ভক্তিস্নাত হয়ে ঋষি-কবিরা বলেছেন, ‘বিন্দুতেই সিন্ধু’ l ঘর সংসারে ডুবে থাকা গৃহস্থ মানুষ প্রথমে হৃদয়ে এবং তারপর নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে এমনভাবে এই কথাটিকে বিকশিত করেছে, দেখে বিস্ময়ের অবধি থাকে না l
‘পালর পানি’ অর্থাত্ বর্ষার জলকে বরুণ দেবতার আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করা এবং এক বিন্দু, এক কণাও নষ্ট হতে না দেওয়া- এই মানসিকতায় যে শ্রদ্ধা, তা একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক, অন্য দিকে নিপাট সাংসারি l অবশ্য এছাড়া বিশাল মরুভূমিতে জীবন কীভাবেই বা সম্ভব?
‘পুর’ শব্দটি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, কিন্তু ‘কাপুর’ শব্দটি সম্ভবত শুধু রাজস্থানেই রয়েছে- অর্থ বুনিয়াদি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত গ্রাম l শব্দ ভাণ্ডারে শব্দটি মজুত থাকলেও, কোনো গ্রামকে যাতে কাপুর বলতে না পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থাও রাজস্থানের মানুষ যথাসম্ভব করেছে l
বঁধ - বধাঁ, তাল - তলাই, জোহড় - জোহড়ি, নাডি, তালাব, সরোবর, সর, ঝিল, দেইবাঁধজগহ, ডহরি, খডিন এবং ভে- এই সবকটিকেই বিন্দু বিন্দু করে ভরিয়ে যেন সিন্ধু সম করে তোলা হয়েছে l আজ আধুনিক সমাজ জল সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে যে স্থানটিকে ভেবেছে সমাধানের অতীত, পুরোন সমাজ সেই স্থানেই কোথায় কী কী করা সম্ভব- এই মানসিকতা থেকে কাজ করেছে l প্রভু এত দিয়ো, এই প্রার্থনার বদলে যতটা দাও তাতেই প্রয়োজন মিটিয়ে নেব- এমন দাবি করা বোধহয় তাদের পক্ষেই স্বাভাবিক l
মাটি ও আকাশের রূপ যেভাবে পাল্টায়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুকুরের চেহারা, আয়তন এবং নামও পাল্টে যেতে থাকে l চারিদিকে যদি কঠিন পাহাড় থাকে এবং বর্ষাও ভাল হয়, তাহলে সারা বছরের জন্যই শুধু নয়, বছরের পর বছর জল থাকবে- সে রকম বড় বড় ঝিল ও পুকুর তৈরি করা হয়েছে l সুবৃহত্ এই কাজগুলি শুধু যে রাজ পরিবারের উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল- এমন নয় l অনেক বিশাল আকৃতির পুকুর ও ঝিল-ই ভিল, বানজারা, পশুপালক সম্প্রদায়ের মানুষেরা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তৈরি করেছে l
অনেক ইতিহাসবিদ, যারা ইতিহাসবিদ হিসাবে নামী এবং যথেষ্ট দামীও তারা অনেকেই এই বৃহত কাজগুলিকে বেগার প্রথার সঙ্গে সংলগ্ন বলে দেখিয়েছেন l কিন্তু অপবাদ তো নিয়ম হতে পারে না l এর মধ্যে কিছু কাজ হয়েছে দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের সাহায্যার্থে- তাদের কাছে আনাজপাতি পৌঁছে দেবার জন্য, আর কিছু কাজ হয়, ভবিষ্যতে যদি আসে সেই দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য l তাছাড়াও আরও কিছু কাজ হয়েছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় l
যদি বয়ে আসা জল কম পাওয়া যায় এবং তা সংগ্রহ করে রাখার জায়গাও থাকে কম, তাহলেও কিন্তু সেই জায়গাটুকুও ছেড়ে দেওয়া হয় না l এখানে পুকুর পরিবারের সব থেকে ছোট সদস্যটির দেখা পাওয়া যাবে l তার নাম ‘নাডি’ l বালির ছোট পহাড় অথবা ছোট আগৌর থেকে বয়ে আসা জলও নষ্ট হতে দেয় না l নাডির নির্মাণ উপকরণগুলি সাধারণত কাঁচা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তার স্বভাব চরিত্রও সে রকম l এসব জায়গায় দুশো চারশো বছরের পুরোনো নাডিও পাওয়া যাবে l এতে এক দেড়মাস থেকে সাত আটমাস পর্যন্ত জল থাকে l খুব ছোট গ্রামেও একাধিক নাডি দেখতে পাওয়া যায় l বিস্তৃত মরুভূমির মাঝের গ্রামগুলিতে, গ্রাম পিছু দশ বারোটি করে নাডি রয়েছে l জয়সলমেরে পালিওয়ালদের ঐতিহাসিক চৌরাসি গ্রামে সাতশোরও বেশি নাডি তৈরি হয়েছিল l আজও নাডিগুলি অথবা যেগুলি নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেগুলি যে ছিলো তার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় l
তলাই বা জোহড় - জোহড়িতে নাডির থেকে কিছুদিন বেশি জল থাকে l জলের পরিমাণও তুলনামূলক ভাবে বেশি l এগুলিতে পাথর বাঁধানো ছোট ঘাট, জলে নামার জন্য পাঁচ সাতটা সিঁড়ি সহ মহলের মতো ছোট ইমারতও পাওয়া যেতে পারে l
আর কিছুই যেখানে হওয়া সম্ভব নয়- সেখানেও পাওয়া যায় তলাই l রাজস্থানের যেখানে যেখানে লবণাক্ত হ্রদ রয়েছে, সেখানে আশেপাশে বিস্তৃত এলাকার সমস্ত জমিই নোনতা l এখানে বৃষ্টির জল মাটিতে পড়া মাত্র লবণাক্ত হয়ে যায় l ‘পাতাল পানি’ অর্থাত ভৌমজল, মাটির ওপরে বইতে থাকা ‘পালর’পানি’ অর্থাত্ বর্ষার জল এবং এই দুইয়ের মাঝে থাকা ‘রেজানি পানি’ অর্থাত্ খড়িয়া পাথরের স্তরে আটকে পড়া জল- সবই নোনতা l এখানে যে নলকূপ ও হ্যাণ্ডপাম্পগুলি বসানো হয়েছে- তাতেও নোনা জলই উঠছে l অথচ এই জায়গাতেই চার পাঁচশো বছরের পুরোনো এমন তলাই পাওয়া যায়, যা সারা বছর ধরে মিষ্টি জল দেয় l এগুলির আগৌর লবণাক্ত জমি থেকে দু চার হাত উঁচুতে উঠিয়ে তৈরি করা এবং এই আগৌর থেকেই বৃষ্টির মিষ্টি জল তলাইগুলিতে সংগ্রহ করে নেওয়া হয় l
এ রকম অধিকাংশ তলাই-ই প্রায় চারশো বছরের পুরোনো l সে সময়টায় নুনের সমস্ত কাজ করত বাঞ্জারা সম্প্রদায় l তারা হাজার হাজার পশুর পাল নিয়ে নুনের কারবারে এই অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করত l রাস্তায় যে গ্রাম পড়ত তার বাইরের জমিতে তারা তাঁবু ফেলত l তাদের নিজেদের জন্য তো বটেই, পশুদের জন্যও জলের প্রয়োজন ছিল l বানজারারা খুব ভালোভাবে বুঝেছিল যে, নুনের স্বভাবই হচ্ছে জলের সঙ্গে গুলে যাওয়া। তারা জলের স্বভাবও জানত l জলও খুব দ্রুত নুনকে নিজের মধ্যে একাত্ম করে নেয় l কিন্তু দুইয়ের একাত্ম হওয়ার এই স্বভাব তারা কীরকম চাতুর্যের সঙ্গে আলাদা করতে জানত, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সম্বর হ্রদের সুবিশাল লবণাক্ত আগৌরের ভেতর কিছুটা ওপরে উঠিয়ে তৈরা করা বিভিন্ন তলাই l
বিংশ শতাব্দীতে যে যে সরকার এসেছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নিয়ে চলেছে যে সরকারী প্রশাসন- তাদের কেউই এই লবণাক্ত এলাকার গ্রামগুলির জন্য পানীয় জলের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি l কিন্তু বাঞ্জারারা তো এই গ্রামের নুন খেয়েছিল, তাই তারাই এই গ্রামগুলিকে মিষ্টি জল খাইয়েছে l কয়েক বছর আগে নতুন কিংবা পুরোনো সরকারী প্রশাসনও বাঞ্জারাদের তলাইগুলির কাছাকাছি ঠিক একই রকম তলাই নির্মাণের চেষ্টা করে, কিন্তু নুন ও জলের একাত্ম হয়ে যাওয়ার যে স্বভাব- তাকে তারা আলাদা করতে পারেনি l
জল যদি বেশি পাওয়া যায় এবং তা সংগ্রহ করে রাখার জায়গাও কিছুটা বেশি পাওয়া যায়, তাহলে আর এক ধাপ এগিয়ে তৈরি হবে ‘তালাব’ অর্থাত্ পুকুর l এতে বর্ষার জল আগামী বর্ষা পর্যন্ত ধরা থাকে l গতিশীল আধুনিক সভ্যতার অবদানে পুরোনো কিছু পুকুর অবশ্যই নষ্ট হয়েছে, তবুও সারা বছর পরিপূর্ণ থাকে এমন পুকুরের সংখ্যা আজও এখানে কম নয় l জন গণনার তথ্য সংগ্রহ করতে এসে সরকারী লোকেরা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারে না যে এখানে এত পুকুর রয়েছে l কারা এত পুকুর তৈরি করেছিল- সরকারী রিপোর্টে সে কথাটা পর্যন্ত উল্লেখ করতে ভয় পায় এই সব সরকারী লোকেরা l এখানে সমস্ত পরিকাঠামোই আসলে সমাজ তার আপন শক্তিতে গড়ে তুলেছিল l এ কাঠামো এতটাই মজবুত যে উপেক্ষা - অবহেলার দীর্ঘ সময় পার করে এসে আজও তা টিকে রয়েছে এবং সমাজকেও টিকিয়ে রেখেছে l
সরকারী গেজেটিয়রে জয়সলমের অঞ্চলের যে বর্ণনা, তা যথেষ্ট ভয়াবহ l এখানে একটাও নিত্যবহ নদী নেই, ভৌমজল একশো পঁচিশ থেকে দুশো পঞ্চাশ ফিট নীচে l কোথাও কোথাও তার গভীরতা চারশো ফিটেরও বেশি l বর্ষা অবিশ্বাস্যভাবে কম- মাত্র ষোলো দশমিক চার সে.মি. l বিগত সত্তর বছরের তথ্য অনুসারে, এ অঞ্চল বছরে তিনশো পঞ্চান্ন দিনই বৃষ্টিহীন l অর্থাত্ একশো কুড়ি দিনের বর্ষা ঋতু এখানে তার সংক্ষিপ্ততম রূপে, মাত্র দশ দিনের জন্যই আসে l
পরিসংখ্যানটি অবশ্য আধুনিকদের l মরুভূমির সমাজ তো এই দশ দিনের বর্ষায় কোটি কোটি রজত বিন্দু অনুভব করেছে এবং তাকে ঘরে, গ্রামে, শহরে- সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গায় সংগ্রহ করার কাজ চালিয়ে গেছে l যে তপস্যার ফলাফল দাঁড়িয়েছে নিম্নরূপঃজয়সলমের জেলায় আজ পাঁচশো পনেরোটি গ্রাম আছে l এর মধ্যে তিপ্পান্নটি গ্রামে কোনো না কোনো কারণে এখন আর বসতি নেই l বসতি রয়েছে চারশো বাষট্টিটি গ্রামে l এর মধ্যে মাত্র একটি বাদ দিলে বাকি প্রতিটি গ্রামেই পানীয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে l যে গ্রামগুলি উঠে গেছে, সেই গ্রামগুলোতেও এই ব্যবস্থা এখনও বহাল রয়েছে l সরকারি বিবরণ অনুযায়ী-ই, জয়সলমেরের শতকরা নিরানব্বই দশমিক সাত আট ভাগ গ্রামেই পুকুর, কুয়ো অথবা ‘অন্য’ কোন জলের উত্স বর্তমান l এর মধ্যে নলকূপ বা নলবাহিত সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই কম l এই সীমান্তবর্তী জেলার পাঁচশো পনেরোটি গ্রামের মধ্যে শতকরা কেবল এক দশমিক সাত পাঁচটি গ্রামে বিদ্যুত্ এসেছে l হিসেবের সুবিধার জন্য এই সংখ্যাটিকে শতকরা দুইও যদি ধরি তাহলেও দাঁড়ায় মাত্র এগারোটি গ্রাম l যেহেতু এই পরিসংখ্যান উনিশশো একানব্বই সালের, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে ইতিমধ্যে আরো কিছুটা উন্নতি হয়েছে - তাই এর সঙ্গে আরও কুড়ি তিরিশটা গ্রাম যোগ করে নেওয়া যাক; তবুও পাঁচশো পনেরোটির মধ্য বিদ্যুত্ সংযোগ আছে এমন গ্রামের সংখ্যা নগণ্যই থেকে যায় l এর অর্থ এখানে বেশিরভাগ গ্রামেই নলকূপ বিদ্যুত্ নয়, ডিজেলে চলে l তেল আসে বাইরে, অনেক দূর থেকে l তেলের ট্যাঙ্কার না এলে পাম্প চলবে না, জলও উঠবে না l সবকিছু ঠিকঠাক চললেও নলকূপগুলোতে আগে - পরে জলস্তর নেমেই যাবে, বাড়বে না l জলস্তরের অবস্থান একই গভীরতায় ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় আজও আবিষ্কার হয়নি l সাধারণভাবে বলা যায় যে জয়সলমেরে ভূ-জলের ভাণ্ডার ভালোই l কিন্তু ভাণ্ডে কিছুমাত্র জমা না দিয়ে শুধুই যে তুলে নেওয়ার প্রবৃত্তি – এতো এক দিন আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবেই l
আরও একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক, মরুভূমিতে ভয়াবহ বলে চিহ্নিত এই এলাকায় নিরানব্বই দশমিক সাত আট শতাংশ গ্রামেই পানীয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে এবং তা সম্ভব হয়েছে গ্রামের মানুষের নিজস্ব উদ্যোগেই l এর সঙ্গে তুলনা করা যাক, মানুষকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিতে দায়বদ্ধ যেসব সরকারী সংস্থাগুলি তাদের পরিসংখ্যান গুলির l এখনও পর্যন্ত মাত্র উনিশ শতাংশ গ্রাম পাকা রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে l ডাক ব্যবস্থার সুবিধা আছে ত্রিশ শতাংশ গ্রামে এবং চিকিত্সা ব্যবস্থা পৌঁছেছে মাত্র নয় শতাংশ গ্রামে l শিক্ষার প্রসার তুলনামূলক ভাবে কিছুটা ভাল l শতকরা পঞ্চাশ ভাগ গ্রামে এর বিস্তার l কিন্তু এখানে এ বিষয়টাও লক্ষ্য রাখা দরকার যে, ডাক, চিকিত্সা, শিক্ষা বা বিদ্যুতের সুবিধা পাওয়ার জন্য শুধু একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার প্রয়োজন, যেটা সরকারী কোষাগার থেকে ধার্য করাই থাকে l কম পড়লে অন্য কোন খাত বা অনুদান সূত্রে টাকার পরিমাণ বাড়ানোও যেতে পারে l তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই পরিসেবাগুলো এখনও যেন প্রতীক হিসেবেই রয়েছে l
জলের সমস্যা ও তার সমাধান কিন্তু এরকম নয় l এখানে প্রকৃতি থেকে যতটুকু জল পাওয়া যাবে সমাজ তাকে কোনোমতেই বাড়াতে পারে না l এখানে বাজেট একদম স্থির l যতটুকু পাওয়া যাবে, তাতেই কাজ চালাতে হবে l তবুও সমাজ এই কাজ বাস্তবে করে দেখিয়েছে l পাঁচশো পনেরোটি গ্রামে নাডি, তলাইয়ের সংখ্যা ছেড়েই দেওয়া যাক, বড় পুকুরের সংখ্যাই দুশো চুরানব্বইটি l
আধুনিক সমাজ যে স্থানটিকে হতাশাজনক বলে পরিত্যাগ করেছে, সেখানে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে ‘আসুতাল’ অর্থাত্ ‘আশার পুকুর’ রয়েছে l যেখানে তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রি সেণ্টিগ্রেড ছুঁয়ে যায় সেখানে রয়েছে ‘সিতলাই’ অর্থাত্ ‘শীতল পুকুর’ l আর বৃষ্টি যেখানে সবথেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করে, সেখানেও রয়েছে ‘বদরাসর’ l
চূড়ান্ত সাবধানতার সঙ্গে জল সংগ্রহ এবং বাস্তবসম্মতভাবে তার ব্যবহার এই মানসিকতাকে বুঝতেই পারেনি সমাজ ও প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা গেজেটিয়র l তারা এই মরুভূমিকে ‘জনহীন, বীভত্স, নিরানন্দ ও নিষ্প্রাণ’ বলে বর্ণনা করেছে l কিন্তু গেজেটিয়রে যারা এই কথা লিখেছিল, ‘ঘড়সিসরে’ পৌঁছালে তারাও ভুলে যায় যে তারা মরুভূমিতেই রয়েছে l
কাগজে পর্যটন - মানচিত্রে জয়সলমের যত বড় শহর প্রায় তত বড়ই পুকুর ঘড়সিসর l মানচিত্রে যেমন, বাস্তবের মরুভূমিতেও এরা পরস্পর সংলগ্ন হয়েই বিরাজ করছে l ঘড়সিসর ছাড়া জয়সলমের শহর গড়ে ওঠা সম্ভবই হত না l প্রায় আটশো বছরের পুরোনো এই শহরের, অন্তত সাতশো বছরের প্রতিটি দিন, এই ঘড়সিসরের এক একটি জলবিন্দুর সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছে l
বালির এক বিশাল টিলা সামনে দাঁড়িয়ে l কাছে গেলেও মনে হবে না যে, টিলা নয়; এ হল ঘড়সিসরের উঁচু এবং বিস্তৃত, লম্বা চওড়া একটি পাড় l কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা যাবে দুটো মিনার, পাথরের ওপর সুন্দর নকশা কাটা পাঁচটা জানালা এবং দুটো ছোট ও একটা বড় প্রবেশ দ্বার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে l বড় ও ছোট দ্বরের সামনে নীল আকাশ ঝকঝক করছে l পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে প্রবেশ দ্বার থেকে যতটা ধেখা যায়, তার সঙ্গে নতুন নতুন দৃশ্য যোগ হতে থাকে l এই পর্যন্ত পৌঁছেই বোঝা যাবে যে, প্রবেশ দ্বার থেকে যে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল, তা আসলে সামনে ছড়িয়ে থাকা ঘড়সিসরের নীল জল l এরপর ডাইনে বাঁয়ে সুন্দর পাকা ঘাট, মন্দির, চাতাল, স্তম্ভ ঘেরা সুসজ্জ্বিত বারান্দা, ঘর এবং না-জানি আরও কত কী l প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকা দৃশ্যাবলী পেরিয়ে পুকুরের সামনে পৌঁছে বিশ্রাম নেবার সময় চোখ সামনের দৃশ্যগুলির বিশেষ কোনো একটার ওপর স্থির হতে পারে না l প্রতি মুহূর্তে ঘুরে ঘুরে চোখের মণি চারপাশে ছড়ানো বৈচিত্রকে মেপে নিতে চায় l
কিন্তু চোখ মাপবে সে সাধ্য তার নেই l প্রায় তিনমাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া আগরের এই পুকুরের আগৌর একশো কুড়ি বর্গমাইল পরিমাণ জমিতে বিস্তৃত l এটি জয়সলমেরের মহারাজা মহারাওল ঘড়সি তোরোশো একানব্বই বিক্রম সংবত অর্থাত্ তেরোশো পঞ্চান্ন খ্রিস্টাব্দে তৈরি করিয়ে ছিলেন l অনান্য রাজারাও পুকুর তৈরি করিয়েছেন, কিন্তু ঘড়সি এতে নিজেও অংশগ্রহণ করেন l মহারাজা প্রতিদিন সুউচ্চ কেল্লা থেকে নেমে এসে খোঁড়া খুঁড়ি, ভরাট করা প্রভৃতি সব কাজই নিজে দেখা-শোনা করতেন l
এই সময়টা ছিল জয়সলমের রাজবংশে উত্থান পতনের কাল l ভাটি বংশে সিংহাসনের দখল নিয়ে ক্রমাগত অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ও সংঘর্ষ চলছিল l একদিকে মামা নিজের ভাগ্নের ওপর আঘাত হানছে, অন্যদিকে কেউ নিজের ভাইকে দেশের বাইরে নির্বাসন দিচ্ছে আবার কোথাও কেউ কারো খাবারে বিষ মেশাচ্ছে l একদিকে রাজবংশের এই অন্তর্কলহ তো ছিলই, তার ওপর রাজ্য ও শহর জয়সলমেরও সেই সময় দেশী বিদেশী আক্রমণকারীরা ঘিরে ফেলছিল যখন তখন l পুরুষেরা বীরের মতো মৃত্যু বরণ করছিল আর স্ত্রীরা নিজেদের উত্সর্গ করছিল জহর ব্রতের আগুনে l এই রকম এক জ্বলন্ত সময়ে ঘড়সি নিজে রাঠোরদের সেনার সাহায্য নিয়ে জয়সলমের অধিকার করেন l ইতিহাস বইতে ঘড়সির সময়কাল ‘জয় পরাজয়’, ‘বৈভব পরাভব’, ‘মৃত্যুর ঘাট ও ‘সময় সাগর’ জাতীয় শব্দে ভর্তি l
অথচ তখনও সেই সাগর তৈরি হচ্ছিল l দীর্ঘ সময়ের এই পরিকল্পনায় কাজ করার জন্য ঘড়সি অশেষ ধৈর্যে প্রয়োজনীয় সব উপাদান জড়ো করেছিলেন l এজন্য তাঁকে চরম মূ্ল্যই দিতে হয়েছিল l পাড় তৈরি হচ্ছে, মহারাজ সেখানে দাঁড়িয়ে সমস্ত কাজ দেখাশোনা করছেন; এমন সময় প্রাসাদের ষড়যন্ত্রে পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘড়সির ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ নেমে আসে l সে সময় মৃত রাজার চিতায় রানির সতী হওয়ার প্রচলন ছিল l কিন্তু রাণি বিমলা সতী হননি l তিনি রাজার স্বপ্ন পূর্ণ করলেন l
বালির এই স্বপ্নের দুটো রঙ l নীল রঙ জলের আর তিন চার মাইল এলাকা নিয়ে পরিধির প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে যে ঘাট, মন্দির, মিনার ও বারান্দার সারি, তার রঙ হলুদ l কিন্তু এই স্বপ্ন দিনে দুবার কেবল একটিমাত্র রঙেই রঙিন হয়ে ওঠে l উদীয়মান ও অস্তগামী সূর্য এই সময় ঘড়সিসরের জলে যেন মন-ভর সোনা গলিয়ে ঢেলে দেয় l ‘মন’ বলতে মাপ জোক করার মণ নয়, যতটা হলে সূর্যের মন ভরে যায় ঠিক ততটাই l
মানুষও নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী ঘড়সিসরে সোনা ঢেলেছিল l পুকুর রাজার হলেও প্রজাই তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করতে থাকে l প্রথম দফায় তৈরি হয় মন্দির, ঘাট এবং জলমহল বেড়েই চলে l যার যখন যা কিছু ভালো মনে হয়েছে, তা-ই সে ঘড়সিসরের জন্য উত্সর্গ করেছে l এই ভাবে রাজা প্রজার যুগলবন্দিতে ঘড়সিসর অপূর্ব এক গান হয়ে ওঠে l একসময় ঘাটের ওপর পাঠশালাও করা হয়েছিল l এখানে শহর ও আশেপাশের গ্রামের ছাত্ররা এসে থাকত এবং সেখানেই গুরুর কাছে জ্ঞানলাভ করত l পাড়ের একপাশে ছিল রান্না ও থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর l দরবার অথবা কাছারিতে যদি কারো কাজ আটকে যেত, তাহলে সে গ্রাম থেকে এসে এখানেই আশ্রয় নিত l নীলকণ্ঠ ও গিরিধারীর মন্দির, যজ্ঞশালা, জামালশাহ পিরের চৌকা সব কিছু একই ঘাটে l
জীবিকার জন্য মরুভূমি ছেড়ে দেশের অন্য কোথাও প্রবাসী হয়েছে এমন পরিবারগুলিরও মন পড়ে থাকত ঘড়সিসরে l এ রকমই, মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে চলে গিয়েছিলেন শেঠ গোবিন্দ দাসের পূর্বসূরীরা l পরে তাঁরা এখানে ফিরে ঘাটের পাঠশালের ওপর একটি অপূর্ব মন্দির তৈরি করান l এই প্রসঙ্গে এও মনে রাখা দরকার, পুকুর সচেতনতার এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত মানুষ অথবা পরিবার বাইরে যেখানে গিয়েই প্রবাসী হোক না কেন, সেখানেও তারা পুকুর তৈরি করতে বিরত থাকেননি l শেঠ গোবিন্দ দাশের পূর্বপুরুষেরাও জব্বলপুরে তাদের ঘরের সামনে একটি সুন্দর পুকুর তৈরি করিয়েছিলেন l হনুমানতাল নামের এই পুকুরে ঘড়সিসরের প্রভাব খুবই স্পষ্ট l
সারা শহরের জল যেত ঘড়সিসর থেকেই l সাধারণত সারাদিনই এখানে জল ভরা চলত কিন্তু সকাল ও সন্ধ্যেবেলা জল নিতে আসা কয়েকশো মেয়েদের ভিড়ে যেন মেলা লাগে যেত l শহরে পাইপ লাইন বসার আগে পর্যন্ত এই দৃশ্য দেখা গেছে l উম্মেদ সিংজি মেহেতার এক গজলে এই দৃশ্যের সুন্দর বর্ণনা রয়েছে l গজলটি লেখা হয় 1919 সালে l ‘ভাদ্রের কাজলী’, তীজ –এ যখন মেলা বসত, তখন সারা শহর সেজেগুজে ঘড়সিসরে উপস্থিত হত l শুধুমাত্র নীল ও হলুদ রঙের এই পুকুরে প্রকৃতির সমস্ত রঙ ছড়িয়ে পড়ত l
ঘড়সিসরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা একতরফা ছিল না l মানুষ ঘড়সিসরে আসত আর ঘড়সিসরও যেন তাদের কাছে পৌঁছে মনে জায়গা করে নিত l সুদূর সিন্ধুপ্রদেশে প্রবাসী টিলোঁ নামে এক গণিকার মন সম্ভবত এই রকমই কোনো এক মুহূর্তে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে l
পুকুরে মন্দির ঘাট-পাট সবই ছিল l জাঁকজমকেরও অভাব ছিল না l তবুও টিলোঁর মনে হয় এত সুন্দর পুকুরে একটা সুন্দর প্রবেশদ্বারও থাকা দরকার l সে ঘড়িসিসরের পশ্চিম ঘাটে ‘পোল’ অর্থাত্ প্রবেশদ্বার তৈরি করানোর সিদ্ধান্ত নেয় l পাথরের ওপর সূক্ষ্ম নকশাদার, সুন্দর জানালা দেওয়া প্রবেশদ্বার শেষ হয়েই এসেছিল; এমন সময় কিছু লোক রাজার কাছে গিয়ে কানভাঙানি দেয় : ‘আপনি শেষে একগণিকার তৈরি প্রবেশদ্বার দিয়ে ঘড়সিসরে প্রবেশ করবেন’, ফলে বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়. ওদিকে প্রবেশদ্বারের কাজ চলছে l একদিন রাজা এটি ভেঙে ফেলবেন বলেই সিদ্ধান্ত নেন l টিলোঁ খবর পায় l অমনি সে রাতারাতি প্রবেশদ্বারের সবচেয়ে উঁচু তলায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেয় l মহারাজা মত বদলান l তখন থেকেই সারা শহর এই সুন্দর প্রবেশদ্বারটি দিয়েই ঘড়সিসরে প্রবেশ করে এবং টিলোঁর নামের সঙ্গেই একে স্মরণে রেখেছে l
এই প্রবেশদ্বারের সামনে পুকুরের বিপরীতে চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি গোল জায়গা l পুকুরের বাইরে তো আমের বাগান প্রভৃতি থাকেই, কিন্তু এই পুকুরের ভিতরেই গোল জায়গাটি হল বাগান l এখানে মানুষ ‘গোঠ’ অর্থাত্ আনন্দ - মঙ্গল করতে আসে l এর সঙ্গেই পূর্বদিকে চারদিক ঘেরা আরো বড় একটা গোল জায়গা ছিল l সেখানে থাকত পুকুর রক্ষাকারী ফৌজ l দেশী বিদেশী শত্রুতে বেষ্টিত রাজ্যের মানুষকে জলপ্রদানকারী একমাত্র পুকুরের সুরক্ষা ব্যবস্থা তো পাকা বহেই।
মরুভূমিতে বৃষ্টি যতই কম হোক, ঘড়সিসেরর আগৌর এত বড় ছিল যে সেখানকার প্রতিটি জলের ফোঁটা গড়িয়ে পুকুরে এসে তাকে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলত l ঘড়সিসরের সামনে পাহাড়ের ওপর তৈরি দুর্গের ওপর উঠে সামগ্রিকভাবে দেখে, অথবা নীচে আগৌরের মধ্যে পায়ে হেঁটে ঘুরে, যেভাবেই হোক, বার বার বোঝালেও এই বিশাল পুকুরে কিভাবে জল সংগ্রহ করা হত সে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, সহজে বুঝে ওঠা শক্ত l দিগন্ত থেকে বাহিত হয়ে আসত এর সঞ্চয় l এই বিশাল এলাকার জল এক সঙ্গে জড়ো করে পুকুরের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রায় আট কিলোমিটার লম্বা জমি এক পাশে বাঁধিয়ে নিয়ে ‘আড়’ তৈরি করা হয় l এরপর বিশাল মাত্রায় বয়ে আসা জলের শক্তি পরীক্ষা করে দেখা হয় এবং এর আঘাত প্রতিরোধ করতে সেই বাঁধানো জমির পাশে লম্বা ও মজবুত পাথরের চাদর অর্থাত্ প্রাচীর তৈরি হয় l এতে ধাক্কা খেয়ে জল তার সমস্ত গতি হারিয়ে ধীরে ধীরে ঘড়সিসরে প্রবেশ করে l এই প্রাচীরটা না থাকলে ঘড়সিসরের আগর, তার সুন্দর ঘাট ও অন্য সব অঙ্গও ধ্বসে যেতে পারত l
এবার কানায় কানায় ভরে ওঠা ঘড়সিসরের রক্ষণা বেক্ষণের দায়িত্ব ‘নেষ্টা’র হাতে চলে যেত l পুকুরের অতিরিক্ত জল পাড়ের কোনো ক্ষতি না করেই যে অংশ দিয়ে বাইরে চলে যেতে পারে – তারই নাম নেষ্টা l এটি বইতে শুরু করত এবং এই বিশাল পুকুরকে ভেঙে ফেলতে পারে যে অতিরিক্ত জল, তাকে বাইরে নিয়ে যেত l কিন্তু, এই ‘বয়ে যাওয়া’-টিও ছিল বড়ই বিচিত্র l যারা বা যেসব মানুষ এক একটি জলবিন্দু সংগ্রহ করে ঘড়সিসরকে ভরাতে জানত তারা সেই অতিরিক্ত জলটুকুকে শুধুমাত্র জল নয় অপার জলরাশি হিসেবেই ভাবত l নেষ্টায় প্রবাহিত জল সামনে একদিকে অন্য একটা পুকুরে জমা করে নেওয়া হত l ‘নেষ্টা’ তখনও বইতে থাকলে, সেই জল গিয়ে জমা হত দ্বিতীয় আরেকটা পুকুরে l এই ধারাবাহিকতা পুরো নয়টি পুকুর পর্যন্ত চলত l নৌতাল, গোবিন্দসর, জোশিসর, গোপালসর, ভাটিয়াসর, সুদাসর, মোহতাসর, রতনসর এবং কিষণঘাট l এখানে পৌঁছেও যদি জল বেঁচে যেত, তাহলে কিষাণঘাটের পর তাকে কিছু ‘বেরি’ অর্থাত্ ছোট ছোট কুয়োর মতো কুণ্ডে ভরে রাখা হত l জলের প্রতিটি বিন্দু আক্ষরিক অর্থেই ঘড়সিসর থেকে কিষাণঘাট - প্রায় সাত মাইল রাস্তায় নিজের সঠিক অর্থ পেয়ে যেত l
আজ যাদের হাতে জয়সলমেরের প্রশাসন, তারা ঘড়সিসরের তাত্পর্যই ভুলে গেছে, তো তার নেষ্টার সঙ্গে যুক্ত বাকি নয় পুকুরের বিষয়ে তাদের সচেতনতা কী করে থাকবে l ঘড়সিসরের আগৌরে এখন বায়ুসেনার বিমানঘাঁটি l তাই, আগৌরের এই অংশের জল এখন পুকুরের দিকে না এসে অন্য কোথাও বয়ে যায় l নেষ্টা ও তার রাস্তায় পড়ে যে নয়টি পুকুর, তার আশপাশেও আজ দ্রুতগতিতে বাড়িঘর, নতুন নতুন গৃহনির্মাণ সংস্থার ফ্ল্যাট, এমনকী জল সমস্যা নিয়ে যারা কাজ করছে, সেই ইন্দ্রিরা নহর প্রাধিকরণের অফিস ও তার কর্মীদের আবাসন গড়ে উঠেছে l ঘাট, পাটশালাসমূহ, রান্নাঘর, বারান্দা, মন্দির - প্রভৃতি সবকিছুই যথার্থ দেখা শোনার অভাবে আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে l আজ শহর আর সেই ‘লহাস’ খেলে না, যাতে রাজা প্রজা সকলে মিলে ঘড়সিসরকে পরিষ্কার করত, পাঁক বের করত l পুকুরের ধারে স্থাপিত পাথরের জলস্তম্ভও কিছুটা নড়বড়ে হয়ে একদিকে হেলে পড়েছে। পুকুরের রক্ষীবাহিনী যে অংশে থাকত, সেখানকার গম্বুজের পাথরও আজ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে l
ঘাটের বারান্দা কোথাও কোথাও এখন বেদখল হয়ে গেছে l যেসব পাঠশালায় একদিন ঐতিহ্য সম্পন্ন জ্ঞানের প্রকাশ ঘটত, সেখানে আজ আবর্জনার স্তূপ l গত কয়েক বছর ধরেই জয়সলমের, বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে স্থান পেয়েছে l শীতের সময়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখন সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা এসে এখানে জড়ো হয় l তাদের কাছে সুন্দর এই পুকুর বিশাল আকর্ষণের l এজন্যই গত দু’বছর আগে সরকার ঘড়সিসরের দিকে কিছুটা মনোযোগ দেয় l আগৌর থেকে আসা জল আজ আর পর্যাপ্ত নয় বলে, ঘাটতিটুকু ইন্দ্রিরা গান্ধী নহর থেকে পাইপে করে এনে পূরণ করার চেষ্টা করা হয় l যথেষ্ট ভালভাবে প্রকল্পটির উদ্বোধন হয়েছিল, কিন্তু প্রথমবার জল নিয়ে আসার পরই অনেকদূর থেকে টেনে আনা পাইপ লাইনে ফাটল ধরে, এখন সেটি সম্পূর্ণ অকেজো l ওটি আর সারানো যায়নি l ঘড়সিসর আজও, যতটা সম্ভব বর্ষার জলেই ভরে ওঠে l
ছশো আটষট্টি বছরের ঘড়সিসর শেষ হয়ে যায়নি l যাঁরা এই পুকুরটি তৈরি করেছিলেন, তাঁরা একে সময়ের প্রহার সহ্য করার মতো মজবুত করেই তৈরি করেছিলেনl বালির ঝড়ের মাঝে নিজেদের এই পুকুরকে অপূর্ব কৌশলে রক্ষা করার ঐতিহ্য ছিল যাদের, বোধহয় তারা ভাবতেই পারেননি যে উপেক্ষা অবহেলার ঝড়ও এর ওপর দিয়ে বইতে পারে l কিন্তু এই ঝড়কেও আজ ঘড়সিসর স্বয়ং, এবং তাকে যারা বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তেমন কিছু মানুষ ধৈর্য ধরে সহ্য করে চলেছে l পুকুর পাহারা দেওয়ার ফৌজ হয়তো এখন আর নেই, কিন্তু কিছু মানুষের সচেতন মনের পাহারা আজও আছে l দিনের প্রথম কিরণ এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরে ঘণ্টা বেজে ওঠে l সারাদিন ধরেই ঘাটে মানুষের আনাগোনা l কিছু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৌন হয়ে বসে ঘড়সিসরের সৌন্দর্য দেখতে থাকে, কেউ গান গায় অথবা কেউ হয়তো ‘রাবনহথা’ নামে বিশেষ এক ধরনের সারেঙ্গি বাজায় l ঘড়সিসরের অনেক দূরে উটের দল নিয়ে বালিয়াড়ির পর বালিয়ড়ি পার হয়ে চলেছে যারা, তারা আজও এর শীতল প্রাণদায়ী জলের গুণকীর্তন করে l জল নিতে আজও মেয়েরা ঘাটে আসে l উটের গাড়িতে জল যায় l এখন দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার সেখানে ট্যাঙ্কারও দেখা যাচ্ছে l ঘড়সিসর থেকে জল নিতে এরা ডিজেল পাম্প পর্যন্ত চালায় l
ঘড়সিসর আজও জল দিয়ে চলেছে l সেইজন্যই বুঝি উদীয়মান ও অস্তগামী সূর্য আজও তার জলে মন - ভরা সোনা ঢেলে দিয়ে যায় l
ঘড়সিসর একটা দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিল l তাই এর পর আর কোনো নতুন পুকুর করা হয়তো কঠিন ছিল। তবুও জয়সলমের অঞ্চলে প্রতি পঞ্চাশ একশো বছর অন্তর পুকুর তৈরি হতেই থাকে এক সে এক, মানিক ঘড়সিসরের সঙ্গে যেন গেঁথে চলা এক একটি মুক্তো l
ঘড়সিসরের প্রায় একশো পঁচাত্তর বছর পর তৈরি হয় জৈতসর l এটা একটা বাঁধ, তবে সংলগ্ন বড় বাগানের জন্য একে ‘বড়াবাগ’ হিসেবেই স্মরণ করা হয়ে থাকে l এই পাথরের বাঁধ জয়সলমেরের উত্তরে খাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসা সমস্ত জল আটকে রেখেছে l একদিকে জৈতসর, আর অন্যদিকে রয়েছে তার জল থেকেই সিঞ্চিত বড়াবাগ l এ দুটিকে পৃথক করেছে বাঁধের দেওয়াল l কিন্তু এ যেন দেওয়াল নয়, বড়সড় চওড়া রাস্তাই মনে হয়, যা মূল জলাধার পার হয়ে সামনের পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত l দেওয়ালের নীচে সেচ খালটির নাম ‘রামনাল’ l রামনাল নহর বাঁধের দিকটায় সিঁড়ির মতন l জৈতসরের জলের স্তর বেশি বা কম যাই হোক, নহরের এই সিঁড়ির মতন গঠন জলকে বড়াবাগের দিকে নামিয়ে নিয়ে যায় l সেখানে পৌঁছে রামনাল রামের নামের মতোই প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে l নহরের প্রথম কোণাতেই একটা কুয়োও আছে l জল শুকিয়ে গেলে অথবা, নহর বন্ধ হয়ে গেলে চুঁইয়ে আসা ভৌমজলে ভর্তি এই কুয়ো কাজে লাগে l এই বড় কুয়োটিতে চড়স দিয়ে জল তোলা হয় l কখনও এটিতে ‘রহট’ ব্যবহার হত l আর বড়াবাগে ছোট ছোট অগুণতি কুয়োও রয়েছে l
বড়াবাগ সত্যি করেই সুবিশাল এবং সবুজে সবুজ l উঁচু আর বিরাট আমের বাগান, বাগানে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা l বৃষ্টি বহুল অঞ্চলে সাধারণত নদীর ধারে যে অর্জুন গাছ দেখা যায়, তাও পাওয়া যাবে এই বড়াবাগে l সূর্যের কিরণ এখানে গাছের পাতায় বাধা পেয়ে আটকে যায়, হাওয়া দিলে পাতা নড়ে, তখন ফাঁক পেয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যালোক উপচে পড়ে মাটিতে l বাগানের অন্য পাশে, পাহাড়ে রাজ বংশের শ্মশান l শেখানে স্বর্গত ব্যাক্তিদের স্মৃতিতে প্রচুর সুন্দর সুন্দর ‘ছত্রী’ করানো হয়েছে l
অমরসাগর তৈরি হয় ঘড়সিসরের তিনশো পঁচিশ বছর পর l বয়ে যাওয়া জলকে আটক করা প্রধান উদ্দেশ্য হলেও, অমর সাগর যারা তৈরি করেছিলেন তারা সম্ভবত এটাও জানাতে চেয়েছিলেন যে উপযোগী আর সুন্দর পুকুর তৈরি করার ইচ্ছেটাই আসলে অমর l পাথরের টুকরো জুড়ে জুড়ে যে কী অদ্ভুত সুন্দর পুকুর তৈরি করা যেতে পারে, তার উদাহরণ হিসেবে অমরসাগরের জুড়ি নেই l পুকুরের চারটি পাড়ের মধ্যে একটি পাড় খাড়া এবং উঁচু একটা দেওয়াল হিসেবেই গড়ে তোলা হয়েছে l দেওয়ালের সঙ্গে মিনার ও জানালা ছুঁয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নীচে পুকুর পর্যন্ত নেমে গেছে l এই দেওয়ালেরই সমতল অংশে আলাদা আলাদা উচ্চতায় পাথরের বাঘ, হাতি, ঘোড়া প্রভৃতি খোদিত l পাথরের এই সুন্দর মূর্তিগুলি আসলে জলস্তর নির্দেশক l গোটা শহর এগুলি দেখে অতি সহজেই বুঝে নিত জল কতটা এসেছে আর তাতে কত মাস চলতে পারে l
অমর সাগরের আগৌর তত বড় নয় যে তা থেকে সারা বছরের জল পাওয়া যাবে l গরম পড়তে না পড়তেই অমর সাগর শুকিয়ে আসতে থাকে l এর মানে দাঁড়ায়, যখন সবচেয়ে বেশি জলের প্রয়োজন, জয়সলমেরের মানুষ এই অপূর্ব পুকুরটিকে তখনই ভুলে যায়? আশ্চর্য হতে হয় | এখানকার বাস্তুকার শিল্পীরা এমন কিছু কৃতিত্ব এক্ষেত্রে দেখিয়েছেন, যা স্থাপত্য শিল্পের শাস্ত্রীয় গ্রন্থে অনায়াসে নতুন কয়েকটি পাতা যোগ করতে পারে l পুকুরটির নীচে মেঝেতে সাতটা ‘বেরি’ তৈরি করা হয়েছিল l বেরি এক বিশেষ ধরনের বাউড়ি l এর আর এক নাম ‘পগবাও’ l পগবাও শব্দ এসেছে পগবাহ থেকে l বাহু, বায় বা বাউড়ি l পগবাও অর্থাত্ পা - পা হেঁটেই যেখানে জল পর্যন্ত পৌঁছানো যায় l পুকুরের জল শুকিয়ে গেলেও বাউড়িগুলির চুয়ানো জলে জলস্তর উঠেই থাকে, চুঁইয়ে আসা ভৌমজলে সেগুলি তখনও পরিপূর্ণ l এই বাউড়িগুলো আবার এমন ভাবে তৈরি, যাতে গ্রীষ্মে জল হারিয়ে ফেলা অমর সাগর তার নিজের সৌন্দর্য না হারিয়ে ফেলে l সমস্ত বাউড়িগুলোতে পাথরের সুন্দর চাতাল, স্তম্ভ, ছত্র এবং নীচে নামার জন্য শৈল্পিক কারুকার্যময় সিঁড়ি l গরমে বৈশাখে যেমন মেলা বসত, সেইরকম বর্ষার ভাদ্রেও l শুকনো অমর সাগরের বাউড়িগুলো যেন এক বিশাল মহলের একাংশের মতো লাগে l আর যখন অমর সাগর ভরে ওঠে, তখন মনে হয় পুকুরে ছাতাওয়ালা নৌকো ভাসছে l
মরুভূমিতে জয়সলমের এমন একটা রাজ্য, এক সময় বাণিজ্যে যার জয়ডঙ্কা শোনা যায় l তখন শয়ে শয়ে উটের ক্যারাভান প্রতিদিন এখানে থেমেছে l আজকের সিন্ধু প্রদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, ইরান, ইরাক, আফ্রিকা এমনকী সুদুর কাজকেস্তান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকেও পণ্যদ্রব্য এখানকার বাজারে আসত l আজ এখানকার মানক চক-এ হয়তো শুধু শাক - সবজি বিক্রি হয়, অথচ এমন একদিন ছিল, যখন এখানেই কেনাবেচা হত মণি মাণিক্য l যারা উটের ভিড় সামলাতো, তারা এখানে লক্ষ লক্ষ টাকার মালপত্র নামাতে সাহায্য করেছে সেসময় l আঠারোশো সালের সূচনা পর্যন্ত জয়সলমেরের এই সমৃদ্ধি অটুট ছিল l তখন এখানে পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের বাস l আজ সেই সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে l
যখন মন্দার সময় এল, তখনও জয়সলমের অঞ্চলে পুকুর তৈরিতে মন্দা পড়েনি l গজরূপসাগর, মূলসাগর, গঙ্গাসাগর, ডেডাসর, গোলাপপুকুর, ইসরালালজির পুকুর এইভাবে একের পর এক পুকুর তৈরী হয়েছিল। জয়সলমের শহরে আজও এত পুকুর আছে যে, তাদের ঠিকঠাক গুণে ওঠা এক কঠিন কাজ l সম্পূর্ণ বলে ধরে নেওয়া তালিকায় যেকোন সাধারণ লোক চলতে ফিরতে দুটো চারটে নতুন নাম যোগ করে দিয়ে কৌতুকে হেসে ফেলে
ঐতিহ্যের এই সুশৃঙ্খল ধারা ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত ভেঙে পড়েনি l শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্ব শুধু রাজা, জমিদার, রাণা অথবা মহারাণাদের ওপরই ন্যস্ত ছিল না l আজকের পরিভাষায় সমাজে যাদের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তারাও দীর্ঘদিন পুকুরের এই শৃঙ্খলা রক্ষায় অংশ নিয়েছে l
মেঘা পশু চরাত, গল্পটা পাঁচশো বছরের পুরোনো l পশুর পাল নিয়ে সে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে পড়ত l ক্রোশের পর ক্রোশ ছড়িয়ে থাকা মরুভূমি l সারাদিনের জন্য তাই এক কোপড়ি জল সঙ্গে নিত l ঘরে ফিরতে সন্ধে l একদিন কোপড়ির জল কী কারণে যেন খানিকটা বেঁচে গেল l মেঘা কী জানি কী ভাবল, একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে তাতে জলটুকু ঢেলে দিয়ে ভালোভাবে আকন্দ পাতায় ঢেকে দিল l
চরানোর কাজ আজ এখানে তো কাল অন্যত্র l মেঘা পরের দুদিন আর সেখানে যেতে পারল না তৃতীয় দিন সেখানে পৌঁছেই অসীম কৌতূহলে পাতা সরালো l গর্তে জল অবশ্যই ছিল না, কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা স্পর্শ পাওয়া গেল l মেঘার মুখ থেকে আপনা আপনি শব্দ বেরিয়ে এল - ভাপ, সে ভাবল এত গরমেও যদি এখানে ওইটুকু জলের আর্দতা টিকে থাকে, তাহলে এখানে পুকুরও হতে পারে l
মেঘা একলাই পুকুর খুঁড়তে শুরু করে l এখন সে প্রতিদিন কোদাল ও কড়াই সঙ্গে নিয়ে যায় l সারাদিন একাই মাটি কাটে, পাড়ে ফেলে. গরুগুলো আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় l ভীমের মত শক্তি তার ছিল না ঠিকই, কিন্তু সংকল্প তার ভীষ্মের মতোই কঠিন l দুবছর পর্যন্ত সে একাই কাজে লেগে থাকল l সীমাহীন মরুভূমির ভেতর এখন পাড়ের বিশাল ঘেরা দূর থেকেও দেখা যায় l পাড়ের খবর একদিন পাশের গ্রামগুলোতেও পৌঁছাল l এবার প্রতিদিন সকালে গ্রাম থেকে ছোটরা এবং কিছু অন্যান্য লোকজনও তার সঙ্গে যায় l সকলে মিলে কাজ করে l এই ভাবে বারো বছর হয়ে গেল, পুকুরের কাজ তখনও চলছে l এদিকে মেঘার সময় পূর্ণ হয়ে এল, মৃত্যু হল তার l তার স্ত্রী সতী হয়নি l মেঘার অসমাপ্ত পুকুরের কাজ সে নিজের কাঁধে তুলে নেয় l মেঘার বদলে এবার সে নিজেই পুকুরের কাজ করতে আসে l পরবর্তী ছয় মাসে পুকুর তৈরি সম্পূর্ণ হয় l
জলের ভাপ দেখে পুকুর তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল তাই ঐ জায়গার নামও হয় ভাপ l পরে তা বিকৃত হয়ে ‘বাপ’ উচ্চারণে পরিণত হয়েছে l সামান্য ‘চরাবহা’ মেঘাকে জনসমাজ মেঘাজি হিসেবে মনে রেখেছে এবং পুকুরের পাড়ে তার নামে সুন্দর একটি ছাত্রী ও তার স্ত্রীর স্মৃতিতে ছোট একটি মন্দির নির্ণাণ করেছে l
জয়সলমের বিকানের রাস্তার ওপর ছোট্ট এক শহর বাপ l চা, কচুরির ছ সাতটা দোকানওয়ালা একটা বাসস্ট্যাণ্ড, আর বাসের চেয়ে তিন গুণ উঁচু পাড় স্ট্যাণ্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে l গরমকালে পাড়ের এপাশে লু বয়, ওপাশে মেঘাজি পুকুরে তখন ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙে l বর্ষার সময় তো পুকুরে লাখেটা (দীপ) লাগানো হয় l তখন জলের বিস্তার চার মাইল ছড়িয়ে পড়ে l মেঘ ও মেঘের দেবতা মরুভূমিতে যদিও কমই আসেন, কিন্তু মেঘাজির মতো মানুষের অভাব কখনোই সেখানে হয়নি l রাজস্থানের পুকুরের যশকীর্তন পূর্ণ হবে না যদি না জসেরি নামক এক পুকুরের কথা বলা হয় l জয়সলমের থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ডঢ়া গ্রামের কাছে নির্মিত এই পুকুরটি জল সংগ্রহের ব্যপারে যেন সমস্ত অসম্ভবের বেড়া অতিক্রম করে এক প্রবাদে পরিণত হয়েছে l চারিদিকে তপ্ত মরুভূমি, কিন্তু জসেরির জল কখনও শুকোয় না, তার খ্যাতিও থাকে অম্লান l বাবলা গাছ ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা পাড়ের ওপর একটা সুন্দর ছোট ঘাট এবং পুকুরের এক কোণায় পাথরের সুন্দর ছত্রী l বলার মতো কিংবা উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই এখানে নেই l তবুও বছরের যে কোন মাসেই দেখা যাবে নীল জলে ঢেউ ভাঙছে, চারিদিকে পাখিদের মেলা l জসেরির জল কখনো শুকোয় না l ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম দুর্ভিক্ষেও জসেরির জলের যশ কখনো শুকায়নি l
জসেরিকে পুকুর বলা যায়, আবার বড় এক ‘কুঁই’-ও বলা যেতে পারে l এর আগরের ঠিক নীচে রয়েছে খড়িয়া পাথরের স্তর l পুকুরটি খোঁড়ার সময় খড়িয়া স্তরের যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়েছিল, কোথাও যেন কোনোভাবে ভেঙে না যায় l তাই এখানে পালর পানি ও রেজানি পানির এক অনবদ্য মেলবন্ধন ঘটেছে l গত বছরের বর্ষার জল শুকিয়ে যাবার আগেই এ বছরের বর্ষায় আবার নতুন জল এসে তার সঙ্গে মেশে l জসেরি যেন বৃষ্টি বিন্দুগুলির বাত্সরিক এক মহামিলন ক্ষেত্র l শোনা যায়, পুকুরের মাঝখানে একটি ‘পগবাও’ অর্থাত্ বাউড়িও রয়েছে l পুকুর যারা তৈরি করেছিল, সেই পালিওয়াল ব্রাহ্মণ পরিবারের পক্ষ থেকে এই বাউড়ির পাশেই একটি তাম্রফলক লাগানো হয় l কিন্তু এই ফলকটি আজ পর্যন্ত কেউ দেখা বা পড়ার সুযোগ পায়নি l জসেরি যারা তৈরি করেছিল, তারা যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই বোধহয় ফলকটি পুকুরের মাঝখানে বসায় l তাই তাম্রফলকের বদলে রুপোর মতো ঝকঝকে পুকুরেই মানুষের চোখ পড়ে আর তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে l
আশেপাশের দু চারটি গ্রাম নয়, সাতটি গ্রাম এই জসেরির থেকে জল নেয় l অনেক গ্রামের গবাদি পশুধনই এই জল ভাণ্ডারের সম্পন্নতার ওপর নির্ভরশীল l অন্নপূর্ণার মতোই জসেরিকে মানুষ জলপূর্ণা বলে স্মরণ করে l এর খ্যাতির আরেকটা বড় দিক হল, অথৈ জলের সঙ্গে সে যেন মমতাতেও পরিপূর্ণ l আজ পর্যন্ত এই পুকুরে ডুবে কেউ মারা যায়নি l উটে বসে থাকা যাত্রীও এর মধ্যে ডুবে যেতে পারে জসেরি এতটাই গভীর, তবুও এখনো জসেরির নামের সঙ্গে কোন মৃত্যুর ঘটনা জড়িয়ে নেই l এ জন্য জসেরিকে নির্দোষ বলা হয় l
জলের এরকম নির্দোষ ব্যবস্থা করতে পারে যে সমাজ, বিন্দুর ভিতরে সিন্ধুকে অনুভব করতে পারে যে সমাজ, সে সমাজের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব বিস্মিত হয়ে পড়ে l
Path Alias
/articles/bainadautae-sainadhau
Post By: Hindi