আর্সেনিকে বুদ্ধ্যঙ্ক হ্রাস ও চিনা গবেষণা


পানীয় জল আর্সেনিকের ওপর একটা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ই.পি.এ. করেছেন, তবে তা আমাদের জন্য নয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এতে তাঁরা দেখাচ্ছেন আর্সেনিক একটি A শ্রেণীর মানব কারিসনোজেন। 2004 সালের নভেম্বর মাসে চিন গণপ্রজাতন্ত্রের সাংসি প্রদেশের জাইয়ুয়ানে পানীয় জলের গুণগত মানের ওপর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ওয়াং সানজিয়াং পেশ করেন, তাতে দেখা যায় 8 - 12 বছর বয়সি স্কুলের ছাত্র - ছাত্রীদের প্রস্রাবে বর্ধিত আর্সেনিক ও ফ্লোরিনের সঙ্গে বুদ্ধ্যঙ্কের বিপরীত সম্পর্ক। নীচের ছকে গবেষণার ফলাফল দেখানো হল -

গড় বা তার চেয়ে বেশি বুদ্য্যঙ্কের শিশু সংখ্যা ( শতাংশে )

 

bv

বর্ধিত আর্সেনিক

বর্ধিত ফ্লোরিন

বর্ধিত ফ্লোরিন ও বর্ধিতআর্সেনিক

60.20

36.11

50.59

49.25

 

দেখা যাচ্ছে যে শুধুমাত্র আর্সেনিক বা ফ্লোরিন বা উভয়ের প্রভাবেই গড় বা তার চেয়ে বেশী বুদ্ধ্যঙ্কের শিশুর শতাংশ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সানজিয়াং-এ নয় লক্ষ ( 900000) মানুষ আর্সেনিক ও ফ্লোরিন-এর ঝুঁকিতে আছেন।

মেধা হ্রাসের সম্ভাব্য ক্রিয়াবিধি


মাতৃগর্ভে অবস্থিতির সময় থেকে জন্মের তিন থেকে চার বছরের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ হতে থাকে। সেই সময় আর্সেনিক, মার্কারি, PCB ও আয়ন সৃষ্টিকারী তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা অস্বাভাবিক হরমোন প্রভাবাম্বিত হলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (CNS) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাতে মস্তিষ্কের ব্যাহত বিকাশে সাম্প্রতিক স্মৃতিভ্রম থেকে চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাহত বুদ্ধিবৃত্তি ও স্মৃতিবিভ্রমে আর্সেনিকের সক্রিয়তা লেড, মার্কারি ও PCB -র ভূমিকার মতোই।

আর্সেনিকের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি


দুই বাংলার ( এপার বাংলা ও ওপার বাংলা ) আর্সেনিক মহামারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কোনও প্রকাশিত মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত দেখা যায় না। সাইক্লোন, বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতির ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাপ আমরা হামেসাই কাগজে দেখে থাকি। ক্রনিক আর্সেনিক বিষণের আর্থিক মূল্যায়ন যদি করতে পারা যেত তাহলে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ত। যেমন বায়ুদূষণ থেকে আসা লেড কমানো প্রকল্পে শিশুদের রক্তে ডেসিলিটার প্রতি এক মাইক্রোগ্রাম লেড - ভার কমাতে পারলে শিশুপ্রতি আমেরিকার সমাজের দুহাজার ডলার অতিরিক্ত খরচ বাঁচে। না হলে স্নায়বিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের চিকিত্সা ও অনুপূরক শিক্ষার জন্য ঐ অঙ্কের টাকা সমাজকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হত। বাতাসে বর্ধিত লেডে সাত বছর বয়সি শিশুদের বুদ্ধ্যঙ্ক হ্রাসের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে আমেরিকার পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি ( EPA ) এই হিসাব করেছে। এসবের ফল বিপুল গবেষণা ও অবশেষে পেট্রোলের লেড মুক্তি।

লেড আসত প্রধানত বাতাস থেকে। আর আর্সেনিক আসে বাতাসে ভর করে, জল বাহিত হয়ে, খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে। পানীয় জল আর্সেনিকের ওপর একটা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ই. পি. এ. করেছেন, তবে তা আমাদের জন্য নয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।

এতে তাঁরা দেখাচ্ছেন আর্সেনিক একটি A শ্রেণীর মানব কারিসনোজেন। দেহে প্রবিষ্ট আর্সেনিকের জন্য বর্ধিত ক্যানসারে মৃত্যু এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এর ফলে যকৃত, ফুসফুস ও মূত্রাশয়ে ক্যানসার হয়ে থাকে। চামড়ায়ও অতিরিক্ত ক্যানসার হয়। চামড়ার ক্যানসার ( ব্যাসাল সেল ও স্কোয়ানমাস সেল কারসিনোমা ) আমেরিকায় সারানো যায়। খরচ সারে তিন হাজার আমেরিকান ডলার ($ 3000 )। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী নয় এমন ব্রঙ্কাইটিসের অসুখ সারানোর খরচ এক লক্ষ আঠাত্তর হাজার ডলার ( $ 1,78,000 ) । সম্প্রতি এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ক্রনিক বিষণে ডায়াবেটিস মেলিটাস ও উচ্চ রক্তচাপও হয়। জলের বর্তমানের 50 পি.পি.বি. আর্সেনিকের দরুন উপরোক্ত অঙ্গসমূহে 100 জনে 1টি অতিরিক্ত ক্যানসার হবে। 10 পি.পি.বি. হলে 300 জনে হবে 1টি করে। ই.পি.এ. ও এন.আর.সি. তাইওয়ানের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখাচ্ছেন, পানীয় জলের আর্সেনিকে ব্রঙ্কাইটিস, লিভার সিরোসিস, নেফ্রোপ্যাথি, আন্ত্রিক ক্যানসার, পায়ু ক্যানসার, স্বরনালি ক্যানসার ও সেরিব্রোভ্যসকুলার অসুখসমূহ হয়ে থাকে। মূত্রাশয়,কিডনি, ত্বক, ফুসফুস ও নাসিকা গহ্বরের ক্যানসার ও সংবহনতন্ত্রের অসুখ থেকে পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি ( SMR>3 )। স্বরনালির ক্যানসার থেকে মহিলাদের মৃত্যুহার বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে আমরা জানি অসুখ - বিসুখে একেবারে শয্যাশায়ী না হলেও শরীর ও মন যখন খারাপ থাকে, তখন অনেক কাজই করে ওঠা যায় না, বা ভাল করে করা যায় না। শ্রমিক ও কৃষক তাদের উত্পাদনের কাজও ভাল করে করতে পারেন না। আজকাল বিশ্বব্যাঙ্ক, ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট এইরকম ক্ষতির ( যা মানুষকে মৃত্যুর উল্টোদিকে রাখে কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ্য রাখে না ) একটা নতুন মাপ, একটা মেট্রিক ( metric ), একটা আর্থিক সূচক ব্যবহার করছেন, যাকে ড্যালি বলা হয়। ড্যালি হল অশক্ততা নিয়ে চালিয়ে যাওয়া জীবনবর্ষ।

রোগজীবাণু জন স্বাস্থ্যের খুব বড় ও মারাত্মক শক্র। বার্ষিক প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ মৃত্যুর কারণ এই রোগজীবাণুগুলি এবং এসব অনুন্নত বিশ্বেই হয়ে থাকে সব থেকে বেশি। সারা বিশ্বে অবসাহার অঞ্চলেই ড্যালি ক্ষতি সর্বাধিক, তারপরেই রয়েছে ভারতের স্থান। মৃত্যুর আগে, এই ধারে বহু মানুষ কমবেশি অসুস্থ, রোগক্রান্ত থাকে। যার ফলে বহু কর্ম দিবস নষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি হয়। আর্থিক ক্ষতি হয় ব্যক্তি স্তরে ও সামাজিক উত্পাদনে। এই ক্ষতি ড্যালি দিয়ে মাপা হয়, যা জীবনের গুণগত মান নির্ধারণে আসে। একটা বড় অসুখ করল, চিকিত্সা করে অল্পদিনেই তা সারানো গেল। তার ড্যালি ক্ষতি কম। কিন্তু আমাশয়, ম্যালেরিয়া, হাঁপানি, আর্সেনিকের অসুখ প্রভৃতির মতো স্বল্পমাত্রার অসুখ-বিসুখের ড্যালি ক্ষতি অনেক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO ) 1990 সালে সারা বিশ্বে ম্যালেরিয়ার ড্যালি ক্ষতি হিসাব করে পেয়েছেন আড়াই শত কোটি জীবনবর্ষ ( 2,500,OO,000)। হু ডায়ারিয়া, হার্টের অসুখ, জন্মগত প্রতিবন্ধিকা, পথ দুর্ঘটনা প্রভৃতির ড্যালি হিসাব করেছেন।

বাংলার আর্সেনিক ড্যালির হিসাব দেখা যায় না, কঠিনও বটে। ক্রনিক আর্সেনিক বিষণে শরীরের অনাক্রম্যতা কমিয়ে দেয়, ফলে অন্যান্য রোগ সংক্রমণের পথ প্রশস্ত হয়। তার ওপরে অন্যান্য কিছু রোগ, যেমন ডায়ারিয়া, হাঁপানি ইত্যাদির সঙ্গে সহযোগী অতিক্রিয়ায় দৈহিক অশক্ততা বাড়ায়। ধূমপান, মদ্যপান প্রভৃতির মত কুঅভ্যাসও আর্সেনিকের সঙ্গে সহযোগী অতিক্রিয়ায় শারীরিক অসুস্থতা বাড়ায়। এদেশে মৃত্যুহার (mortality ) কোথাও কিছুটা পাওয়া গেলেও অসুস্থতার হিসাব প্রায় পাওয়াই যায় না, গরিব লোকেরা অল্প - স্বল্প অসুখ - বিসুখে ডাক্তার হাসপাতাল নার্সিংহোমে যায়ই না প্রায়। ড্যালি বাড়লে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। এখনও পর্যন্ত আর্সেনিক মহামারীতে দুই বাংলার সামান্য কিছু স্যাম্পল সার্ভে হয়েছে মাত্র!

About the writer: প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ডীন ফ্যাকল্টি অফ সায়েন্স, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: Extract from the book titled “Banglay Arsenic: Prokiti O Pratikar” written by Prof. Manindra Narayan Majumder


Path Alias

/articles/arasaenaikae-baudadhayanaka-haraasa-o-cainaa-gabaesanaa

Post By: Hindi
×