শহরের বাতাসে সাধারণত আর্সেনিক বেশি, গ্রামের বাতাসে কম। তবে বর্তমান বাংলায় উল্টোটাও হতে পারে বা উল্টোটা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ কৃষি কাজে সেচের জন্যে আর্সেনিক ঘটিত ভূগর্ভ জলোত্তলন বিপুল ভাবে হয়েছে ও হয়েই চলেছে।রসায়নের সাধারণ ধারণা থেকে জানা যায় আর্সেনিক সালফার ও অকসিজেনের সঙ্গে সহজে দৃঢ় রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কার্বনের সঙ্গেও হয়, পরিবেশ ও পরীক্ষাগারে সহজেই হয়। আর্সেনিকের রাসায়নিক যৌগ বা প্রজাতি সমূহকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যথা -
(A) অজৈব আর্সেনিক
(B) জৈব আর্সেনিক
(C) জৈব ধাতব আর্সেনিক
শিলা, মৃত্তিকা, জল (সামুদ্রিক ও মিঠা জল), বাতাস এবং সকল উদ্ভিদ ও সকল প্রাণীদেহে আর্সেনিক কম - বেশি পাওয়া যায় অজৈব ও জৈব অবস্থায়।
বর্ধিত মাত্রার আর্সেনিক সম্বলিত শিলাজাত মৃত্তিকা | অল্প থেকে শতাধিক মিগ্রা কেজি প্রতি |
ফসফেট শিলা | প্রায় 200 মিগ্রা কেজি প্রতি |
আগ্নেয় শিলা | < 1 থেকে 15 মিগ্রা কেজি প্রতি |
বেলে পাথর | < 1 থেকে 20 মিগ্রা কেজি প্রতি |
ভূগর্ভ জল | সামান্য থেকে শতসহস্র মিগ্রা লিটার প্রতি |
পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই আর্সেনিক পৃথিবীতে আছে, চিরকাল থাকবেও। আর্সেনিক সর্বব্যাপী আর্সেনিক যৌগসমূহ পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজ করে, তাদের শুধু রূপান্তর হয় এক রাসায়নিক অবস্থা থেকে ভিন্নতর অবস্থায়।
শিলাস্তর ক্ষীয়ভবনের মাধ্যমে আর্সেনিক পরিবেশে বিমুখ হয় এবং বাতাসের অকসিজেনে জারিত হয়ে জল বাতাস মাটি ও জীবমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত, উষ্ণ প্রস্রবন, গেজার, ফিউমারোল প্রভৃতি থেকেও যথেষ্ট আর্সেনিক প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিবেশে আসে। ফসফেট ও আর্সেনেটের রাসায়নিক সাদৃশ্য বেশী থাকায় স্বাভাবিক অবস্থাতেই তারা একই সঙ্গে থাকবে, এটাই ভূ-রসায়নের নিয়ম। স্বভাবতঃ ফসফেট সারে ও ডিটারজেণ্ট গুঁড়োয় ফসফেট মেশানো হয় বলে আর্সেনিক বেশী থাকে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বছরে 2.10 x 107 কেজি ( বা 21,000 টন ) আর্সেনিক নানারকম গ্যাসীয় আর্সাইন রূপে বায়ুমন্ডলে বিমুক্ত হয় । মাটির আর্সেনিকের উপর জীবাণু ও ছত্রাকের প্রাণ রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায়, বিশেষ করে অবায়বীয় পরিবেশে, বিপুল পরিমাণ আর্সাইন ও মিথাইল আর্সাইন গ্যাস সমূহ বাতাসে বিমুক্ত হয়। শহরের বাতাসে সাধারণত আর্সেনিক বেশি, গ্রামের বাতাসে কম। তবে বর্তমান বাংলায় উল্টোটাও হতে পারে বা উল্টোটা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ কৃষি কাজে সেচের জন্যে আর্সেনিক ঘটিত ভূগর্ভ জলোত্তলন বিপুল ভাবে হয়েছে ও হয়েই চলেছে।
মুক্ত সমুদ্র জলে আর্সেনিকের মাত্রা লিটার প্রতি 1 - 2ug। অদূষিত ভূতল ও ভূগর্ভজলে সাধারণত আর্সেনিকের মাত্রা লিটার প্রতি 1-10ug । তবে সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ভূগর্ভজলে আর্সেনিকের মাত্রাধিক্য লক্ষ্য করা গেছে। বহুস্থানের ভূগর্ভজলে লিটার প্রতি কয়েকশত থেকে কয়েক সহস্র মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। তাদের মধ্যে তাইওয়ান, বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, চিনের জিনজিয়াং, অন্তর্মোঙ্গিয়া, চিলি, আর্জেণ্টিনা প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আকরিকসমূহ
ধারাপৃষ্ঠে আর্সেনিকের আকরিক সমূহের ( যাদের সবই অজৈব ) সংখ্যা প্রায় শ’দুয়েক ( 200 )। তাদের মধ্যে-
আর্সেনেট [As(V)] | শতকরা 60 ভাগ |
সালফাইড ও সালফোসল্ট | শতকরা 20 ভাগ |
আর্সেনাইট, আর্সেনাইড, সিলিকেট ও মৌলিক আকরিক | শতকরা 20 ভাগ |
সচরাচর দৃষ্টি আর্সেনিক আকরিক
রাসায়নিক জাত | আকরিকের নাম | রাসায়নিক ফর্মুলা |
সালফাইড আকরিক (Sulfides): | রিয়েলগার (Realgar) অরপিমেণ্ট (Orpiment) আর্সেনোপাইরাইট (Arsenopyrite) | As4S4 As2S3
FeAsS |
সালফোসল্ট (Sulfosalts): | টেনানাইট (Tennanite) এনারজাইট (Energite) | (Cu, Fe)12As4S13 Cu3AsS4 |
আর্সেনেট (Arsenates): | স্করোডাইট (Scorodite) মিমেটাইট (Mimetite) | FeAsO4.2H2O Pb5(AsO4)3CI |
আর্সেনাইট (Arsenites) | ট্রিপকাইটস (Trippkites) | CuAs2O4 |
আর্সেনিকের রাসায়নিক যৌগসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
অজৈব, জৈব ও জৈব ধাতব শত শত আর্সেনিক যৌগ জড় ও জীব জগতের সর্বত্র বিরাজিত। তারা জল, বাতাস, উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহে নানারকম ক্রিয়া - বিক্রিয়ায় সতত রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তনশীল। আবার যেমন পরিবর্তনশীল তেমন সঞ্চরণশীল।
আর্সেনিকের রাসায়নিক যৌগ সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচের সারণি - তে দেওয়া হল।
সারণি - আর্সেনিক যৌগ সমূহের সংক্ষিপ্ত রাসায়নিক পরিচয়
জারণস্তর - 3 [As(-III)] | রাসায়নিক প্রজাতির নাম ( ফর্মূলা ) | স্ফুটনাঙ্ক | রাসায়নিক টীকা |
আর্সাইন সমূহ [ (CH3) xAsH3-x ], x = 0 – 3 আর্সাইন AsH3 |
- 5.50C |
গ্যাস | |
মনোমিথাইল আর্সাইন ( CH3AsH2 ) |
20C |
গ্যাস | |
ডাইমিথাইল আর্সাইন ( CH3)2AsH | 360C | প্রবল উদ্বায়ী | |
ট্রাইমিথাইল আর্সাইন ( CH3)3 As | 700C | উদ্বায়ী তরল |
[ রাসায়নিক পরীক্ষাগারে উত্পন্ন করে আর্সাইন সমূহের প্রকৃতি ও ধর্ম জানা গেছে। পরিবেশে নানারকম জীবাণু ও ছত্রাক (molds) স্বাভাবিকভাবেই এইসব বিষাক্ত গ্যাস উত্পন্ন করে। বাতাসে জারিত হয়ে এগুলি আর্সেনাইট ও আর্সেনেটে পরিণত হয়ে ধুলোকণায় আটকে (sorbed) বৃষ্টি বাহিত হয়ে বা এমনিতেই নীচে নেমে সমগ্র পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর্সাইনের বিষক্রিয়তার মারাত্মকতা নাটকীয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করল 1815 সালে যখন একজন জার্মান রসায়নবিদ এক পরীক্ষায় ( As- যৌগ +Zn+H2SO4 ) উদ্ভূত আর্সাইন গ্যাসের গন্ধ বেশী মাত্রায় শুঁকে ফেলেছিলেন, যার ফলে তিনি একঘণ্টার মধ্যে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যান।
0 [ As0 ]
+ 3 [ As(III)] | ধাতব আর্সেনিক ( As0 ) | পৃথিবীতে দুর্লভ, ভারতে নেই |
আর্সেনিয়াস অকসাইড ( As2O3 ) | স্বাদ, বর্ণ, গন্ধহীন, গরমজলে দ্রাব্যতা বেশি। অম্লধর্মী, সহজলভ্য, বহুল ব্যবহৃত। ভারতীয় নাম - শঙ্খবিষ,সেঁকোবিষ। | |
আর্সেনাস অ্যাসিড ( H3AsO3 ) ও তার নানারকম লবণ | pk1 = 9.2; pk2 = 12.1; pk3 = 13.4 | |
আর্সেনাস সালফাইড ( As2S3 ) | রসায়নগার ও প্রকৃতিতে সহজলভ্য, সুস্থিত। | |
আর্সেনাস হ্যালাইড ( AsX3 ) | হ্যালাইড সমূহের মধ্যে আর্সেনাস ট্রাই ক্লোরাইড (AsCl3) সুপরিজ্ঞাত। এই তরলটি জলের সঙ্গে সহজেই বিক্রিয়া করে।
AsF3, AsF5, AsF6 প্রভৃতি জানা আছে। তবে পরিবেশে এরা গুরুত্বহীন। | |
+ 5 [ As(V)] | আর্সেনিক অকসাইড ( As2O5 ) | অম্লধর্মী, বর্ণহীন, সুস্থিত, সহজলভ্য। |
আর্সিনিক অ্যাসিড ( H3AsO4 ) ও তাদের নানারকম লবণ | pk1 = 2.2; pk2 = 6.9; pk3 = 11.5 | |
মনোমিথাইল আর্সেনিক অ্যাসিড ( MMA ) CH3 AsO (OH) 2 | জীবদেহে প্রাণরাসায়নিক বিক্রয়ায় এরা উপজাত এবং প্রসাবের সঙ্গেই এরা অনেকটাই নিস্ক্রান্ত হয়ে যায়। | |
ডাইমিথাইল আর্সিনিক অ্যাসিড ( DMA ) (CH3)2 AsO OH | Pk1 = 1.6; pk2 = 6.3 |
পরিবেশে নাইট্রোজেন, অকসিজেন, কার্বন, ফসফরাস প্রভৃতির মতো আর্সেনিকের জীব ভূয়াসায়নিক যে চক্র আছে, তার মধ্যে আর্সেনিকের নিয়ত এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর ঘটে চলে। পরিবেশে আর্সেনিকের সঞ্চয় ( mobilization ), বিস্তারন ( distribution ), জীবদেহে লভ্যতা ( bio – availability ), প্রভৃতি আর্সেনিকের রাসায়নিক প্রজাতির প্রকৃতি ও ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই সবে আয়রনের ঔদ-অকসাইডের ( FeO OH ) ভূমিকা নিরূপক। ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনোসিয়ামের অনুরূপ যৌগাদির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রয়োগের মাধ্যমে গত কয়েকশো বছরে আর্সেনিক রসায়নের বিশাল তথ্যভান্ডার গড়ে উঠেছে। গবেষণার মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল ওষুধ, সমরাস্ত্র ও পেস্টিসাইড পাবার আশায়। গবেষণাগারে সংশ্লেষিত অর্গ্যানোআর্সেনিকালের সংখ্যা অন্তত 32 হাজার। জলজ ও স্থলজ বিচিত্র অসংখ্য জীব ও জীবাণুর প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রচুর জটিল জৈব আর্সেনিক অনবরত সংশ্লিষ্ট ও রূপান্তরিত হচ্ছেই।
About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder
/articles/arasaenaikaera-paraakartaika-abasathaana