল ধরে জনপদের আবর্জনা বর্জ্যে মায়েদের স্বাস্থ্যে এখন ক্ষয়রোগ। অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এখন জনপদগুলির বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়েদের বুকে এখন অমৃতধারা বহে না, বহে কালকূট।

উত্তর বঙ্গের প্রায় প্রতিটি নদীর একই অবস্থা। মূল নদী তিস্তার উত্পত্তি স্থলে কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখে এসেছিলাম মায়ের হাড় কঙ্কাল। ওইখানেই নিকটবর্তী স্থানে একটি গুহা ঘরে বড়ো চৌবাচ্চা করে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে গরম জল। যাতে আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন, বরফ জমানো শীত থেকে আরাম পেতে এক বিদেশীনী মা, সম্পূর্ণ নিরাবরণ। তার কঙ্কাল কাঠামোর সঙ্গে বড়ো মিল ছিল তিস্তা মায়ের।

প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান না থাকার ফলে যে বাঁধ দিয়ে প্রকৃতিকে বাঁধার চেষ্টা করা হয়েছে, তার ফলস্বরূপ প্রায় প্রতি বছর বর্ষাতে বাংলার জনপদগুলি বন্যার জলে ভাসে। সরকারি ত্রাণ আসে, নেতাদের পকেট হাসে। এদের, এই দেশমাতৃকা, প্রকৃতি, সমাজের ওপর প্রেম সন্দেহের উদ্ধে নয়।

মা গঙ্গার ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ, ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর ব্যারেজ। এই দুই ব্যারেজের অতিরিক্ত পরিমাণ জলরাশি, যা তাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে হওয়ায়, অতি বর্ষণের ফলে বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন এমনিতেই মাঠঘাট সব জলপূর্ণ থাকে, সেই সময় এই দুই ব্যারেজ থেকে বিপদ সীমার ঊর্ধ্বে বইতে থাকা জলরাশি এক সঙ্গে ছেড়ে দেওয়ার ফলে মুর্শিদাবাদ জেলা ও বীরভূম জেলার উত্তর অংশকে প্রতি বর্ষায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একই অবস্থা অজয় - হিংলো, দামোদর সংলগ্ন বীরভূমের কিছু অংশের ও বর্ধমানের মানুষের। ডি. ভি. সি. এবং দুর্গাপুর ব্যারেজে যথোপযুক্ত ধারণ ক্ষমতা নেই বলেই ফি-বছর বর্ধমান বীরভূম সহ হাওড়া, হুগলির গরিব চাষিরা কেঁদে কুল পায় না। কংসাবতী, রূপনারায়ণ মুছে নিয়ে যায় মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগণার সুখ স্বপ্ন। বিভূতির ইছামতী চোখের জলে ভাসায়। উত্তরবঙ্গের তিস্তার বাঁধ দুই বাংলার দুঃখের কারণ।

স্মৃতির ডানার ভর করে চলে যাই আমার ছেলে বেলায় বীরভূমের দুবরাজপুর - তখন ক্লাস ফোরের ছাত্র আমি। বৃত্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে। সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম পৌষল্যা করব। পৌষ মাসের শেষে এই পিকনিক বা চড়ুইভাতি বলে আমরা গ্রামীণ ভাষায় একে পৌষল্যা বলতাম। জায়গা নির্বাচন হল শাল নদীর গাবাতে ( মানে শাল নদীর চড়ার বুকে )। নদীর দুই পাড়ে চাষের মাঠ, মাঠের শেষে ছোটো ছোটো অন্ত্যজ শ্রেণি গরিব মানুষদের জনপদ। আমরা সঙ্গে ফুটবল নিয়ে যেতাম নদীর বুকে বালির চরে খেলব বলে। চাষের মাঠ থেকে প্রয়োজন মতো আনাজ তুলে আনতাম, কেউ কিছু বলতো না। খাওয়া - দাওয়ার শেষে যা বেঁচে যেত ভিড় করে থাকা ওই গরিব মানুষগুলোকে দিয়ে দিতাম। দেখতাম খাবারগুলো নিতে এগিয়ে আসত, শীর্ণকায় বিগত যৌবনা শীর্ণ সন্তান কোলে মায়েরা। ছেঁড়া ফ্রক পরা ফেনালীতে কোমর ঢেকে, ছেঁড়া ব্লাউজ কোনক্রমে যৌবন ঢেকে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসত যৌবনবতী কন্যারা। ওদের হাসি দেখে মনে হতো ঠিক বীরভূমের শাল নদী, বাঁকুড়ার গন্ধেশ্বরী, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাগড়া নদীও এইরকম আরও আরও শুকিয়ে যাওয়া শীর্ণকায় নদীর মতো। বর্ষায় ক্ষণেকের যৌবন চলে গেলেই সারা বছর এই ধরণের নদীগুলোর একইরকম শীর্ণকায় করুণ দশা। কত সরকার এলো গেলো, আজও নদীর বুকে ফুটবল খেলা হয়। আজও নদীর বুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জনসভা হয়, পৌষল্যা হয়।

আজ রাজনৈতিক স্বার্থে বা ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য কলকাতাকে লন্ডন বানাতে গঙ্গা নদীর পাড় সংস্কার হয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিয়ন লাইট জ্বালিয়ে, পার্ক তৈরি করে সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে। কিন্তু এই নদী মায়েদের স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে, জনপদগুলির কপাল থেকে ফি-বছর সিঁদুরের টিপ যাতে মুছে না যায়, তার জন্য কেউ কি ভাববে না ? স্বঘোষিত পরিবেশ প্রেমী, পরিবেশবিদ বা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে প্রচারের আলো পেতে মহামান্য আদালতে চেঁচামেচি করে দৈনিক পত্রিকার হেড লাইন হন। কিন্তু জনপদগুলিতে সুখ - সমৃদ্ধি আশার আলোকে ঢিকিয়ে রাখতে, জনচেতনা বৃদ্ধিতে আজ স্বাধীনতার আটষট্টি বছর পরেও কোনো সরকার বা প্রশাসন কোনো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন নি।

হয়তো সরস্বতী নদীর মতো একদিন অনেক নদী হারিয়ে যাবে এই মাটির বুক থেকে। পুরনো মানচিত্রে রয়ে যাবে সেই নদীর স্মৃতিরেখা। অথচ প্রাচীন বড় বড় জনপদ, সভ্যতা, বাণিজ্যকেন্দ্র এই নদীরই দান। আজ প্রায় সমস্ত বড়ো নদীগুলো, তীরবর্তী সভ্য শহরের অগণিত মানুষের বর্জ্য বহন করতে করতে তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এই সমস্ত নদীগুলো বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলে বর্ষার জলরাশি নিয়ে। যা অনিবার্ষভাবে প্রান্তবাসী গরিব মানুষদেরকে আরও দুঃখের স্রোতে ভাষায়। যে নদীগুলি ধর্মীয় আচারের আবেগে মিশে আছে, বিশেষ করে যাকে মা গঙ্গা বলি। যে কিনা এই ভূখণ্ডের সব পাপ ধুয়ে নিতে, পূর্ব পুরুষকে প্রেতযোনি থেকে মুক্ত করতে প্রবাহিত হয়েছিলেন। আজ তিনি আমাদের বিজ্ঞান - সভ্যতার পাপ বহন করতে করতে দূষণ মাত্রার বিপদ সীমার অনেক ওপর দিয়ে বয়ে চলেছেন। এই একই অবস্থা মা নর্মদার। এই নদীর ওপর বাঁধ আজও দুই রাজ্যের সম্পর্কে অবনতির কারণ। এই তথাকথিত সভ্যতার আধিপত্যবাদের করাল গ্রাসে অনেক নদীর উত্স এবং স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে কেদারনাথের মতো ঘটনা এবং অনেক হড়পা বানে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

আমরা এখন আর পাই না কবি কুমুদরঞ্জনের সেই অজয় নদকে। যেখানে ‘ঠিক দুপুরে বাতাস লেগে নাচে জলের ঢেউ...’। যেখানে ‘জেলেরা দেয় বাচ লাফায় বোয়াল মাছ...’। এখন আর ‘নিরবাকাশ মুখর করে শঙ্খচিলের ডাক...’। শোনা যায় না। এখন মাথার ওপর শুকন ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় নদী চরে আটকে যাওয়া মৃতদেহ ঠুকরে খাবে বলে। এখন এই নদ নদীর সঙ্গম স্থলে কাশ পেকে হাওয়ায় ঢেউ ঘোষণা করে তাদের বার্ধক্যের মলিনতা।

Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.

Path Alias

/articles/jalaei-jaibana-jalaei-marana

Post By: Hindi
×