মরুভূমিতে ত্রিশ হাত গভীর কুণ্ডে পরিপূর্ণ জল রয়েছে, অথচ ত্রিশ ফোঁটা জলও বালিতে শুষে নেবে না l কোনো বড় বাস্তুকারই হয়তো এ রকম পোক্ত জল নিরোধক পলেস্তরার আশ্বাস নাও দিতে পারতে পারে, চেলওয়াজরা কিন্তু এই আশ্বাস দিয়ে থাকে l
‘আমরা খাদ্য না পেলে কিছুদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারি, জল না পেলে কয়েকটা দিন মাত্র বাঁচতে পারি, কিন্তু বিশুদ্ধ বায়ু না পেলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অবশ্যই আমাদের মৃত্যু ঘটবে। তাই পৃথিবীর বায়ু, মাটি, জল সঠিকভাবে সংরক্ষিত না হলে ভবিষ্যতে প্রাণের পরিবেশে যে ভীষণ সংকট নেমে আশবে তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে আমাদের মানব জীবন এখন এক কঠিন ও অভাবনীয় সত্যের মুখোমুখি। পরিবেশ বিপর্যয়ে, বিপন্ন মানুষের অস্তিত্ব, ধন সম্পদ ও প্রাচুর্যের প্রয়োজনে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে আসা হয়েছে ও হচ্ছে। প্রকৃতিকে নিঃস্ব করে, তার প্রাণসম্পদকে হরণ করে, দৈনন্দিন ব্যবহারিক বস্তুবাহুল্যে পরিণত করার আয়োজনে, জীবপ্রাণশক্তিই হয়েছে বিপন্ন। বিপর্যস্ত মানব জীবন ও জৈব প্রকৃতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ - পরিবেশ দূষণ, যা গ্রাহ্য মাত্রা ছড়িয়েছে বহুদিন আগেই। উন্নতির জন্য উন্নতির মত্ততা ও বিশ্বের বিত্তবান শ্রেণীর একপেশে ভোগবাদী জীবনযাত্রা এবং বস্তুকোলাহলপূর্ণ সংস্কৃতির বিশ্বায়ন, প্রাণ ও প্রাণী সম্পদকে এমন যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এসেছে, যা থেকে জন্ম নিয়েছে জীবনের বিপক্ষে নিয়ত যুদ্ধের ইতিহাস। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম অংশ, বৃহত্তম সম্পদ এখেনা দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে। বৈষম্যের চেহারাটা ক্রমশই যত প্রকট রূপ নিয়েছে, পরিবেশের সংকট ততই দিনে দিনে বেশি ঘনীভূত হয়েছে। আড়ালে গেছে মানুষ ও তার প্রাণ জীবনের ভবিষ্যত।অথচ ভোগবাদী সংস্কৃতির মুল্য দিতে, বঞ্চিত মানুষেরাই পেয়েছে পরিবেশ দূষণের মতন এক ভয়াবহ অবস্থাকে। বেহিসেবি, ভোগবাদী যান্ত্রিক ভাবে সভ্য সমাজ এই শতাব্দীর শেষে নিয়ে এল জল, বায়ু, মৃত্তিকা এবং শব্দ ও দৃশ্য দূষণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূষণের প্রকটতা ও সভ্যতার দৈন্যতা। মাটির প্রাণ সম্পদকে হরণ করে ও অরণ্যকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে, সামুদ্রিক জৈব প্রাণশক্তিকে প্রায় বিনষ্টের মুখে এনে ফেলেছে ভবিষ্যত শতাব্দীর বিজ্ঞান, যুক্তি, সমাজ সংস্কৃতি। বর্তমান যন্ত্র সভ্যতা মানব সভ্যতার সম্বন্ধকে একেবারে নতুন সমালোচনার মাত্রায় দেখতে বাধ্য করেছে। প্রযুক্তি সভ্যতার ইতিহাসেও এত বড়ো সংকট আগে বোধহয় আর কখনও আসেনি। পৃথিবীতে প্রাণী প্রজাতির যে মহাজগত গড়ে উঠেছে তার মধ্যে মানুষ শুধুমাত্র একটি প্রজাতি মাত্র। বিবর্তনের সূত্রে এই গ্রহে মানুষ এসেছে সবার শেষে। আবির্ভাবের মুহূর্ত থেকেই মানুষ প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ছয় শত কোটি মানুষ পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর মাত্রা চার দশক পরে অর্থাত 2050 সালে সংখ্যাটা লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় এক হাজার কোটিতে।
প্রকৃতির যদি কোন আকৃতিগত পরিবর্তন না হত আদিকাল থেকে, তাহলে আজকের এই সভ্যতা এই কলেবর ধারণ করত কী ? যতক্ষণ পর্যন্ত না আজকের এই সভ্যতাকে ঝুটা সভ্যতা বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, ততদিন আমরা বোধহয় মেনে নিতে বাধ্য প্রকৃতির কোন না কোন পরিবর্তন যুগ - যুগান্তর ধরে ঘটে আসছে ও ঘটানো হয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে প্রকৃতি নিজের থেকেই পরিবর্তনশীল। আবহওয়া, জলবায়ু ইত্যাদি প্রকৃতিতে কখনই একই অবস্থায় ও একই রকমভাবে থাকে না বা থাকতে দেওয়া হয় না। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল কি নেই? এ সবই আমাদের সবার জানা যে এর প্রকোপে কত ভয়াবহ জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি তো হচ্ছেই তা ছাড়াও পরিবেশ ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আঞ্চলিক দুর্যোগ প্রবণতার সঙ্গে ঝুঁকি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে তা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষ অনেক সময়ই এই জাতীয় ক্ষতির জন্য দোষী ও দায়ী, বিশেষ করে বন্যা, খরা বা ধ্বসের জন্য। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প ইত্যাদির জন্য মানুষকে দোষী করা যায় না। শেষোক্ত দুটি দুর্যোগের জন্য প্রকৃতি নিজেই অনেকাংশে দায়ী।
তথ্যসূত্রঃ-
১. অরুনেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ-ভাবনা,’ পরিবেশ দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, 5 জুন 1999 ।
২. অনিল বরণ ভুঁইয়া রচিত ‘পৃথিবীর পরিবেশ কী সংকটে?’ বেস্ট বুকস, জানুয়ারী 2006।
৩. দিলীপ কুমার সিংহ রচিত ‘পরিবেশ ও দুর্যোগ’, শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ, জানুয়ারী, 2009।
सम्पर्क
ড. অরুণকান্তি বিশ্বাস
প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা ও ডেপুটি ডাইরেক্টর, ন্যাশানাল এনভায়রনমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং রির্সাচ অনস্টিটিউট (নিরী), কলকাতা
Path Alias
/articles/amaadaera-adauuradarasai-kaarayaabalai-paraakartaika-baiparayaya-daekae-anachae
Post By: Hindi