আমরা কি তাহলে 25 কোটি ধনী ও মধ্যবিত্তের বিলাসবহুল ভোগবাদকে বাড়াতে পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করে যাব, আর সাধারণ চাষীর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলব ? আর আমরা ভবিষ্যত বংশধরদের বাঁচার অধিকারকে কেড়ে নেব পরমাণু বর্জ্যের পাহাড় জমা রেখে? এইসব প্রশ্ন আজ ভাবার সময় হয়েছে, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে আজ এই কথা ভাবতে হবে এবং রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামতে হবে।
সুইজারল্যান্ড সরকার জানিয়েছে তারা আর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করবে না। যেগুলি আছে সেগুলিও ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেবে।তাইওয়ানের বিরোধী বিধায়করা তাদের পার্লামেণ্টে বিল আনছে দেশকে তারা পরমাণু মুক্ত চায়। চীন সরকার ফুকুসিমা দুর্ঘটনার পর তাদের পরমাণু কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে।
জাপান সরকার স্থির করেছে যে তাদের সমস্ত পরমাণু কেন্দ্রই বন্ধ করে দেবে।
1970 এর দশকে বিভিন্ন দেশে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপনের এক জোয়ার এসেছিল। সেই জোয়ারে পরমাণু বিদ্যুত উত্পাদন বেড়েছিল 700 শতাংশ। 80 -এর দশকে এসে সেই বৃদ্ধির হার হয় 140 শতাংশ। 90 -এর দশকে তা আরও কমে এবং হয় মাত্র 5 শতাংশ। প্রথম কারণ পরমাণু বিদ্যুতের খরচ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
1972 সালে আমেরিকায় পরমাণু বিদ্যুত উত্পাদনের খরচ ছিল প্রতি কিলোওয়াট ( KW ) 200 ডলার। 1975 সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় 750 ডলার। 1980 সালে তা হয় 1900 ডলার। 1985 সালে আরও বাড়ে এবং হয় 3000 ডলার, 1987 সালে আবার বেড়ে তা হয় 3500 ডলার। 1996 সালের পর আমেরিকার 5টি পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ বলে। 1985 সালের 11 ফেব্রুয়ারি আমেরিকার বিখ্যাত ব্যবসা সংক্রান্ত পত্রিকা ফোর্বস -এ জেমস বুক লিখেছিলেন, মার্কিন পরমানু শক্তির কর্মসূচীর ব্যর্থতা বাণিজ্যের ইতিহাসে সর্ববৃহত ব্যবস্থাপনার বিপর্যয়। এ এমনই বিপর্যয় যার ক্ষতির পরিমাণ গগনচুম্বী। এ হল মার্কিন ক্রেতার পরাজয় ... । ঝুঁকির দিক চিহ্নিত না করে মার্কিন বিদ্যুত শিল্প যে দায় নিয়েছিল তা মহাকাশ কর্মসূচী কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও খরচ সাপেক্ষ। এইসব নানা কারণে বিভিন্ন দেশে আর নতুন করে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন বন্ধ করে দিয়েছে। চীনও ভাবছে। কিন্তু মজার কথা হল ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তির এ ব্যাপারে কোনও প্রকার ভাবনাচিন্তা নেই। তারা পরিকল্পনা নিয়েছে যে 2020 সালের মধ্যে ভারত 40000 মেগাওয়াট নতুন পরমাণু বিদ্যুত উত্পাদন করবে। এই তুঘলকি ও বিধ্বংসী পরিকল্পনা একমাত্র সাধারণ মানুষ এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞানীরাই বন্ধ করতে পারবে। বন্ধ করতে হবে তাদের দুর্বার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, যেমন করছে কড়ানকুলাম, জয়িতাপুর বা হরিয়ানার মানুষ।
কাদের জন্য এত বিদ্যুতের প্রয়োজন?
ভারতের বিভিন্ন শহরে গত 10 - 15 বছরে গজিয়ে ওঠা ঝাঁ - চকচকে শপিং মল দেখলে এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনীদের আবাসগৃহে এয়ার কন্ডিশনার দেখলে বোঝা যায় কেন এত শক্তির প্রয়োজন। কয়েকদিন আগে বোম্বেতে গিয়েছিলাম। সেখানে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীর এক বহুতল বাসগৃহ আছে। সেখানে দেখলাম সেই একটি গৃহে যে পরিমান বিদ্যুত ব্যবহার হয় তাতে 10 টিরও বেশি গ্রামকে আলোকিত করা যায়। শুনলাম যে ওই গৃহে উনি নাকি সবসময় থাকেন না, কদাচিত বাস করেন। 1947 সালে ভারতে মাত্র 1400 মেঘাওয়াট বিদ্যুত উত্পাদিত হত। সেখানে আজ 2 লক্ষ মেঘাওয়াটের বেশি বিদ্যুত উত্পন্ন হয়। অথচ 2008 সালে ভারতের 112 কোটি মানুষের মধ্যে 80 কোটি মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছায়নি। তাহলে কোথায় গেল এই বিদ্যুত ? ওই বিদ্যুত গিয়েছে ভারতে 4 কোটি ধনী ও 21 কোটি উচ্চ মধ্যবিত্তের ভোগে। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ খুব কম জিনিস ব্যবহার করে। 2008 সালে ভারতের অর্থ মন্ত্রীর দেওয়া এক হিসেব অনুসারে 83 শতাংশ মানুষ দিনে মাত্র 20 টাকা খরচ করে। তার একমাত্র কারণ ভারতের দারিদ্র্য।
আমরা কি তাহলে 25 কোটি ধনী ও মধ্যবিত্তের বিলাসবহুল ভোগবাদকে বাড়াতে পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করে যাব, আর সাধারণ চাষীর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলব? আর আমরা ভবিষ্যত বংশধরদের বাঁচার অধিকারকে কেড়ে নেব পরমাণু বর্জ্যের পাহাড় জমা রেখে? এইসব প্রশ্ন আজ ভাবার সময় হয়েছে, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে আজ এই কথা ভাবতে হবে এবং রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নামতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়েই আজ নবীকরণযোগ্য শক্তি উত্পাদনে (Renewable energy) উত্সাহ বেড়ে চলেছে। 2011 সালে নবীকরণযোগ্য শক্তি উত্পাদনে লগ্নি হয়েছিল ছাব্বিশ হাজার (26000) কোটি ডলার। 2004 সালের তুলনায় 5 গুণ বেশি। ঐ সময়ের মধ্যে নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ হয়েছে এক লক্ষ (100000) কোটি ডলার। সেখানে পরমাণু শক্তিতে লগ্নী হয়েছে বারো হাজার (12000) কোটি ডলার। 2011 সালে সারা বিশ্বে পারমাণবিক বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা 41 গিগাওয়াট বেড়েছে। চীনে বায়ু এবং সৌরশক্তির উত্পাদন গত পাঁচ বছরে 50 গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে পারমাণবিক শক্তি বেড়েছে মাত্র 1.5 গুণ। 2000 সালের পর ইউনিয়নে পারমাণবিক শক্তির উত্পাদন কমেছে 14 গিগাওয়াট। অন্যদিকে নূতন নবীকরণযোগ্য 142 গিগাওয়াটের শক্তি কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে হয়েছে 116 গিগাওয়াট শক্তিকেন্দ্র।
এই সর্বপ্রথম জার্মানীতে নবীকরণযোগ্য শক্তির সর্ব মোট উত্পাদন ক্ষমতা লিগনাইটের পরেই এসে দাড়িয়েছে এবং তা কয়লা ও পারমাণবিক শক্তির চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। জার্মানীর নবীকরণযোগ্য শক্তির উত্পাদন ক্ষমতা এখন মোট শক্তির প্রায় 29 শতাংশ যা ফ্রান্সের 29 শতাংশ পারমাণবিক শক্তির সমান।
2012 সালের World Nuclear Energy Status Report অনুসারে ‘‘The market for nuclear energy is shrinking year by year, while renewable energy deployment continues at pace and in an ever increasing number of countries. With nuclear power becoming more expensive than a wide range of renewable energy technologies this trend will only continue,’’ ঐ রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে যে পারমাণবিক কেন্দ্রের পরমাণু বৃদ্ধি না করতে পারলে ( বর্তমানে যা 40 বছর ) পারমাণবিক বিদ্যুত শিল্পকে বাঁচানো যাবে না – কারণ বর্জ্য পদার্থের বিপদ ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুত উত্পাদনের জন্য সেই মান্ধাতা আমলের অচল বা বস্তাপচা টেকনোলজিই এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে । যদিও এই বস্তাপচা টেকনোলজি বাতিল করে দেওয়ার জন্য য জনমতের চাপ আসছে। কিন্তু যাঁরা পরমাণু বিদ্যুতকে বিপদ মুক্ত রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা কতদিন ধরে জনমতের এই চাপ উপেক্ষা করে যেতে পারবেন?
তাই সারা দুনিয়া যে পারমাণবিক বিদ্যুতকে বর্জন করার পথে যাত্রা শুরু করেছে সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একেবারে তার উল্টো পথে হেঁটে শুধু মুর্খামিরই পরিচয় দিচ্ছেন না, ভারতের কোটি কোটি মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছেন।
( জীবনের পরিবেশ, ১৬ই জুলাই ২০১২, গ্রীন সার্কল অফ ইন্ডিয়া, ৫২ / ডি / ৭ বাবু বাগান লেন কলিকাতা – ৩১)
Source: “JIBANER PARIBESH” Environment of Life, Monthly Magazine, 16th July 2012, Green Circle of India, 52 / D / 7 Babu Bagan Lane, Kolkata – 7000 031
( জীবনের পরিবেশ, ১৬ই জুলাই ২০১২, গ্রীন সার্কল অফ ইিন্ডিয়া, ৫২ / ডি / ৭ বাবু বাগান লেন কলিকাতা – ৩১)
Path Alias
/articles/bhaarata-o-paramaanau-baidayauta
Post By: Hindi