গভীর কুয়োর দুই থামে আটকানো কাছের চক্র অর্থাত্ ভুন বারো মাস ঘুরেই চলেছে। পাতালের ভৌমজল সে ওপরে তুলে আনে। মরুভূমিতে ভুনের কাজ বারো মাসই। আর ইন্দ্রের.. ইন্দ্রের জন্য কেবল এক মুহূর্ত।
ভুনথারা বারে মাস
ইন্দ্র থারি এক ঘড়ি।
এ প্রবাদ ইন্দ্রের সম্মানে, নাকী ভুনেরই সম্মানে, সেকথা ঠিকঠাক বলা শক্ত। এর একটা অর্থ হতে পারে – বেচারা ভুন বারো মাস ঘুরে ঘুরে যে জল তোলে, ইন্দ্রদেব এক মুহূর্তে এক বারেই সেই পরিমাণ জল বর্ষণ করে থাকেন। দ্বিতীয় অর্থ এটাও হতে পারে, দেবরাজ ইন্দ্রের জন্যও মরুভূমিতে মাত্র একটি মুহূর্তেই বরাদ্ধ, অথচ ভুনের জন্য পুরো বারো মাস।
আসলে, এ প্রবাদ দুজনের কাউকেই ছোট করার জন্য নয়। বরং ইন্দ্রদেব এবং ভুন- অর্থাত্ পালর পানি এবং পাতাল পানি- দুয়ের শাশ্বত সম্পর্কের কথাই এতে নিহিত। কেননা এক মুহূর্তে বৃষ্টির থেকে পাওয়া পালর পানি-ই তো আস্তে আস্তে চুঁইয়ে পাতাল পানিতে রূপান্তরিত হয়। দুই-ই আসলে জীবনেরই রূপ এবং উভয়েই তো প্রবাহমান। ভূপৃষ্ঠের ওপর বইতে থাকা পালর পানি চোখে দেখা যায়, কিন্তু মাটির গভীরে থাকা পাতাল পানি দেখা যায় না, এইটুকুই যা তফাত্।
যে জল দেখা যায় না অর্থাত্ ভৌমজল, তাকেও অনুভব করার জন্য এক বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন। কোথাও কোথাও পাতালের গভীরে থাকা জলের আরেক নাম সির, আর যার তাকে দেখতে পায়, তাদের বলা হয় সিরবি কিন্তু শুধুমাত্র ঐ ভৌমজল অনুভব করার ক্ষমতাটুকুই যথেষ্ট নয়। তার প্রতি সমাজের এক বিশেষ দৃষ্টিকোণও খুবই জরুরি। এই মূল্য বোধটাই ভূগর্ভের ঐ জল অনুভব, অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিতরণের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে থাকে, আর তার থেকেও বড় কথা, একবার ঐ জলের উত্স ও উত্তোলন অধিগত হওয়ার পর তা হারিয়ে না ফেলার সচেতনতাও সে তৈরি করে দেয়।
সারা দেশ জুড়েই তো কুয়ো আছে। কিন্তু রাজস্থানের অনেক জায়গাতেই বিশেষ করে মরুভূমিতে কুয়োর অর্থ সত্যি সত্যিই যেন পাতাল প্রবেশ। রাজস্থানে যেখানে যেখানে বর্ষা বেশি, সেখানে ভৌমজল কিছুটা ওপরে যেখানে যেখামে বর্ষা রীতিমতো কম, সেসব জায়গায় সমানুপাতিক হারে ভৌমজলের গভীরতাও বেড়ে যেতে থাকে।
মরুভূমিতে এর গভীরতা সাধারণ একশো থেকে একশো ত্রিশ মিটার অর্থাত্ তিনশো থেকে চারশো ফিট পর্যন্ত। মরুভূমির জনসমাজ এই গভীরতাকে নিজেদের হাতে এবং খুবই আত্মিকভাবে মেপে থাকে। মাপের একটি নাম পুরুষ বা পুরুখ। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ভূমির সমান্তরালে দুই হাত ছড়িয়ে ধরলে যতটা লম্বা হয়, তা হল এক পুরুষ। মাপটা সাধারণভাবে ছয় ফিট বা তার কাছাকাছি। বেশ ভাল গভীর কুয়ো ষাট পুরুষ পর্যন্ত নামে। তবে সরাসরি ষাট পুরুষ না বলে, ভালোবেসে একে ষাঠি বলা হয়।
এত গভীর কুয়ো দেশের অন্য আর কোন জায়গায় দেখা যায় না। অবশ্য তার দরকারও পড়ে না। তবুও যদি আমরা খুঁড়তে চাইও, তাহলেও সাধারণ নিয়মে তা সম্ভব হবে না। এত গভীর কুয়ো কাটতে গেলে মাটির ধ্বস আটকানো খুব সহজ কাজ নয়, যথেষ্ট কঠিন এ কাজ। তাহলে রাজস্থানে যাঁরা জলের কাজ করেন তাঁরা এই কঠিন কাজকে কী সহজ করে ভাবতে শিখেছেন – ব্যাপারটা এমন নয়। আসল কথাটা হল, কঠিন কাজটাই কী ভাবে সহজভাবে করা যায় সে উপায়গুলো তাঁরা খুঁজে বের করেছেন।
কিননা ক্রিয়া পদটির অর্থ হল খনন করা, আর যারা কুয়ো খোঁড়েন তাদের বলা হয় কিনিয়া। সিদ্ধ- দৃষ্টিসম্পন্ন সিরবি পাতালের জল দেখতে পায় এবং তার নির্দেশমতো সিদ্ধ- হস্ত কিনিয়া সেখানে খোঁড়ার কাজ আরম্ভ করে। কিনিয়া কোনো বিশেষ জাতি নয়। এ কাজে নিপুণ, যেকোন জাতির মানুষই কিনিয়া বলে পরিচিতি পেতে পারে। তবে মেঘওয়াল, ঔড় এবং ভিল উপজাতীয় পরিবারগুলি থেকে সহজেই কিনিয়া বেরিয়ে আসে।
কুয়োর ব্যাস নির্ধারিত হয়, মাটির তলায় কতটা জল পাওয়া যাবে ওপর ভিত্তি করে। যদি জল বেশি পাওয়া যাবে- এমন আন্দাজ করা যায়, তাহলে ব্যাস বড় করা হয়। তখন জল তোলার জন্য একটা নয়, দুটো এমনকী চারটে চড়সও লাগতে পারে। তবে ব্যবস্থা এমন করা থাকে যে একসঙ্গে ওপরে ওঠার সময়ও চড়সগুলি একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা না লাগায়।
রাজস্থানে যেসব অঞ্চলে ভৌমজল খুব একটা গভীরে নয়, সেখানে পুরো খোঁড়া হয়ে গেলে আভ্যন্তরীণ জলের উত্স পথগুলি পেয়ে যাবার পর নীচের দিক থেকে ওপর পর্যন্ত বাঁধিয়ে দেওয়ার চল আছে। সাধারণ পাথর এবং ইঁট দিয়েই বাঁধানোর কাজ হয়। এ রকম বাঁধানোর কাজ সিধ অর্থাত্ সোজা বলেই পরিচিত। তবে যেখানে ভৌমজল অনেক গভীরে, সেখানে মাটি খুঁড়ে ক্রমাগত নামতে থাকলে ওপর থেকে মাটি ধ্বসে যাবার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে কুয়োগুলিকে ওপর থেকে নীচে ধাপে ধাপে বাঁধানো হয়। কিছুটা খোঁড়া হল, সেটুকু বাঁধিয়ে নেওয়া হল, তারপর আবার চলল খোঁড়া কাজ। এই উল্টো রকমের বাঁধানোর পদ্ধতিকে বলা হয় উন্ধ। জল যদি আরও গভীরে হয়, সেখানে সাধারণই হোক বা উন্ধ, প্রচলিত পাথরের কোন ধরনের বাঁধা-ই নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে খাঁজে খাঁজে আটকে যেতে পারে, এরকম অনেক পাথর তৈরি করা হয়। খাঁজ বা ঘাট যেমন ডাইনে - বাঁয়ে থাকে, তেমন ওপর নীচেও থাকে। প্রতিটি পাথরের খণ্ড তার ওপরে - নীচে এবং দুই পাশের পাথরের সঙ্গে খাঁজে খাঁজে আটকে গোল হয়ে কুয়োর সীমানা বরাবর এক স্তর বাঁধাই শেষ করে। এভাবে পুরো কাজটা হয়ে গেলে আবার নতুন করে খোদাই শুরু হয়। একে বলে সুখী বাঁধাই।
কোথাও কোথাও গভীরতার সঙ্গে মাটির চরিত্রও এমন ভাবে বদলে যেতে থাকে যে সিন্ধ, উন্ধ বা সুখী তিন ধরনের বাঁধাই -এর কোনোটাই কাজে আসে না। তখন একটু একটু করে খোঁড়া হয় আর গোলাকারে বাঁধানো হতে থাকে এবং কিছুটা গভীরে গেলেই শুরু হয় ফাঁক খোদাই -এর প্রক্রিয়া। বৃত্তাকার মেঝেটির চার ভাগের এক ভাগ খুঁড়ে আগে সেটুকু বাঁধিয়ে পোক্ত করে নেওয়া হল। এবার খোঁড়া হবে ঠিক তার বিপরীতের এক চতুর্থাংশ অংশটি। সেটিও বাধাঁনো হবে একই ভাবে এবং জল না পাওয়া পর্যন্ত কাজ চলতে থাকবে। এভাবে চার হাত পরিমাণ খুঁজতে হলে চার - চার হাতের হিসেবে ভাগ করেই খোঁড়া হতে থাকে। নীচে যদি কখনো চাটান অর্থাত্ বিস্তৃত পাথরের স্তরে এসে খোঁড়ার কাজ আটকে যায়, তাহলেও বারুদ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা কখনো ফাটানো হয় না। কারণ বিস্ফোরণের শব্দের কম্পন ওপরের বাঁধাই কম জোরি করে দিতে পারে। তাই এক্ষেত্রে তা হাতেই আস্তে আস্তে ভাঙা হয়।
ভূপৃষ্ঠ ও পাতালকে জুড়তে হবে। কিন্তু অত্যন্ত সাবধানে। ভূপৃষ্ঠের মাটি যেন পাতালে ধ্বসে না পড়ে তাই বাঁধানোর এত রকমের ব্যবস্থা। গিলি গাঁথনিতে সাধারণ সুরকি চুনে কাজ চলে না। তার সঙ্গে ইঁটের ছাই, বেলের আঠা, গুড়, পাটের খুবই মিহি টুকরো প্রভৃতি খুব ভালোভাবে মেশাতে হয়। কখনো আবার বলদে টানা চাকির মোটা চুন, হাত চাকিতে পিষে আরও মিহি ও মসৃণ করে নেওয়া হয়। এত গভীর ও ভারী কাজ যাতে বছরের পর বছর টিকে থাকে তার জন্যই এত ব্যবস্থা। কুয়োর ভেতরের কাজ শেষ হলে পর ওপরের কাজ শুরু হয়। তবে ওপরে শুধু কুয়োর পাড় বাঁধিয়েই কাজ শেষ হয় না। আরো অনেক কাজ থাকে। অবশ্য তার কারণও আছে। একে তো জল উঠবে সেই অতল গভীর থেকে। তাও যদি ছোট বালতিতে তোলা হয়, তাহলে তিনশো হাত টেনে তোলার পরিশ্রমের পর কীই বা পাওয়া গেল... তাই বড় ডোল বা চড়সে করে জল তোলা হয়। এতে একসঙ্গে আট - দশ বালতি জল একসঙ্গে ওপরে উঠে আসে। তাই এত বড় ডোল ওপরে তুলতে যে ভুন বা চক্র লাগবে, তাও হাওয়া চাই যথেষ্ট মজবুত। যে থামের সাহায্যে ভুন লাগানো হবে, তাও হবে শক্তপোক্ত। এতটা জল একসঙ্গে ওপরে উঠে আসায় তা ঢেলে রাখার জন্য রয়েছে কুণ্ড। কুণ্ডের জল বয়ে এসে আরও একটা বড় কুণ্ডে জমা হয় যেখান থেকে সহজে জল নেওয়া যাবে। আর ঢালাঢলির সময় যে অল্প একটু জল কুয়োর পাড়ে পড়বে-তাও সংগ্রহ করে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ জলটুকু সংগ্রহ করা হয় পশুদের জন্য। সব কিছু করতে করতে ক্রমে এত কিছু তৈরি হয়ে যায় যে, ছোট বাড়ি, বিদ্যালয় বা মহলের মতোই লাগে।
পাতালের গভীর থেকে জল তুলে আনতে অনেক উপকরণেই প্রয়োজন। বিশাল এই কর্মকাণ্ডের সব থেকে ছোট অংশগুলোও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ছোট অংশগুলো কাজ না করলে বড় অংশগুলোও কাজ করবে না। প্রতিটি জিনিসই কাজের, তাই প্রত্যেকটিই সুনামেরও।
প্রথমে দেখা যাক ভূ-জলের নাম – পাতাল পানি তো আছেই, তাছাড়াও সেবো, সেজো, সোতা, ওয়াকল পানি, ওয়ালিও, ভুঁই জল প্রভৃতি বিভিন্ন নামে তাকে ডাকা হয়। আরো দুটো নাম হল, সির ও তলসির। ভৌমজল ছাড়াও সির শব্দটির আরও দুটি অর্থ আছে। প্রথমত মিষ্টি, দ্বিতীয়ত প্রতিদিনের উপার্জন। এক দিক থেকে দুই অর্থেরই কুয়োর জলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিদিনের উপার্জনের মতোই কুয়োও দেয় প্রতিদিনের পানীয় জল। তবে মিতব্যয়িতা ও পূর্ব পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই রোজাগারে কোন মতেই পোষাবে না। পৃথিবী তথা সংসার-স্বরূপ কুয়োর জগতে বিভিন্ন ধরনের কুয়ো-ই রয়েছে। না বাঁধানো কাঁচা কুয়োকে বলে দ্রহ দহড় অথবা দৈড়। বর্গীয় ব(ব) এবং অন্তস্থ ব(ব ওয়)-এর পার্থক্যে বেরা ও ওয়েরা এবং বোরি ও ওয়েরি –এই চারটি নামও পাওয়া যায়। কুণ্ড, কূপ তো আছেই, আরও একটি নাম হল পাহুর। শোনা যায় কোন এক সময় পাহুর রাজবংশ এত কুয়ো তৈরি করিয়েছিল যে ওই এলাকায় দীর্ঘদিন কুয়োর একটি প্রতিশব্দ হয়ে যায় পাহুর। কোইটো অথবা কোসিটো হল অগভীর কুয়ো. আরো গভীর কুয়োকে বলা হয় কোহর। বেশিরভাগ জায়গাতেই যেহেতু ভৌমজল অনেক গভীরে তাই গভীর কুয়োর প্রতিশব্দই পাওয়া যায় বেশি। যেমন – পাখাতল, ভমলিয়ো, ভঁওয়র কুয়ো, খারিকুয়ো ইত্যাদি। চওড়া কুয়োর নাম বৈরাগর। যে কুয়োতে চারটি দিকে একই সঙ্গে জল তোলা যায়, তাকে বলে চৌতিনা। চৌতিনার আরেকটি প্রতিশব্দ হল চৌকরণো। যে কুয়োতে জল পর্যন্ত নেমে যাওয়ার সিঁড়ি করা আছে, তা হল বাউড়ি, পাগবাও বা ঝালর। আর শুধু পশুদের জল খাওয়ানোর জন্য যে কুয়ো তার নাম পিচকো বা পেজকো।
গভীর কুয়ো থেকে জল তুলতে বড় আকারের ডোলা অথবা চড়স ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এক ঘড়ায় কুড়ি লিটার জল ধরে। ডোলে দু-তিন ঘড়া জল সহজেই পাওয়া যায়। চড়স, মোট ও কোস হয় সাধারণত সাত ঘড়ার। এর আরও দুটি প্রতিশব্দ পুর এবং গাঞ্জর। সবগুলিতেই প্রচুর জল ধরে। তাই ভর্তি অবস্থায় এগুলিকে দু- তিনশো হাত ওপরে টেনে তোলা, জল ঢেলে নেওয়া এসব ভারী পরিশ্রামসাধ্য কাজ করতে বিভিন্ন উপকরণ ও সাবধানতা-দুটোই প্রয়োজন।
উট অথবা জোড়া বলদের সাহায্যে জলভর্তি চড়স কুয়ো থেকে টেনে তোলা হয়। চড়সের ভার অত গভীর থেকে টেনে তুলতে যাতে তাদের বেশি পরিশ্রম করতে না হয়, সেজন্য কুয়োর সঙ্গে তৈরি করা থাকে সারণ। এটি হল এক ধরনের ঢালু রাস্তা। উট বা বলদে চড়স টেনে তোলার সময় এই রাস্তা দিয়ে নীচের দিকে চলে। সারণের ঢাল, ভার টেনে তোলার কাজটা সহজ করে দেয়। সারণ শব্দটির একটি অর্থ হল যে কাজ সারে। সত্যি সত্যিই সারণ গভীর কুয়ো থেকে জল তোলার কাজে অপরিহার্য ভূমিকা নেয়। কুয়ো যতটা গভীর, সারণ যদি ততটাই লম্বা করা হয়, তাহলে প্রথম কথা, জায়গা অনেক লাগবে, দ্বিতীয়ত, ঢালের শেষ প্রান্তে নেমে যাওয়ার পর খুব আস্তে আস্তে চড়াইতে উঠে বলদ বা উটের দ্বিতীয়বার জল তোলা শুরু করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এজন্য কুয়ো যতটা গভীর, সারণের দৈর্ঘ্য হবে তার অর্ধেক এবং এক জোড়া বলদের বদলে দু জোড়া বলদ ব্যবহার করা হয়।
তিনশো হাত গভীর কুয়োতে চড়স ভরা হলে প্রথম জোড়া বলদ দেড়শো হাত লম্বা সারণ বরাবর শেষ প্রান্তে নেমে গিয়ে সেটাকে অর্ধেকটা ওপরে তুলে আনে। তখন ক্ষণিকের মধ্যে বিশেষ কায়দায় চড়সের দড়ি দ্বিতীয় জোড়া বলদের কাঁধে জুতে দেওয়া হয়। আর প্রথম জোড়াকে দড়ি থেকে মুক্ত করে আবার হাঁটিয়ে চড়াইয়ের ওপরে উঠিয়ে আনা হতে থাকে। মাঝের সময়ে দ্বিতীয় জোড়া বলদ বাকি দেড়শো হাত টেনে চড়সটিকে ওপরে তুলে আনে। পাতালের জল ভূপৃষ্ঠে বহমান হয় এভাবেই। সম্পূর্ণ একবার কাজটি করা হলে, তাকে বলে বারি অথবা ওয়ারো আর যারা কাজ করে তাদের নাম হল বারিয়ো। অত্যন্ত ভারী জলপূর্ণ চড়স কুয়োর বাইরে এনে খালি করতে গেলে বুদ্ধি ও শক্তি দুয়েরই দরকার হয়। ওপরে উঠে আসার পর চড়স যখন থামে তখন সেটি হাত দিয়ে টেনে আনা হয় না। কেননা এতে চড়সের সঙ্গে বারিয়ো-ও কুয়োর ভেতরে চলে যেতে পারে। তাই চড়সটিকে প্রথমে উল্টোদিকে ধাক্কা দেওয়া হয়। ভারী হওয়ার জন্য চড়স দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসে, পাড় পর্যন্ত এসে গেলেই চেপে ধরে এক ঝটকায় তা খালি করে ফেলা হয়।
কোন এক সময় সমাজে বারিয়োদের এই কঠিন কাজের বিশেষ সম্মান ছিল। বিয়ের সময় বরযাত্রী এলে পংক্তি ভোজনে প্রথমে বারিয়োদের বসিয়ে ভালোভাবে খাওয়ানো হত। বারিয়োদের অপর নাম ছিল চড়সিয়ো, অর্থাত্ যারা চড়স খালি করে। এ কাজে বারিয়োদের সঙ্গী হল খাম্ভি অথবা খাম্ভোরি। খাম্ভিবা বলদ গুলোকে সারণের নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে যেত এবং চড়স অর্ধেকটা উঠে এলে বিশেষ কৌশলে এক ধরনের কীল অর্থাত্ খুঁটির সাহায্যে চড়সের দড়ি প্রথম জোড়া থেকে খুলে দ্বিতীয় জোড়া বলদে জুতে দিত। তাই তাদের আরেক নাম ছিল কিলিয়ো।
চড়সের সঙ্গে বলদকে যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, সেটির নাম হল লাব। লাব, ঘাস বা শন দিয়ে নয়, তৈরি হয় চামড়া দিয়ে। কারণ, ঘাস বা শনের দড়ি দু- মণ ওজনের চড়স সারাদিন ধরে তোলা এবং নামানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্ত নয়। তা ছাড়াও বার বার জলে ডোবার ফলে ঘাস বা শনের দড়ি তাড়াতাড়ি পচে যাবে। তাই চড়সের দড়ি সব সময় চামড়ার লম্বা লম্বা পট্টি জুড়ে বানানো হয়। এবং ইঁদুরের নাগালের বাইরে নিরাপদ স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সাবধানে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে একটি লাব পনেরো থেকে কুড়ি বছর জল তুলতে পারে।
বরত লাবের আর একটি প্রতিশব্দ। এটি তৈরি হয় মোষের চামড়া দিয়ে। মরুভূমিতে গরু, বলদ বা উট থাকলেও মোষ বেশি নেই, তাই একসময়ে পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে মোষের চামড়া এখানে নিয়ে আসা হত। যোধপুর, ফলৌদি, বিকানের প্রভৃতি শহরে চামড়ার জন্য বাজারও বসত। কোথাও কোথাও অবশ্য চড়সের বদলে ব্যবহার হত কোস। এগুলি উট কিংবা বলদের চামড়ায় তৈরি।
গভীরতা কম, অথচ জল ভালই পাওয়া যায় – এরকম কুয়োতে জল তুলতে চড়স বা কোসের বদলে সুণ্ডিয়া কাজে লাগে। এটি অবশ্য আলাদা কিছুই না, বিশেষ এক ধরনের চড়সই, যা ওপরে ওঠার পর নিজে নিজেই খালি হয়ে যায়। সুণ্ডিয়াকে ওপরে তুলে আনে, আর দ্বিতীয়টা শুঁড়ে বাঁধার জন্য একটু পাতলা দড়ি। কুয়োর ভেতরে যাওয়ার সময় শুঁড়ের ওই মুখ ভাঁজ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। জল ভরে ওপরে ওঠার সময়ও সেটা বন্ধ থাকে। কিন্তু ওপরে উঠে এলেই মুখ খুলে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জল খালি হয়ে যায় l
যে কুয়োতে সুণ্ডিয়া জল তোলে, সেই কুয়োতে দুটো চরকি লাগানো হয়। ওপরেরটা হল ভুন। সেটার চার হাত নীচে সুণ্ডিয়ার শুঁড় খোলার জন্য লাগানো হয় আরেকটা চরকি, যার নাম গিড়গিড়। ভুন যেহেতু পুরো ওজনটাই টেনে তোলে, তাই তার চেহারা হয় চাকার মতো। আর গিড়গিড়ি যেহেতু হালকা কাজই করে, তাই সেটি হয় বেলনাকৃতি।
নাম আর কাজের তালিকা শেষ-ই হতে চায় না। সুণ্ডিয়ার বড় যে মুখটা লোহার তার বা বাবলা কাঠ দিয়ে বাঁধা হয়, তার নাম পাঁজর। পাঁজরের সঙ্গে সুণ্ডিয়ার চামড়া বাঁধা হয় কসন দিয়ে। মুখটা খোলা রাখার জন্য যে চৌকো কাঠ লাগানো হয়, তাকে বলে কলতরু। কলতরুকে মুখ্য দড়ি অর্থাত্ বরতের সঙ্গে বাঁধে আরো একটি দড়ি। এই দড়ির নাম তোড়ক। লাবের এক দিকে বাঁধা থাকে এইগুলি, অন্যদিকে থাকে জোড়া বলদ। চড়স টানার জন্য বলদ জোড়ার কাঁধে জোয়ালের মতো যা বাঁধা থাকে তা হল পিঁজরো। পিঁজরো দিয়ে বলদ দুটির কাঁধ আটকানো হয়। পিঁজরোতে চার ধরনের কাঠ লাগানো থাকে। চারটির প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। ওপরে লম্বালম্বি যে কাঠিটি থাকে, সেটি হল কোকরা। নীচের হালকা কাঠটিকে বলা হয় ফট। চওড়ার দিকে লাগানো প্রথম দুটো পাট্টির নাম গাটা এবং ভেতরের দুটোর নাম ধুসর।
আজকাল কোনো কোনো জায়গায় কুয়োতে বৈদ্যুতিক এবং ডিজেল পাম্প লাগানোর ফলে এই সমস্ত নাম ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন যুগের যন্ত্রগুলিতে চড়স অথবা কোসের মিতব্যয়িতা নেই। অনেক পুরনো সাঠি অথবা চৌতিনো কুয়োতেই আজকাল বলদের বদলে ঘোড়ার সাহায্যে, অর্থাত্ হর্স পাওয়ারের পাম্পের সাহায্যে জল তোলা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে পুরোনো ও নতুন কয়েকটি এলাকায় জল সরবরাহের কিছু পাইপ বসানো হয়েছে। তবে পাইপগুলোরও জলের উত্স সেই ষাঠি অথবা চৌতিনো কুয়োতে বসানো অশ্বশক্তির পাম্প। অর্থাত্ জলের পাইপগুলো শুধু দেখতেই নতুন, আসলে তাদের ভেতর দিয়ে আজও রাজস্থানের সেই পুরোনো ঐতিহ্যই প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কোথাও কোথাও এই ঐতিহ্য আজ ভেঙেও পড়েছে। সব থেকে দুঃখজনক উদাহরণটি হল যোধপুর জেলার ফলৌদি শহরে শেঠ সাঙ্গিদাসজির নামাঙ্কিত ষাঠি কুয়োটি। এটি শুধুমাত্র একটি কুয়োই নয়, বরং স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
পাথরের সুন্দর আটকোণা কুয়ো, তার মধ্যে লম্বা বারান্দার মতো চারটি বাহু চারদিকে বিস্তৃত। চারটি বারান্দাতেই চারটি ছোট ছোট কোণা এবং সেই সঙ্গে জোড়া আরও চারটি বড়, গভীর ঘর। প্রতিটি ঘরের বাইরে পশুদের জল খাওয়ার জন্য সুন্দর খেলিও করা। সব রকম উচ্চতার পশুই যাতে এখানে জল খেতে পারে, সে রকম ব্যবস্থা ছিল। চারটি বারান্দার চারদিক থেকে বেরিয়েছে চারটি সারণ, যাতে চারদিকে চারজোড়া বলদ একই সঙ্গে কোস নিয়ে জল টেনে তোলার হোড় করত।
উনবিংশ শতাব্দীর এই ষাঠি কুয়োটি বিংশ শতাব্দীরও অর্ধেক সময় পার করে ফেলেছিল. ঊনিশশো ছাপান্ন সালে সাঙ্গিদাসজির পরিবারের হাত থেকে এটি পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে আসে। চার সারণে বলদের দৌড়ানো স্তব্ধ হয়ে যায় l সুন্দর কুয়োর ঠিক ওপরে বিকট একটা ঘর বানানো হল, বিদ্যুত্ এল তিনশো পাঁচ ফুট গভীরে পনেরো অশ্ব শক্তির পাম্পও বসল l কুয়োতে অথৈ জল l শহরে বিদ্যুত্ থাকলে চব্বিশ ঘণ্টাই পাম্প চলত, দিন-রাত প্রতি ঘণ্টায় হাজার গ্যালন জল উঠে আসত l এরপর পাম্পে মোটরের শক্তি পনেরো থেকে বাড়িয়ে পঁচিশ হর্স পাওয়ার করা হল l কুয়ো পরিষ্কার করা বন্ধ হল l শুধু জল তোলা হতে লাগল। ক্রমে দেখা গেল জল কিছুটা কমে গেছে l এটা ছিল কুয়োর সংকেত – জল তো পুরো নিচ্ছ, কিন্তু দেখাশোনাও যে করা দরকার, তা কিন্তু ভুলে গেছ l পৌরসভা সংকেতের অর্থ করল অন্য রকম l আরও সত্তর ফিট বোরিং করা হল l তিনশো হাত কুয়োতে যোগ হল আরও সত্তর ফিট l উনিশশো নব্বই সাল আসতে আসতে কুয়ো ক্লান্ত হয়ে পড়ল l তবুও সে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহে আরও চার বছর শহরের সেবা চালিয়ে গেল l শেষে উনিশশো চুরানব্বই -এর মার্চ মাসে সাঙ্গিদাসজির কুয়ো জবাব দিল l
আজও এতে জল আছে l কিন্তু পরিষ্কার না করানোর ফলে ভূগর্ভে জলস্রোতের উত্সগুলির সাথে সংযোগ বুঝে গেছে l পরিষ্কার করতে ওই পাতালে কে নামবে? যে শহরে এমন সুগভীর কুয়ো খোঁড়ার কিনিয়া পাওয়া যেত, তা পাথর দিয়ে বাধার গজধর পাওয়া যেত, আজ সেখানে পৌরসভা তা পরিষ্কার করানোর লোক খুঁজে পাচ্ছে না l
অথচ বিকানের শহরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি সুবিশাল চৌতিনা কুয়ো আজও যে শুধু মিষ্টি জল দিয়ে চলেছে, তাই-ই নয়, এই কুয়োর স্থাপত্যের মধ্যেই পৌরসভার সদর দপ্তর রয়েছে, সেখানে আছে পাশের পাড়ার বিদ্যুতের বিল, জলকর আদায় হচ্ছে, এমনকী জল সরবরাহ দপ্তরের কর্মচারী ইউনিয়নেরও কাজ চলছে। আগে চার সারণে আট জোড়া বলদ জল তুলত l এখন বড় বড় বৈদ্যুতিক পাম্প বসেছে, দিন রাত জল তোলা হচ্ছে, তবুও চৌতিনো কুয়ো অথৈ l সব সময়ই কুড়ি-পঁচিশটা সাইকেল, স্কুটার ও মোটরগাড়ি কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় l সমস্ত কিছুকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়োটি কাছে এবং দূরে যেকোন জায়গা থেকেই সামন্য কুয়ো মাত্র মনে হয় না, বরং কোনো ছোট সুন্দর রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড অথবা মহলের মতো মনে হয় l
এখানে এ,রকম একটা নয়, অনেক কুয়ো আছে। আর, শুধু এখানেই নয়, অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায় এরকম কুয়ো, কুঁই, কুণ্ড এবং টাঁকা l পুকুর আছে, বাওড়ি আছে, পাগবাও, নাডি, খডিন, দই বাঁধ স্থান, ভে সবই আছে, যেগুলিতে বৃষ্টির রজত বিন্দুগুলিকে সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থা অমলিন l মাটি, জল ও তাপের তপস্বী এই দেশ প্রবাহিত এবং স্থির দুরকম জলকেই নির্মল করে রেখেছে l পালর পানি, রেজানি পানি এবং পাতাল পানির প্রতিটি বিন্দুই এদের কাছে সিন্ধু সমান, ইন্দ্রের এক মুহূর্তকে এরা নিজেদের জন্য বারো মাসে রূপান্তরিত করে নিয়েছে l
সুদূর অতীতের আদিগন্ত ঢেউ তোলা অখণ্ড সমুদ্র আজো এখানে খণ্ড খণ্ড হয়ে মাটিতে নেমে আসে l
Path Alias
/articles/bhaunaera-baaraomaasa
Post By: Hindi