ভিত থেকে শিখর পর্যন্ত


পশ্চিমবঙ্গে পুকুরের জায়গা নির্বাচন ও আগৌরের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে l এখানে পুকুরের জায়গা নির্বাচন হয় আগৌর, আগাড় বা গড়ানে বয়ে আসা জল জমা হতে পারে এমন জায়গায় l কখনও কখনও যার একদিক বা দুদিক বেঁধেই হয়ে ওঠে বড়সড় বাঁধ(এই অঞ্চলে পুকুরের তুলনায় বাঁধেরই প্রচলন বেশী) অবশ্য বর্তমানে বড় বড় ভালো বাঁধগুলির আর আগৌর অবশিষ্ট নেই l ফলে বাঁধগুলি ধীরে ধীরে গুটিয়ে ছোট হয়ে আসছে l

আজ উত্থান একাদশী l দেবতারা জেগেছেন l এখন ভাল কাজ করার জন্য শুভ মুহূর্ত বেছে নেওয়ার বা কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই l তবুও একে অন্যের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করছে, পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করছে, একটা নতুন পুকুর তৈরী হেব যে...

পাঠকের মনে হতে পারে এখন তারা পুকুর তৈরীর পাড় থেকে শুরু করে জল ভরে ওঠা পর্যন্ত সমস্ত বিবরণ পাবেন l আমরা নিজেরাও এরকম বিবরণ অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি l যেখানে বহুকাল ধরে পুকুর তৈরী হয়েছে এবং হাজার হাজার হয়েছে, সেখানে পুকুর তৈরীর বিবরণ না থাকাটা আশ্চর্য লাগতে পারে l কিন্তু এই পরিস্থিতিটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি l কেননা, তখন চারিদিকে ‘পুকুর কিভাবে করতে হয়’ – এর বদলে ‘পুকুর এইভাবে করতে হয়’-এর প্রচলন ছিলো l তবুও বিবরণের ছোট ছোট আংশগুলোকে জোড়া দিলে খুব সুন্দর না হোক একটা কাজ চালানোর মতো একটা ছবি সামনে ফুটে উঠতে পারে l

আজ উত্থান একাদশী l জিজ্ঞাসা করার আর কী-ই বা আছে l সমস্ত কথাবার্তা তো আগেই সারা l পুকুরের জায়গাও ঠিক হয়ে গেছে l যাঁরা এসব ঠিকঠাক করেছেন তাঁদের চোখের সামনে কত বর্ষাই না বর্ষিত হয়েছে l তাই সেখানে এ প্রশ্ন ওঠে না যে জল কোথা থেকে আসবে, কত জল আসবে, তার কত ভাগ কোথায় আটকাতে হবে ? এগুলো কোন সমস্যাই নয় l খুব সাধারণ কথা l হাতের তালুর মতো পরিচিত l এদের মধ্যে অনেক চোখই এর আগেও অনেক পুকুর খুঁড়েছেন এবং এমন কিছু চোখ রয়েছে যাঁরা বংশানুক্রমে এই কাজ করে চলেছেন l সাধারণভাবে দশ দিকই খোলা রয়েছে পুকুর করার জন্য l তবুও জায়গা নির্বাচনের সময় কয়েকটা কথা খেয়াল রাখতে হবে l গোচারণভূমির দিকে হবে এই জায়গা, ঢালু ও নীচু জমি, যেখান থেকে জল গড়িয়ে আসবে সেখানের মাটি হবে কাঁকুরে, সেদিকে সৌচকার্য প্রভৃতির কাজে মানুষ যায় না, মরা জন্তু জানোয়ার ফেলার জায়গা অর্থাত ভাগাড়ও সেদিকে নেই l

অভ্যাস থেকে অভ্যাস বাড়ে l অভ্যস্থ চোখ কথাবার্তায় শোনা, নির্বাচিত জায়গা একবার দেখেও নেয় l সেখানে পৌঁছে ‘আগৌর’১(যেখান থেকে জল আসবে) পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করে নেওয়া হয় l ‘আগর’ (যেখানে জল আসবে) তার স্বভাব পরখ করে দেখা হয় l পাড় কতটা উঁচু হবে কতটা চওড়া, কোনখান থেকে কতটা বাঁধা হবে, পুকুরে জল ভরে যাওয়ার পর তাকে রক্ষা করার জন্য কোথায় ‘অপরা’ তৈরী হবে তাও আন্দাজ করে নেওয়া হয় l

সকলেই এসে পৌঁছেছে l আর দেরী নয় l ঝকঝকে থালা সেজে উঠেছে l সূর্যের কিরণে তা আরও ঝলমল করছে l জলপূর্ণ ঘটি রয়েছে l রোলী, মোলী, হলুদ, আতপ চালের সঙ্গে রাখা হয়েছে লাল মাটির একটি ঢেলা l ভূমি ও জলের স্তুতিমন্ত্র ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে তরঙ্গে l


যেখানে বহুকাল ধরে পুকুর তৈরী হয়েছে এবং হাজার হাজার হয়েছে, সেখানে পুকুর তৈরীর বিবরণ না থাকাটা আশ্চর্য লাগতে পারে l কিন্তু এই পরিস্থিতিটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি l কেননা, তখন চারিদিকে ‘পুকুর কিভাবে করতে হয়‘’ – এর বদলে ‘পুকুর এইভাবে করতে হয়’-এর প্রচলন ছিলো l-

বরুণ দেবতাকে স্মরণ করা চলছে l দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পুকুর যেখানেই খোঁড়া হোক সমস্ত নদীকেই ডাকা হয় l মাটিতে টামনা মারার শব্দে মন্ত্রের তরঙ্গ থামে l পাঁচ জন পাঁচ পরাত মাটি কাটে l দশ হাত পরাত তুলে পাড়ে ঢালে l এখানেই পাড় বাঁধা হবে l গুড় বিলি করা হয় l শুভ মুহূর্তের অর্চনা শেষ l পুকুরের যে ছবি মনে রয়েছে, টামনা দিয়ে তার পুরো চিত্র মাটিতে এঁকে নেওয়া হয়েছে l কোনখান থেকে মাটি তোলা হবে l কোথায় ফেলা হবে l পাড় থেকে কত দূরে খোঁড়া হবে , যাতে পাড়ের ঠিক নীচেই বেশী গভীর না হয়ে যায় l পাড়ের নীচে বেশী গভীর হলে জলের চাপে পাড় দুর্বল হতে থাকবে ... l

এই একাদশীতে এতটা হয়েই যায় l কিন্তু কোন কারণে যদি এদিন কাজ শুরু না করা যায় তাহলে আবার শুভ মুহূর্ত বার করতে হবে বা কউকে দিয়ে বার করাতে হবে l শহরে বা গ্রামে ঘরে ঘরে যে পাঁজি পাওয়া যায় তাতেও অনেক কিছুর তিথি বা শুভ মুহূর্তের সঙ্গে কুয়ো, বাউড়ি ও পুকুর তৈরীরও শুভ মুহূর্ত দেওয়া থাকে- উত্তরা, শতভিষা, মঘা, রোহিণী, মৃগশিরা, পূষ্যা ও মূলা নক্ষত্রতে সোমবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে কাজ আরম্ভ করা যায় l কিন্তু চতুর্থী, নবমী ও চতুর্দশী তিথিগুলি ত্যাগ করতে হবে l আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষই এই বিবরণের শুধুমাত্র কয়েকটা দিনের নামই বুঝতে পরবেন l কিন্তু এখনও সমাজে একটা বড় অংশের মনের ঘড়ি এই ঘড়ির সঙ্গেই মেলে l কিছুদিন আগে তো গোটা সমাজটাই এই ঘড়িতে চলতো l

...শুভ মুহূর্তের অর্চনা শেষ l সকলে ঘরে ফিরছে l এবার কিছুদিন পর যেদিন সকলের সুবিধে সেদিন কাজ শুরু হবে l অভ্যস্থ দৃষ্টি এর মাঝে পলক ফেলে না l কত বড় পুকুর, কত সরঞ্জাম, কত মাটি খোঁড়া হবে, পাড়ে কত মাটি দেওয়া হবে, ঝড়া, বাঁক, হাত ঝড়াতেই মাটি বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, নাকি গাধাও লাগবে ? ঢেউয়ের মতো প্রশ্ন ওঠে l কত কাজ কাঁচা হবে-মাটির, কত পাকা-চুনের l মাটির কাঁচা কাজ পাকাপাকি ভাবে করতে হবে আবার পাথর ও চুনের পাকা কাজ যেন কাঁচা না থেকে যায় l প্রশ্নের ঢেউ যেমন ওঠে অভ্যস্থ মনের গভীরতায় তা শান্তও হয়ে যায় l সহস্র মণ মাটির ওজনদার কাজ l বয়ে যাওয়া জলকে দাঁড়ানোর জন্য রাজি করাতে হবে l জলের সভ্গে খেলা, হ্যাঁ, আগুনের সভ্গে খেলা l

ডুগডুগি বাজে l গোটা গ্রামই পুকুরের জায়গায় জড়ো হয় l পুকুরের কাজ ‘আমানি’তে চলবে l আমানি অর্থাত সকলে একই সঙ্গে কাজে আসবে ও একই সঙ্গে কাজ থেকে ফিরবে l

শত শত হাত মাটি কাটে, শত শত হাত পাড়ে মাটি ঢালে l আস্তে আস্তে প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হয় l একটা ধাপ ভরে উঠেছে দেখা যায় l এবারে আলগা মাটি চেপে বসিয়ে দেওয়ার পালা l এই কাজ করে ‘নন্দী’ l চার ধারালো খুরে ষাঁড়ের পুরো ওজন পড়ে l প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় দফার মাটি ঢালা শুরু হয় l প্রত্যেক ধাপেই জল ছড়ানো হয়, ষাঁড় চালানো হয় l শত শত হাত তত্পরতার সঙ্গে কাজ করে l প্রতিটি ধাপ খুবই ধৈর্যের সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে l

এতক্ষণ পর্যন্ত যা কোদালের অস্পষ্ট রেখা ছিলো, এখন সেখানে মাটি খোঁড়ার চিহ্ন স্পষ্ট l কোথাও তা সোজা তো কোথাও এঁকে বেঁকে চলা নদীর মতো l আগর থেকে আসা জল পাড়ের যেখানে নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে পারে সেখানে পাড়ও সেই মতো মজবুত করা হয় l এই অংশটিকে ‘কোহনী’ বলে l পাড় এখানে ঠিক আমাদের কোনুই-এর মতো মুড়ে যায় l

পুকুরের জায়গা ঘরের কাছে হলে, খাবার জন্য সকলে ঘরে যায় l আবার দূরে হলে খাবার আসে l ওখানে অবশ্য সারাদিনই সকলকে গুড় দোওয়া মিষ্টি জল খাওয়ানো হয় l জলের কাজ ভালোবাসার কাজ, পূণ্যের কাজ, তাই অমৃতের মতো মিষ্টি জল খাওয়াতে হয় l তবে না অমৃতের মতো মিষ্টি সরোবর হবে l

এই অমৃত সর-কে রক্ষা করবে পাড় l সে পুকুরের পালক l তবে পাড় নীচে কতটা চওড়া হবে, ওপরে কতটা, কতটা উঁচু হবে- এ ধরণের প্রশ্ন গণিত বা বিজ্ঞানের বোঝা বাড়ায় না l তবে অভ্যস্থ চোখের সহজ গণিতকে যদি কেউ মাপতেই চায় তো ভীতের চওড়ার অর্ধেক হবে উঁচু , আর পুরো উচ্চতার অর্ধেক হবে ওপরের চওড়া l

মাটির কাঁচা কাজ হয়ে এসেছে l এবার পাকা কাজের পালা l চুনকরদের চুন ভড়কানো শেষ l গরট প্রস্তুত l এবার গারা তৈরী হচ্ছে l পাথর কাটার দল পাথর কাটতে ব্যস্ত l রক্ষক পাড়কে ভাঙ্গন থেকে বাঁচাতে নেষ্টা তৈরী করতে হবে l নেষ্টা হল পুকুরের সেই অঙ্গ যেখান থেকে অরিরিক্ত জল পাড়ের ক্ষতি না করে বয়ে যাবে l কখনো হয়তো এই শব্দটা ‘নিসৃষ্ট’, ‘নিস্তরণ’ অথবা ‘নিস্তার’ ছিল l পুকুর প্রস্তুত কারকদের মুখে মুখে ব্যবহার হতে হতে কেটে ছেঁটে ‘নেষ্টা’ রূপে এমন মজবুত হয়ে গেছে যে কয়েকশো বছরে এর একটা মাত্রাও আর খুলে পড়ে নি l

নেষ্টা পাড়ের উচ্চতার কিছুটা নীচে হবে, তবেই না পাড় ভেঙ্গে ফেলার আগেই জল বয়ে যাবে l মাটি থেকে এর উচ্চতা পাড়ের উচ্চতার অনুপাতে হয় l যেমন- দশ হাত ও সাত হাতের l

পাড় ও নেষ্টার কাজ শেষ l আর সেই সঙ্গেই শেষ হয় আগরের কাজও l আগৌরের সব জল গড়িয়ে এসে আগরে পড়বে l অভ্যস্থ চোখ আরো একবার আগৌর ও আগর পরীক্ষা করে নেয় l আগরের ক্ষমতা আগৌর থেকে আসা জলের ক্ষমতা থেকে বেশী অথবা কম নয়তো ? উত্তর অবশ্য কখনোই হ্যাঁ হয় না l

শেষবারের মতো ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে l কাজ শেষ হয়ে গেছে, তবুও আজ সকলে পুকুর পাড়ে জড়ো হবে l একাদশীর দিন যে সংকল্প নেওয়া হয়েছিল আজ তা পূর্ণ l শুধু আগৌরের স্তম্ভ ও ঘাটে ঘাটেয়াবাবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা বাকি l আগৌরের স্তম্ভের উপরে গণেশজী বিরাজ করেন ও নীচে সর্পরাজ l ধাটেয়াবাবা ঘাটে বসে পুরো পুকুর রক্ষা করবেন l

আজ সকলের একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে l সুন্দর মজবুত পাড় ঘেরা পুকুর l দূর থেকে দেখতে লাগছে যেন বড় একটা থালা l যে পরিচয়হীন লোকেরা এটি তৈরী করেছেন, প্রসাদ বিতরণ করে তাঁরা এর একটি সুন্দর নামও দেবেন l আর সেই নাম কোন কাগজে নয়, লেখা হয়ে থাকবে মানুষের হৃদয়ে l তবে নামের সঙ্গেই কাজ শেষ নয়, এরপর যখনই হস্তা নক্ষত্র উঠবে জলের প্রথম ধারা পড়বে, সকলে মিলে আবার পুকুরে জড়ো হবে l অভ্যস্থ চোখতো আজই কষ্টি পাথরে যাচাই হবে l

সকলে কোদাল, টামনা, বাঁশ, লাঠি নিয়ে পাড়ে ঘুরছে l এতো যত্নের সঙ্গে এক এক ধাপে গড়ে ওঠা পাড়ও বর্ষার প্রথম জল না খেলে মজবুত হয় না l যেকোন জায়গাই ধ্বসে পড়তে পারে l আর ইঁদুরের গর্ত করতেই বা কতক্ষণ লাগে l পুকুরে যাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাঁশ দিয়ে, লাঠি দিয়ে তাঁরা এই গর্তগুলোই বন্ধ করছেন l

গত দিনগুলিতে যেমন ধীরে ধীরে পাড় উঠেছিল, আজ তেমন আগরে জল উঠছে l জল আজ পুরো আগৌর থেকে একটু একটু করে গড়িয়ে নেমে আসছে l

সিমট-সিমট জল ভঁর তলাওয়া
জিমী সদগুণ সজ্জন পহিঁ আওয়া l


খ্যাতিহীন পরিচয়হীন হাতের ভালোবাসা জল স্বীকার করে নেয় l

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishraa in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bundelkhand, Tanks in Rajasthan, Simple living and High Thinking, Honest society, Role Models for Water Conservation and management, Experts in tank making techniques

Path Alias

/articles/bhaita-thaekae-saikhara-parayanata

Post By: Hindi
×