(1) ভূমিকা
কূটমানুষের কূটরাজনীতির লক্ষ্য মুনাফা অর্জন বলেই তা এত বিধ্বংসী ও অনিশ্চয়তার সূচক হয়ে উঠেছে। মানব সভ্যতার কেন্দ্রে এখন লোভ ও লোভী - আগ্রাসী মানুষরাই পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। এদের সুপরামর্শ ছাড়া পৃথিবী আজ অচল। অথচ সভ্যতার কেন্দ্রে থাকার কথা মানুষের, গণ-মানুষের সার্বিক উপস্থিতি। এখন প্রয়োজন মানুষ নয়, মানব সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকুক ‘গাছ’ ও ‘প্রকৃতি’। স্বাদ - বর্ণ গন্ধহীন স্বচ্ছ তরল জল। পান করা হয় বলে আর এক নাম পানি। কেবল কর্নাটক - তামিলনাড়ু নয়, পদ্মা - গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়েও কম দ্বন্দ্ব নেই। যে ভারত সিন্ধুর জল বন্ধ করে পাকিস্তানকে সমঝে দিতে চায় তাকে তো চিন আগেভাগেই ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদীর জল বন্ধ করে টাইট দিয়ে রেখেছে। যদিও এ পৃথ্বীর তিন ভাগই জল, তবু দক্ষিণ চিন সাগরের জলপথ ও সিন্ধুর গভীরে স্থিত প্রাকৃতিক রত্নাকর এই সময়ের বিশ্ব রাজনীতিকে ফের দ্বি-মেরু যুদ্ধের মুখোমুখি করে দিয়েছে বলা যায়। জলের আর এক জীবন। একথা সত্য যে জলেই প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এবং প্রতি প্রাণ কোষের শতকরা আশি ভাগই জলে পরিপূর্ণ থাকে বা প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য যা জরুরী ও অত্যাবশ্যক। বারি, সলিল, উদক, অম্বু, নীর - কত আদরের নাম এই পানীয় জল, চাষের জল, নদীর জল, চোখের জল এবং অবাক জল পান।
(2) ভূমি
জন্য (জ) লালিত (ল) যাতে বা আচ্ছাদন করে যে - তাই হল ‘জল’। শব্দের ব্যুত্পত্তি। ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা শব্দার্থ - বিধি অনুযায়ী জল যেমন ওয়াটারকে ( Water ) বোঝায় তেমনই জনন - লালনকারী শ্রমিক - কর্মী জনমজুরকেও বোঝায়।
জলের অন্য দুটি রূপ
জলীয় বাষ্প - বরফ
(মেঘ) - ( হিমশৈল )
জননকারী সত্তা জল বা জনসাধারণ ‘জলের সমোচ্চশীলতা’ ধর্ম মেনে চলে। জলের উপরিতল সাদা ও সমান থাকে এবং চকচক করে দীপ্তি প্রকাশ করে। আবেগময় জনসাধারণও স্বভাবতই সমান থাকা পছন্দ করেন। অত্যন্ত ধনী অথচ অসাম্যবাদী দেশের জনসাধারণের আবেগময় যৌথতা বোঝাতে জল শব্দটি ব্যবহৃত হত। যেমন জনসমুদ্র, জনস্রোত, জলজ্যান্ত, তেমনই টাকার কুমরী, ঘোড়েল, রাঘববোয়াল, রুই – কাতলা, সর্বোপরি মাত্স্যন্যায়। যে নেতৃস্থানীয় লোকেরা সমাজের উপরিতলে উঠে সম্পদ বণ্টন করত, শাসন করত তাদের বলা হত গর্জনকারী মেঘ ( গুগর্জন্য )।
(3) জল ও জলদূষণ
প্রাণধারণের অন্যতম প্রয়োজনগুলির মধ্যে একটি হল জল। এর উত্স হল হ্রদ, নদী, খাল এবং ভূগর্ভের জল। শতকরা 97 ভাগ হল সমুদ্রের নোনা জল। তবে সমুদ্রের জলকে পানযোগ্য করা যায়। মাটি চুঁইয়ে নামা ভূগর্ভস্থ জল পাথরের ছিদ্র ফাটল ও মাটিতে জমা হয়। অধিকাংশ ভূগর্ভস্থ জল বিশুদ্ধ। পানীয় জলের শতকরা 90 ভাগ যোগান আসে ভূগর্ভস্থ জল থেকে। ভূগর্ভস্থ জলে যদি দূষিত - মাটি চোঁয়ানো জল মেশে বা দূষিত জলই চুঁইয়ে নামে তাহলে দূষিত হয় এই জল। জলের দ্রাবণ ক্ষমতা বেশি বলেই জল সহজে দূষিত হয়। জলকে দূষিত করে নর্দমার আবর্জনা, তেল, পলি, শিল্প - রাসায়নিক, পারদ, ক্যডমিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতু, রাসায়নিক পদার্থ, আর্সেনিক ইত্যাদি। তাছাড়া বায়ু দূষক কীটনাশক ( ডিডিটি ), রাসায়নিক সার ( বৃষ্টির জলে দ্রবীভূত হয়ে ), আগাছানাশক ( জমি থেকে চুঁইয়ে নামে ), মানুষের বর্জ্য, রঞ্জক পদার্থ, সাবান, ডিটারজেণ্ট, তাপ, পারমানবিক বর্জ্য ইত্যাদিও জল দূষণের কারণ। দূষিত জল থেকে ক্যান্সার, স্নায়ু রোগ এবং ফুসফুসের অসুখ হতে পারে। পরিশ্রুত জল পান না করলে জল বাহিত অসুখ - বিসুখ যেমন কলেরা, টাইফয়েড, আন্ত্রিক, আমাশয় ইত্যাদি হয়। পানীয় জলে জীবাণুর উপস্থিতির কারণেই হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা মহামারির আকারও ধারণ করতে পারে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সঙ্গে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা হল বিশুদ্ধ পানীয় জল। বিভিন্ন জলবাহিত রোগের প্রকোপে পৃথিবীতে প্রতি বত্সর 10 কোটি শিশুর জীবনবাসনা ঘটে। মিষ্টি জল বা স্বাদু জল কিন্তু নবীকরণযোগ্য সম্পদ। জলচক্রের মাধ্যমে সমুদ্রের লবণাক্ত জল প্রাকৃতিক বাষ্পীভবন - ঘনীভবন প্রক্রিয়ার সাহায্যে মেঘ, বৃষ্টি, তুষারপাতের মধ্য দিয়ে মিষ্টি জলরূপে পৃথিবীতে নেমে আসে। এই মিষ্টি জল আবার নদ, নদী, খাল, বিল, বেয়ে সমুদ্রের নোনাজলে মিশে যায়। যেটুকু মিষ্টি জল মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের ব্যবহারের জন্য পড়ে তাতে বিশুদ্ধ ব্যবহারের জল, কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জলের জোগান আসে।
পৃথিবীতে জলের অভাব নেই। কিন্তু মোট জলের 97 ভাগ ( শতকরা ) লবণাক্ত। মিষ্টি জলের শতকরা 90 ভাগ সঞ্চিত থাকে পর্বত শিখরে হিমশৈল রূপে, মেরু অঞ্চলে, হিমবাহে, ভূগর্ভে, ভূপৃষ্ঠস্থ নদনদী, হ্রদ, জলাশয় - জলাভূমিতে, মৃত্তিকায় ধৃত অবস্থায় আর বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প হিসেবে। পৃথিবীর মোট জলসম্পদ কিন্তু পরিমেয়। সমুদ্রের জল 133 কোটি ৮০ লক্ষ কিউবিক মিটার ( 96.169 শতাংশ ), হিমবাহ ও পর্বত শিখরে সঞ্চিত 2 কোটি 34 লক্ষ কিউবিক মিটার ( 1.689 শতাংশ), মেরু ও সন্নিহিত অঞ্চলে স্থায়ী তুষার 3 লক্ষ কিউবিক মিটার ( 0.0216 শতাংশ ), হ্রদ ও বৃবত জলাশয়ে সঞ্চিত জল 1 লক্ষ 76 হাজার কিউবিক মিটার ( 0.0127 শতাংশ ), মৃত্তিকায় ধৃত জল 16 হাজার 500 কিউবিক মিটার ( 0.0012 শতাংশ ), বয়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প 12 হাজার 900 কিউবিক মিটার ( 0.0009 শতাংশ ), জলাভূমিতে সঞ্চিত জল 11 হাজার 470 কিউবিক মিটার ( 0.0008 শতাংশ ), নদীতে প্রবহমান জল 2,120 কিউবিক মিটার ( 0.0002 শতাংশ ) ও জীবকোষে অবস্থিত জল 1 হাজার 120 কিউবিক মিটার ( 0.0001 শতাংশ )। আমাদের বসুন্ধরায় মোট জলের পরিমাণ 138 কোটি 59 লক্ষ 84 হাজার 610 কিউবিক মিটার (100 শতাংশ )।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যত জল - সঙ্কটের মোকাবিলা প্রয়োজন। যেমন জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জল ব্যবহারে অপচয় রোধ, জলসম্পদ পরিকল্পনা গ্রহণ ( সংরক্ষণ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে ), বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও লবণাক্ত সমুদ্র জল থেকে মিষ্ট জল উত্পাদন বা জল শোধন প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
(5) বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে ?
জল দূষণের প্রকৃতি ( ভৌত দূষণ, রাসায়নিক দূষণ, জৈবিক দূষণ, জীবাণু দূষণ, তাপ দূষণ ) ও কারণের ( মনুষ্য সৃষ্ট ও মানুষের তৈরি পদ্ধতি ও ব্যস্থাপনা ) দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় অর্থনীতি ও রাজনীতি - ক্ষমতার রাজনীতি কী গম্ভীরভাবে এসবের সঙ্গে জড়িত। উন্নয়ন, বিশ্বায়নের সঙ্গেই জটিল হয়ে আছে পরিবেশ দূষণ ও জল দূষণের সমস্যা। সমস্যার মধ্যেই সমাধান খুঁজে নিতে হবে। তাকেই বলে পাল্টা রাজনীতি - পরিবেশ বান্ধব সবুজ অর্থনীতি ও সবুজ রাজনীতির প্রশ্ন। সবুজ রাজনীতি ( Green Politics ) নতুন কিছু নয়। জার্মানিতে তো গ্রীন পার্টি এখনো আছে। আর সবুজ অর্থনীতির শিকড় সভ্যতার অনেক পিছনে। কলম্বাস - পূর্ব আমেরিকায় আড়াই হাজার বছরের বহু বৈচিত্র ও বিবিধ সভ্যতার ইতিহাসে, বৈদিক ও ভারতীয় সভ্যতায় - সর্বত্রই সবুজ অর্থনীতির প্রশ্নই মুখ্য ছিল। বরং রাজনীতি ছিল অনেক লঘু, অনেক জায়গায় অনুপস্থিতও বলা যায়।
কূটমানুষের কূটরাজনীতির লক্ষ্য মুনাফা অর্জন বলেই তা এত বিধ্বংসী ও অনিশ্চয়তার সূচক হয়ে উঠেছে। মানব সভ্যতার কেন্দ্রে এখন লোভ ও লোভী - আগ্রাসী মানুষরাই পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। এদের সুপরামর্শ ছাড়া পৃথিবী আজ অচল। অথচ সভ্যতার কেন্দ্রে থাকার কথা মানুষের, গণ-মানুষের সার্বিক উপস্থিতি। এখন প্রয়োজন মানুষ নয়, মানব সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকুক ‘গাছ’ ও ‘প্রকৃতি’। সবুজ অর্থনীতি ও রাজনীতি জল ও সবুজ প্রকৃতি - পরিবেশের মাঝেই জায়মান হবে। প্রাণের ও প্রকৃতির উপাসনা ছিল আমাদের সুন্দর ও সবুজ পৃথিবীতে -ভবিষ্যতেও প্রাণের ও প্রকৃতির উপাসনা থাকা উচিত।
অতীতের সবকিছুই ভালো ছিল, সঠিক ছিল এমন নয়। বরঞ্চ প্রকৃতি -পরিবেশের ধ্বংস ও বিনির্মাণের প্রশ্নটি বারে বারে উঠে এসেছে। বিশ্বের সমস্ত প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতায় প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণের সমস্যা প্রকট ছিল বলা যায়। তবু মানুষ যেসব সংকট অতিক্রম করতে চেয়েছে এবং করতে পেরেছে। অতীতের দিকে তাকিয়ে আমাদের ভবিষ্যত বিনির্মাণ ও বিনিশ্চয় করা উচিত।
Source: Published at Gopalpur, Sarkarpool, South 24 Parganas, Pin -700143.
Path Alias
/articles/jala-o-sabauja-raajanaitaira-khaonjae
Post By: Hindi